রুয়ান্ডায় তিন বছর: কী দেখেছি, কী দেখিনি

পূর্ব আফ্রিকার একটি ছোট্ট দেশ রুয়ান্ডা। দেশটির সীমান্তবর্তী দেশ হিসেবে আছে উগান্ডা, তাঞ্জানিয়া, বুরুন্ডি ও গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো। দেশটির আয়তন ২৬ হাজার ৩৩৮ বর্গকিলোমিটার, যা মাইলের হিসাবে ১০ হাজার ১৬৯ বর্গমাইল।

প্রতি বর্গকিলোমিটারে আছে ৪৪৫ জন লোকের বাস। এ কারণে রুয়ান্ডাকে আফ্রিকার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৩ মিলিয়ন (১ কোটি ৩০ লাখ)।

অতীতে আফ্রিকা নাম শুনলেই একটা অন্য রকম ভাবনা কাজ করত, যা এখনো আমার মতো অনেকেরই হয়ে থাকে। যেমন কেমন হবে, জঙ্গলে ভরা, জংলি মানুষ ইত্যাদি ইত্যাদি। তবে ২০০৭ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ ঘানাতে প্রায় বছর তিনেক অবস্থানের কারণে এ ভাবনা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। কারণ, মানুষদের মধ্যে জংলিপনার তেমন কিছু চোখে পড়েনি সে সময়।

তিন বছরের বেশি সময় ধরে একটা আন্তর্জাতিক ক্ষুদ্র ঋণদানকারী সংস্থার দেশপ্রধান নিযুক্ত হয়ে কাজ করে যাচ্ছি এই দেশে। কাজের ধরনের কারণেই প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত যেতে হয়। তাই দেশটির অতি সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে অনেক কিছু সম্পর্কেই বেশ ভালো ধারণা পাই। পাশাপাশি নিজের ভালোবাসার বাংলাদেশকেও এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিতি করানো যায় অতি সহজেই।

রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কাছ থেকে ১৯৬২ সালের ১ জানুয়ারি স্বাধীনতা লাভ করে। তারপর থেকে চলছিল ভালোই। কিন্তু ১৯৯৪ সালের জাতিগত দাঙ্গায় প্রায় মিলিয়নের (১০ লাখ) ওপরে মানুষের মৃত্যু হয়। এ কঠিন অবস্থা কাঠিয়ে সারা বিশ্বের জন্য দেশটি আজ বলা যায় একটা মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে। এমনকি অনেকেই দেশটিকে ‘আফ্রিকার ‍সুইজারল্যান্ড’ বলতেও ছাড়ছেন না।

অর্থনীতির মূল কৃষি হলেও চা ও কফিই একমাত্র রপ্তানিযোগ্য পণ্য। তবে আজকাল পর্যটন একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। বলতে গেলে এটা অত্যন্ত দ্রুত বর্ধনশীল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আমার এ সময়ে কী দেখেছি আর কী দেখিনি
চলতি বছরের শুরুর দিকে বাংলাদেশ থেকে বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা সাংবাদিক এ দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। ফেরত যাওয়ারকালে তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, রাস্তাঘাটে কেমন ময়লা–আবর্জনা দেখেছেন বা দৈনিক কতটা গাড়ির হর্ন তাঁদের কানে বেজেছে।

এক কথায় তাঁদের উত্তর ছিল, কই, দেখিনি তো বা তেমন করে শুনিনি তো!

উল্লেখ্য, সাংবাদিকদের দলে মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, নঈম নিজাম, শ্যামল দত্ত, জ ই মামুন ও মুন্নী সাহা ছিলেন।

যা দেখেছি, এর ফর্দ যদি বিমানবন্দর থেকে শুরু করি, তাহলে প্রথমেই তাদের ইমিগ্রেশনের প্রশংসা করতেই হবে। যেখানে নিমেষেই কাজটি হয়ে যায় ও লাগেজ এলাকায় এসেই আমার লাগেজটি দেখতে পাই। সব মিলিয়ে ১৫ মিনিটের বেশি সময় দিতে হয় না।

