রাতের সেন্ট মার্টিন

সেন্ট মার্টিন দ্বীপে এখন দৈনিক ভ্রমণে যাচ্ছেন চার হাজারের বেশি পর্যটক। সাপ্তাহিক ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বাড়ে আরও দেড় থেকে দুই হাজার। পর্যটকদের আনন্দ দিতে হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ, রেস্তোরাঁগুলো প্রতিযোগিতা করে আলোকসজ্জা করে। আলোকসজ্জা বাড়লেও এর বিপরীতে যে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে, তা নিয়ে খুব বেশি মানুষের বিকার নেই।

গত ফেব্রুয়ারি ও চলতি মার্চ মাসে তিন দফায় সাত দিন সেন্ট মার্টিনে অবস্থান করে দ্বীপের ভয়াবহ অবস্থা লক্ষ করেন প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক। দ্বীপের চারদিকে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট কেয়াবন উজাড় করে তৈরি হয়েছে ৩০টির বেশি রিসোর্ট, কটেজ। সৈকতের প্রবাল পাথর আহরণ করে ব্যবহার করা হচ্ছে রিসোর্টের কাজে। দ্বীপের ফসলি জমিতে তৈরি হচ্ছে নানা অবকাঠামো। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে নলকূপগুলোতে লোনা পানি আসছে।

যদিও ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে পাথর-বালু, প্রবাল-শৈবাল, শামুক-ঝিনুক আহরণসহ সব ধরনের স্থাপনা-অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়। গত দুই দশকে সরকারি আইন অমান্য করে দ্বীপের যত্রতত্র তৈরি হয়েছে ২৩০টির বেশি হোটেল, রিসোর্ট, কটেজ। এগুলোর কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।

এর সত্যতা নিশ্চিত করে পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিনের কান্না থামাতে হলে সরকারি আইন ও বিধিনিষেধ পালনে সব মহলকে আন্তরিক হতে হবে। নইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের একার পক্ষে সেন্ট মার্টিনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অবৈধভাবে যেন হোটেল রিসোর্ট না হয়—সে ব্যাপারে এখন কঠোর নজরদারি হচ্ছে।

দ্বীপের সুরক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তরের জারি করা ১৪ দফায় বলা আছে, রাতের বেলায় সৈকতে কোনো প্রকার আলোকসজ্জা বা আগুন জ্বালানো, আতশবাজি ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ। জোয়ার–ভাটা এলাকার পাথরের ওপর হাঁটাচলা নিষেধ। দ্বীপের সৈকতে মোটরসাইকেলের মতো যান্ত্রিক বাহন থেকে শুরু করে সাইকেল, ভ্যান, রিকশার মতো অযান্ত্রিক বাহনের চলাচল নিষিদ্ধ। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানে চলাফেরা, সৈকতে রাতে আলো জ্বালানো এবং ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার করে ছবি তোলা, সৈকতে মাইক বাজানো, হইচই বা উচ্চ স্বরে গানবাজনা, বারবিকিউ পার্টি করা নিষিদ্ধ করা হয়, কিন্তু হচ্ছে উল্টোটা।

আটলান্টিক রিসোর্টের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সোলেমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যা কিছু দেখছেন, পর্যটকের আনন্দ-বিনোদনের জন্য করা হয়েছে। দ্বীপের চারদিকে এ রকম আরও ৪০ থেকে ৫০টি হোটেল-রিসার্টেও আলোকসজ্জা হচ্ছে, সৈকতে হইচই হচ্ছে। অন্য হোটেল, রিসোর্টগুলো যেভাবে তৈরি হয়েছে, আটলান্টিকও সেভাবে হয়েছে।’

দ্বীপের পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তর সৈকতের নোনাজল, জ্যোৎস্নালয়, দ্বীপান্তর, সায়রী, বেলি ইকো, কিংশুক, ডিমাই প্যারাডাইস, গোধূলি, স্যান্ড ক্যাসল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সূর্যস্নান, বেলাভিস্তা, সান সেট, সেরিনিটিসহ বিভিন্ন রিসোর্টে আলোকসজ্জা করা হয়েছে। নির্জন সৈকতের পাশে রিসোর্টগুলোতে পর্যটকদের ভিড় বেশি।

বর্তমানে দ্বীপে আবাসিক হোটেল রিসোর্ট ও কটেজের সংখ্যা ২৩০টির বেশি বলে জানান সেন্ট মার্টিন দ্বীপ হোটেল মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এগুলোর কোনোটির পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। ভাড়াও আদায় হয় ইচ্ছেমতো।

মানুষের নিষ্ঠুরতায় প্রবাল দ্বীপটির কান্না ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বলে মন্তব্য করেন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, সেন্ট মার্টিনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে প্রতি মৌসুমে (নভেম্বর-মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস) অন্তত ৯ লাখ পর্যটক সেখানে যাচ্ছেন। এর মধ্যে রাত্রি যাপন করেন প্রায় তিন লাখ। মাথাপিছু ১০ হাজার টাকা খরচ ধরলে তিন লাখ মানুষের বিপরীতে হোটেল, রিসোর্ট, রেস্তোরাঁসহ নানা প্রতিষ্ঠানের ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা হলেও জীববৈচিত্র্য-প্রতিবেশের ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকারও বেশি।

সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলেন, সেন্ট মার্টিনে অতীতে যা হয়েছে, সরকারি আইন লঙ্ঘন করেই হয়েছে। এখন দ্বীপের সুরক্ষায় নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। দ্বীপের ময়লা–আবর্জনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পাশাপাশি হোটেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে এসটিপি (সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) বাস্তবায়ন খুবই জরুরি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বাধার কারণে দ্বীপের ১০ হাজার মানুষ এক যুগ ধরে ঘরবাড়ি সংস্কার করতে পারছেন না বলে জানান দ্বীপের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমেদ। তিনি বলেন, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এই দ্বীপে কোনো ইটভাটা নেই, নেই রড-সিমেন্ট, ঢেউটিন বিক্রির দোকানও। এর মধ্যেও কীভাবে দুই শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট তৈরি হলো? এগুলোর মালিক কারা, এলাকার সবাই জানেন। কিন্তু মুখ খোলার সাহস পান না কেউ।

আব্দুল কুদ্দুস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

%d bloggers like this: