অপরূপা বাংলাদেশ। আর তেমনই অপরূপ আমাদের প্রকৃতি। ছয়টি ঋতুর মায়ায় বছরের বারো মাসই প্রকৃতি ভিন্ন রূপ মেলে ধরে এই দেশে। শীতে সারা দেশের সঙ্গে মিলিয়ে তেমনই অপরূপা বান্দরবান।
বান্দরবানে বেড়াতে এসে কখনো মন খারাপ করে বাড়ি ফেরে না পর্যটকেরা। চিরসবুজের ছোঁয়া যাঁরা পেতে চান, তাঁদের যেতে হবে পাহাড়ি জনপদের পাহাড়ের আনাচে-কানাচে।
শীতের হিমেল পরশে সজীব হয়ে ওঠে পার্বত্য প্রকৃতিও।
বান্দরবানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের খ্যাতি ছড়িয়েছে এরই মধ্যে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও। আর তাই এবারের পর্যটন মৌসুম শুরু হতে না হতেই নানা হোটেল-মোটেল আর গেস্ট হাউসে শুরু হয়েছে পর্যটকদের আনাগোনা।
প্রতিবছরের মতো এবারও শীতকে সামনে রেখে বান্দরবানে পর্যটকদের ভিড় বাড়ছে। বিদেশি পর্যটকদের ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে নীলাচল, মেঘলা, শৈলপ্রপাত ঝরনাসহ দর্শনীয় স্থানগুলোতে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে বিদেশি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বান্দরবানসহ পার্বত্যাঞ্চলে বিদেশি পর্যটকদের আসা কমে গিয়েছিল। কিন্তু শীতের শুরুতেই বান্দরবানে বিদেশি পর্যটকদের আসা আবার শুরু হওয়ায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন হোটেল-মোটেলের মালিকরা।
বান্দরবানের পর্যটন মোটেলের ম্যানেজার মিজানুর রহমান জানান, দেশে বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় বিদেশি পর্যটকদের আগমন একদম কমে গিয়েছিল। কিন্তু ইদানীং বিদেশি পর্যটকদের আগমন বেড়েছে। শীতে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।
বান্দরবানের মিলনছড়ি হিলসাইড রিসোর্টের ম্যানেজার রয়েল বম বলেন, ‘চলতি সপ্তাহে আমাদের রিসোর্টে ১২ জন বিদেশি পর্যটক পেয়েছি। আজকে সুইডেনের একজন পর্যটক রয়েছে। বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা আগের চেয়ে চলতি মাসে কিছুটা বেড়েছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে আশা করা যাচ্ছে আগামীতে আরো বাড়বে।’
শীতের সময়টা বেড়ানোর উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয় ভ্রমণপিপাসুরা। প্রতিবছর শীতকে সামনে রেখে বান্দরবানে পর্যটকদের বাড়তি চাপ দেখা যায়। শীতের পরশে পর্যটকদের সরব উপস্থিতিতে চাঙ্গা হয়ে উঠছে বান্দরবানের আবাসিক হোটেল, রিসোর্ট, গেস্টহাউস, রেস্টুরেন্ট এবং পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
আর পর্যটকরা কেনই বা ছুটে আসবেন না রূপের রানিখ্যাত এই জেলায়! কী নেই এই জেলায়? নীলাচল পাহাড়ের চূড়া থেকে সূর্যাস্ত দেখা, নীলগিরি থেকে পাহাড়ের সমুদ্র, পাহাড়ের চূড়ায় প্রাকৃতিক বগা লেক, পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝরে পড়া রিজুক, জাদিপাই, চিংড়ি আর শৈলপ্রপাত ঝরনার হাতছানি। আছে গা ছমছমে বাদুড়গুহা, আলীর সুরঙ্গপথ। মেঘলায় লেকের ওপরে আকর্ষণীয় দুটি ঝুলন্ত সেতু, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান নামে পরিচিত স্বর্ণমন্দির, রামজাদী মন্দির, রেমাক্রি বড় পাথর, দেবতা পাহাড়, নাফাকুম জলপ্রপাত। পর্যটকরা দেখতে যান ছোট্ট পরিসরে গড়ে তোল চা বাগান, দেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাকাহাফং, তাজিংডং বিজয়, কেওক্রাডং চূড়াও। পাহাড়ি সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ এই জেলায় আছে ভিন্ন ভাষার এগারোটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিও। জাতি আর ধর্ম নির্বিশেষে সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বান্দরবানের সৌন্দর্য বাড়িয়েছে বহুগুণে।
প্রকৃতির নির্মল ছোঁয়া পেতে বান্দরবানে প্রতিদিনই ভিড় জমাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ভ্রমণপিপাসু মানুষরা। দেশীয় পর্যটকদের সঙ্গে বাড়ছে বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যাও। জেলা আবাসিক হোটেল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, শীতের সময়েই পর্যটকের আগমন ঘটে বেশি। পর্যটকদের বরণে জেলার প্রায় ৪৫টি আবাসিক হোটেল-মোটেল, রিসোর্ট এবং গেস্টহাউসগুলো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে। পর্যটকদের সঙ্গে ভালো আচরণ এবং সকল ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের পর্যটকবান্ধব হতে যথাযথ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধ এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে।
শীতে পর্যটকদের নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় ভ্রমণ নিশ্চিত করতে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং পার্বত্য জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, ‘পর্যটকদের নিরাপত্তায় দুর্গমাঞ্চলের দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। পর্যটকদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রশাসনের তালিকাভুক্ত গাইডের মাধ্যমে নির্ধারিত ফরমে নাম-ঠিকানা, মোবাইল নম্বর এবং ভ্রমণের স্থানগুলো লিখে স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ফরমটি জমা দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়েছে। তবে শহরের আশপাশে নীলগিরি, চিম্বুক, নীলাচল, মেঘলা, স্বর্ণমন্দিরসহ স্পটগুলো ভ্রমণে কোনো বিধিবাঁধা নেই। বিদেশি পর্যটকদের নিরাপত্তায় দর্শনীয় স্থানগুলোতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পর্যটকদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি স্থান বান্দরবান। শুধু শীত নয়, বর্ষায় পাহাড় আরো সবুজ ও বৈচিত্র্যময়। পর্যটনশিল্পের অনেক উন্নয়ন হয়েছে এ জেলায়, যোগাযোগব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা এবং আবাসন ক্ষেত্রেও। নতুন নতুন বেশকিছু কটেজ, হোটেল-মোটেল এবং গেস্টহাউস হয়েছে। নীলাচলের পর এবার শৈলপ্রপাতের সৌন্দর্যবর্ধনে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শীতে পর্যটকদের বাড়তি চাপের কথা মাথায় রেখে পর্যটকের নিরাপদ এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় ভ্রমণ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’