বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৩৭ অপরাহ্ন

শেখ মুজিব ছাড়াও বিশ্বে যে ক্ষমতাবানদের ভাস্কর্য বা মূর্তি ভাঙা হয়েছে

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৪ আগস্ট, ২০২৪

সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার এবং জুতোর মালা পরিয়ে দেওয়ার দৃশ্য দেখেছে গোটা বিশ্ব।

তবে বাংলাদেশে যে চিত্র দেখা গিয়েছে তা বিরল নয়। এর আগে বিভিন্ন সময় বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সেই সমস্ত ব্যক্তিত্বদের ভাস্কর্য বা মূর্তিকে এভাবে নিশানা করা হয়েছে যাদের কোনও এক যুগে সেখানকার মানুষ অত্যন্ত সম্মান করতেন বা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন।

কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর মানুষজনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে তাদের ভাস্কর্য বা মূর্তির ওপরে।

বিবিসি বাংলার এই প্রতিবেদনে এরকম কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হলো।

মার্কিন সেনাদের সহায়তায় ভেঙে ফেলা হয় সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,মার্কিন সেনাদের সহায়তায় ভেঙে ফেলা হয় সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি।

বাগদাদে সাদ্দাম হোসেনের মূর্তি ভাঙা

২০০৩ সালে যখন মার্কিন ট্যাঙ্ক ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ঢুকে সাদ্দাম হোসেনের সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে, তখন চারদিকে আনন্দের পরিবেশ দেখা গিয়েছিল।

এরপর ফিরদৌস স্কোয়্যারে সাদ্দাম হোসেনের যে বিশাল মূর্তি ছিল সেটা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করেন ইরাকের মানুষ। কিন্তু তাতে তারা সফল হননি। তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন সেখানে উপস্থিত মার্কিন সেনারা।

সাদ্দাম হোসেনের ১২ মিটার উঁচু এই মূর্তি ২০০২ সালের এপ্রিল মাসে নির্মাণ করা হয়েছিল।

মার্কিন সেনারা সাদ্দাম হোসেনের মূর্তির গলায় লোহার শিকল জড়িয়ে এম৮৮ সাঁজোয়া যানের সঙ্গে বেঁধে টেনে নিয়ে যায়। এরপর ভেঙে পড়ে ওই মূর্তি।

সঙ্গে সঙ্গে সেখানে জড়ো হওয়া জনতা মূর্তির টুকরো সংগ্রহ করতে থাকেন। ভাঙা মূর্তির টুকরোতে জুতো দিয়ে আঘাত করতে করতে বাগদাদের রাস্তায় প্যারেড করতে দেখা যায় জনতাকে। এই দৃশ্য বিশ্বের সব টেলিভশন চ্যানেলে সরাসরি দেখানো হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেনের ক্ষমতার অবসানের প্রতীক হিসাবে মনে করা হয়েছিল এই পুরো বিষয়টাকে।

এই ঘটনার সঙ্গে অনেকেই তুলনা করেছিলেন ১৯৫৬ সালে হাঙ্গেরিতে বিপ্লবের প্রচেষ্টার যেখানে স্ট্যালিনের একটা মূর্তি ভাঙা হয়েছিল।

ফাইল ছবি- গাদ্দাফির মূর্তিও ভাঙা হয়।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ফাইল ছবি-গাদ্দাফির মূর্তিও ভাঙা হয়।

গাদ্দাফির মূর্তি ভাঙা

এই দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ২০১১ সালে লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের সময়। ওই সময় ত্রিপোলির বাব আল-আজিজিয়া প্রাঙ্গণে ঢুকে তার মূর্তির মাথা ভেঙে ফেলার পর সেটা পদদলিত করার দৃশ্য ধরা পড়েছিল।

সেই বছর ২৩ আগস্ট ওই প্রাঙ্গণে মোতায়েন রক্ষীরা বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

গাদ্দাফির মৃত্যুর পর এই প্রাঙ্গণকে পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তর করা হয়। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ হতে থাকে এই স্থান দেখার জন্য।

ইউক্রেনে লেনিনের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্য।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ইউক্রেনে লেনিনের ভাস্কর্য ভাঙার দৃশ্য।

ইউক্রেনে ভূলুণ্ঠিত লেনিনের মূর্তি

২০১৪ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের খারকিভে প্রায় পাঁচ হাজার বিক্ষোভকারী ভ্লাদিমির লেনিনের একটা মূর্তি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে মাটিতে ফেলে দেয়।

এই পুরো কাজটা করতে তাদের সময় লেগেছিল প্রায় চার ঘণ্টা। ১৯৬৩ সালে তৈরি হয়েছিল এই মূর্তি যার নকশা করেছিলেন আলেকজান্ডার সিডোরেঙ্কো।

লেনিনের মূর্তি ভেঙে ভূলুণ্ঠিত করে দেওয়ার পর সেখানে জড়ো হওয়া জনতা মূর্তির টুকরোগুলো স্মারক হিসেবে সংগ্রহ করতে শুরু করে। সেখানে ইউক্রেনের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এরপরই শুরু হয়ে যায় দেশজুড়ে লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রক্রিয়া।

ইথিওপিয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি

লেনিনের ভাস্কর্যের অনুরূপ পরিণতি দেখা গিয়েছে ইথিওপিয়ায়। সেখানকার রাজধানী আদিস আবাবার পৌরসভার একটা গ্যারেজে রুশ নেতা লেনিনের একটা মূর্তি রয়েছে। পিঠের উপর ভর করে পড়ে আছে সেই মূর্তি। তার চারপাশে অসংখ্য মাকড়সার জাল আর পেট্রোলের খালি করা পিপে।

খুব কম মানুষই সেই মূর্তি দেখতে আসেন। আর যারা আসেন তাদের সেখানে উপস্থিত কর্মীরা লেনিনকে ‘না জাগানোর’ জন্য সতর্ক করেন।

প্রসঙ্গত, লেনিনের এই মূর্তি শুধু বড়ই নয়, ভারীও। সেটা টেনে নামাতে গিয়ে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। দড়ি বেঁধে এই মূর্তিকে সরানো সম্ভব হয়নি। এই মূর্তিকে তার জায়গা থেকে সরানোর জন্য যন্ত্রের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।

১৯৮৯ সালের নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর পতনের পর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এই একই দৃশ্য দেখা গিয়েছে। বারেবারে ভেঙে ফেলা হয়েছে লেনিনের মূর্তি।

ঠিক একই চিত্র দেখা গিয়েছিল আলবেনিয়ায়। সেখানে ৪০ বছর ধরে ওই দেশ শাসন করা এনভার হোক্সার বেশ কয়েকটা মূর্তিও ভেঙে ফেলা হয়।

ফেলিক্স জেরনস্কির মূর্তি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ফেলিক্স জেরনস্কির মূর্তি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।

ফেলিক্স জেরনস্কির মূর্তি সরিয়ে ফেলা

১৯৯১ সালে রাশিয়ায় প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভকে উৎখাতের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মস্কোর লুবিয়াঙ্কা স্কয়ারে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রথম গুপ্ত পুলিশ সংস্থা ‘চেকা’র প্রতিষ্ঠাতা ফেলিক্স জেরনস্কির মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়।

কমিটি অফ স্টেট্ সিকিউরিটি যার রুশ ভাষায় সংক্ষিপ্তকরণ ‘কেজিবি’, সেই সংস্থার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে অপহরণ, নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়।

১৯৯১ সালের ২২ আগস্টের সন্ধ্যায় হাজার হাজার মানুষ লুবিয়াঙ্কা স্কয়ারে অবস্থিত কেজিবি ভবনের সামনে জড়ো হয়।

তারা জেরনস্কির মূর্তির গায়ে লিখে দেন ‘খুনি’। সেখানে উপস্থিত বিক্ষোভকারীরা মূর্তির উপরে উঠে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল মূর্তিকে ট্রাকের সঙ্গে বেঁধে টান দিয়ে উপড়ে ফেলা।

কিন্তু পার্শ্ববর্তী লুবিয়ানকা মেট্রো স্টেশনের ইমারতের পক্ষে তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

সেই সময় মস্কো সিটি কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান সের্গেই স্টানকেভিচ উপস্থিত জনতাকে জানান তিনি নিজেই মূর্তিটি অপসারণে নেতৃত্ব দেবেন।

এরপর ক্রেনের সাহায্যে সেখান থেকে ওই মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়। সেই মূর্তির স্থান হয় ‘ফলেন মনুমেন্ট পার্কে’।


তৃতীয় জর্জের লোহার মূর্তি ভেঙে গলিয়ে ফেলা হয়।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,তৃতীয় জর্জের লোহার মূর্তি ভেঙে গলিয়ে ফেলা হয়।

তৃতীয় জর্জের লোহার মূর্তি ভেঙে বুলেট

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় নিউইয়র্কে ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জের একটা লোহার মূর্তিও ভেঙে ফেলা হয়েছিল।

স্বাধীনতার জন্য লড়াইয়ে সামিল আমেরিকানরা এই মূর্তিকে ব্রিটিশ অত্যাচারের প্রতীক হিসাবে বিবেচনা করতেন।

এই মূর্তি শুধুমাত্র ভেঙে ফেলাই হয়নি তারপর সেটা গলিয়ে ৪২০০০ বুলেটও বানানো হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে সেই বুলেটই ব্যবহার করা হয়েছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে।

ব্রিটেনের অনুগত কিছু ব্যক্তি অবশ্য ভেঙে ফেলা সেই মূর্তির কিছু অংশ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। মূর্তির ভাঙা অংশ তাদের মাটিতে পুঁতে ফেলেন। আজও খননকার্যের সময় সেই মূর্তির কিছু অংশ বেরিয়ে আসে।

মুসোলিনির মূর্তিরও একই পরিণতি দেখা যায়।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,মুসোলিনির মূর্তিরও একই পরিণতি দেখা যায়।

মুসোলিনির মূর্তিরও একই পরিণতি

১৯৪৫ সালে ইতালির স্বৈরশাসক মুসোলিনির পতন হয়। সেই সময় তার মূর্তিরও একই পরিণতি দেখা গিয়েছিল।

তার ক্ষমতাচ্যুতির পর তার কিছু সমর্থক এবং তার বান্ধবী ক্লারা পিটাচিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। একটা ভ্যানে করে তাদের মৃতদেহ মিলানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে একটা খুঁটি থেকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় তাদের দেহগুলো।

এরপর শুরু হয় মুসোলিনির মূর্তি ভাঙার প্রক্রিয়া। স্বৈরাচারের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হওয়া সমস্ত স্মারক, ভবন এবং মূর্তি ভেঙে দেওয়া হয়। বেশ কয়েক মাস ধরে চলেছিল এই একই প্রক্রিয়া।

দিল্লির ইন্ডিয়া গেট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় পঞ্চম জর্জের মূর্তি।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,দিল্লির ইন্ডিয়া গেট থেকে সরিয়ে ফেলা হয় পঞ্চম জর্জের মূর্তি।

সরানো হয় পঞ্চম জর্জের মূর্তি

১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীন হয়, তখন দিল্লির অনেক জায়গায় ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত কর্তা ব্যক্তিদের মূর্তি ছিল।

এই মূর্তিগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা যুক্তরাজ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছিল এবং কিছু স্থানান্তরিত করা হয় দিল্লিতে। উত্তর দিল্লির করোনেশন পার্কে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল সেই মূর্তিগুলো।

যে কয়টা মূর্তি সরিয়ে ফেলা হয়েছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে পঞ্চম জর্জের মূর্তি। ৭০ ফুট উঁচু ছিল এই মূর্তি।

প্রসঙ্গত, ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত কিন্তু ব্রিটিশ রাজা পঞ্চম জর্জের মূর্তি তার পুরানো জায়গাতেই ছিল। কিন্তু পরে বিবেচনা করে স্থির করা হয়, দিল্লির এমন এক বিশিষ্ট স্থানে এই মূর্তি থাকার কোনও যুক্তি নেই। তাই তা সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

পঞ্চম জর্জের মূর্তি ধ্বংস করা হয়নি বরং রাখা হয়েছিল ঠিক সেই স্থানে যেখানে ১৯১১ সালে তিনি দিল্লি দরবারে গিয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইন্ডিয়া গেটের কাছে যেখানে পঞ্চম জর্জের মূর্তি আগে রাখা ছিল, সেখানেই ২০২২ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর মূর্তি বসানো হয়।

ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ারের ছবি।

ছবির উৎস,Getty Images

ছবির ক্যাপশান,ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ারের ছবি।

হাইতিতে দুভালিয়ারের মূর্তি ভাঙচুর

১৯৭১ সালে হাইতির স্বৈরশাসক ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ার মৃত্যুর পর তার মরদেহকে কালো কোট পরিয়ে কাচের ঢাকনা দেওয়া কফিনে রাখা হয়।

তার দেহ প্রথমে জাতীয় কবরস্থানে দাফন করা হয় এবং পরে তা স্থানান্তরিত করা হয় তার ছেলের নির্মাণ করা গ্র্যান্ডিওস যাদুঘরে।

মৃত্যুর আগে তিনি তার ১৯ বছরের ছেলে জ্যঁ-ক্লদ দুভালিয়ারকে নিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত করে যান। ১৯৮৬ সালে তার ছেলেকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ারের মূর্তি ও সমাধিসৌধ উন্মত্ত জনতা ভাঙচুর করে।

সেই সময় তার (ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ারের) কবর খনন করা হলে দেখা যায় তার কফিন সেখানে নেই। সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশ ছাড়ার আগে তার পুত্র জ্যঁ-ক্লদ দুভালিয়ার বাবা ফ্রাঁসোয়া দুভালিয়ারের কফিন ওই স্থান থেকে সরিয়ে অন্যত্র রাখার ব্যবস্থা করেন।

বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com