দেশটিকে পলিথিনমুক্ত রাখতে তাদের প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। এর শুরু হয় মূলত বিমানবন্দর থেকেই। কাউকেই কোনো ধরনের পলিথিনের ব্যাগ নিয়ে শহরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। এ থেকে ভেতরের অবস্থা মোটামুটি অনুধাবন করা যায়।

রাজধানী কিগালিসহ সারা দেশের রাস্তায় কখনোই কোনো আবর্জনা, এমনকি একটা ছোট কাগজের টুকরোও পড়ে থাকতে দেখা যায় না। গন্ধযুক্ত ময়লা-আবর্জনার কথা তো চিন্তাই করা যায় না।

আমার তিন বছরের বেশি সময় এ দেশে অবস্থানকালে গাড়ির ভেঁপু কদাচিৎ শুনেছি। কাউকেই ভেঁপুতে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখিনি। মাঝেমধ্যে নিজে নিজেই আক্ষেপ করে বলতে ইচ্ছে করে, এমন এক দেশ থেকে এলাম, যেখানে শত কান্নাতেও ভেঁপু থেকে চালকের হাত সরানো যায় না। আর এমন এক দেশে এলাম, যেখানে শত অনুরোধেও চালকের হাত ভেঁপুতে যায় না।

রাস্তায় ছাত্রছাত্রী হাঁটছে বা মনে হচ্ছে চালকের সামনে দিয়ে ওই ছাত্রছাত্রী রাস্তা পার হবে। ব্যস, কোনো কথা নেই। আগে তাদের পার করে তারপর চালক যাবেন।

এ সময়ে কোনো অফিসেই কখনোই স্পিডমানি বলুন বা ঘুষই বলুন কোনো হিসেবেই একটি কয়েনও পরিশোধ করতে হয়নি। কাজ চলছে কাজের গতিতেই। কোনো ফাইলকেই কোথাও কখনোই স্পিডমানির জন্য আটকে থাকতে হয়নি বা চোখে দেখিনি।

হেলমেটবিহীন কোনো মোটরসাইকেলচালক বা আরোহীকে কখনোই দেখা যাবে না। প্রত্যেক চালকই একটি করে অতিরিক্ত হেলমেট নিয়েই বাড়ি থেকে বের হন। উল্লেখ্য, এ দেশে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন করা হয়ে থাকে এবং দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষের বাহনও মোটরসাইকেল।

ঝগড়াঝাঁটি বলুন, মারামারি বলুন, খুব কমই চোখে পড়েছে। এমনকি উচ্চবাচ্যও। সর্বত্রই সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান।

রাস্তা সংস্কার হয় এবং আমাদের মতো ঠিকাদার দিয়েই তা করা হয়ে থাকে। তবে প্রতিটি কাজের পাশে যে তারিখে সংস্কার কাজটি হলো, সেটি লিখে রাখতে হয়। যাতে পুনঃসংস্কারের প্রয়োজন হলে তাদের দায়িত্বেই কোনো খরচ ব্যতিরেকে আবারও কাজটি করানো যায়। সুতরাং কাজটি ভালোভাবেই হয়ে থাকে।

ভাবছেন এখানে সবাই ফেরেশতা! মোটেই নয়। বরং এ দেশেও অন্যায়-অনিয়ম হয়ে থাকে। যেহেতু তারাও মানুষ অসামঞ্জস্য এখানেও থাকবেই। তবে চোখে পড়ার মতো বিষয়গুলো তারা খুবই সযতনে সম্পাদন করে থাকে। এ দেশের মানুষের কি কোনো সুপার কোয়ালিটি আছে? না। তারাও অতি সাধারণ মানুষ তবে ভালো কিছু তারা ধারণ করেছে, যা এমনকি পার্শ্ববর্তী অনেক দেশও ধারণ করতে পারেনি। তারা বুঝেছে যে এসব কাজ তাদের করতে হবে এবং এসব বোঝার মেসেজ তারা পেয়েছে তাদের রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব থেকে।

আমরাও কি এমন মেসেজ পাই না। নাকি ধারণে অক্ষম?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: