বুধবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৩৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

যে কারণে সিঙ্গাপুরের শিক্ষা ব্যবস্থা বিশ্বসেরা

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৭ মার্চ, ২০২১

শিক্ষা ব্যবস্থার র‍্যাংকিংয়ের বিশ্বের শীর্ষে রয়েছে এশিয়ার ক্ষুদ্র দ্বীপদেশ সিঙ্গাপুর। তাদের রয়েছে সবচেয়ে প্রশংসিত স্কুল পদ্ধতি।

একজন বিতর্কিত কট্টরপন্থী নেতার কারণেই এমনটা সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে এই ভাল যোগ্যতা অর্জনের জন্য শিক্ষার্থীদের চড়া মূল্য দিতে হয়। সিঙ্গাপুরের এই সফলতার পেছনের কয়েকটি কারণ তুলে ধরা হল।
কঠোর পরিশ্রম:
১২ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষার্থী জ্যাকের সাপ্তাহিক কর্মপরিকল্পনা বা সময়সূচী পূর্ণ হয়ে গেছে। এবং বাকি মাস-জুড়ে পরিস্থিতি এমনটাই থাকবে। সোমবার, তার এলার্ম ঘড়ি ভোর ৬টার সময় বাজে। সকাল সাড়ে ৭টায় সে গণিতের জটিল সমস্যা সমাধান নিয়ে পড়ালেখা শুরু করে। মঙ্গলবার, চীনা ভাষা ম্যান্ডারিন অনুশীলনের পর ঘড়ি ধরে ৪৫ মিনিটের বিরতি নেয় জ্যাক। এমন আরেকটি বিরতি সে নেয় শুক্রবারে। সেটাও বিকাল সাড়ে ৪টা থেকে সোয়া পাঁচটা পর্যন্ত। অর্থাৎ ৪৫ মিনিট। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোর মতো জ্যাক শনিবারও গণিত, বিজ্ঞান, ম্যান্ডারিন ভাষা এবং ইংরেজির পাঠগুলো নেয়। তবে এই দিনের রুটিনে সে নিজেকে কিছুটা কম ব্যস্ত রাখে। এমনকি দুই ঘণ্টার বিরতিও নেয়। কিন্তু রবিবারে, সেই একই রুটিন আবার শুরু হয় – যেটা কিনা শেষ হয় রাত ৯টায় জ্যাক বিছানায় যাওয়ার পর।
জ্যাকের মতো সিঙ্গাপুরের এমন হাজার হাজার শিক্ষার্থী তাদের প্রাথমিক স্কুলের ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতির জন্য এরকম কড়া রুটিন অনুযায়ী চলে। এ বিষয়ে কথা হয় জ্যাকের মা এর সঙ্গে। শেরিল আইও’র নামে ৪২ বছর বয়সী এই নারী পেশায় একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। ছেলের এমন রুটিনবাঁধা জীবন নিয়ে তিনি বলেন, “জ্যাক এসব নিয়ে কখনও কোন অভিযোগ করে না, কারণ তার সময়সূচী আসলে অন্যান্য বাচ্চাদের মতো এতোটাও কঠিন নয়। যতবার আমি অন্য অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলি। ততবারই আমার মনে হয়, যে ছেলের জন্য আরও বেশি পাঠ্যবই কিনতে হবে।”
শিক্ষা পদ্ধতি:
সিঙ্গাপুরের রয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত শিক্ষা পদ্ধতি।
প্রভাবশালী পিআইএসএ পরীক্ষা যেখানে কিনা আন্তর্জাতিকভাবে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করা হয়, সেখানে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন বিষয়ক সংস্থা-ওইসিডি ৭৫টি দেশে এই পিআইএসএ পরীক্ষাটি পরিচালনা করে। সেখানে মূলত শিক্ষার্থীদের গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান এবং অধ্যয়নের ক্ষমতা মূল্যায়ন করা হয়। দেশটির এমন ভাল ফলাফলের পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ হল: দেশটির সরকারি আমলাদের প্রত্যেকেই বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে এসেছেন। শিক্ষা নিয়ে তাদের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট। আর সেটা হল: সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের অন্যতম ধনী, সর্বাধিক উন্নত এবং শ্রেষ্ঠ শিক্ষিত দেশগুলির মধ্যে একটিতে পরিণত করা।
ভাল পারিশ্রমিক ও বাজেট:
সিঙ্গাপুর বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষে থাকার আরেকটি কারণ হল, তাদের শিক্ষকরা উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন। এমনটাই মনে করেন গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ ক্লাইভ ডিমক। তাকে সিঙ্গাপুরের জাতীয় শিক্ষা ইন্সটিটিউটের একটি লিডারশীপ প্রোগ্রাম সমন্বয় করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।
শিক্ষা খাতের বেতন দেশটির শিল্প ও আর্থিক খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা স্নাতক শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে আকৃষ্ট করে। শিক্ষকদের প্রতি মাসের বেতন গড়ে ১৮শ ডলার থেকে তেত্রিশশ’ ডলার থেকে শুরু হয়। এছাড়া অতিরিক্ত সময়ের পাশাপাশি পারফর্মেন্সের ওপর তাদের আলাদা বোনাসের ব্যবস্থা রয়েছে। সিঙ্গাপুর তাদের সরকারি বাজেটের ২০% শিক্ষাখাতে ব্যয় করে। বিশেষজ্ঞ ডিমক জানান, “শিক্ষার উন্নয়নে সিঙ্গাপুরের রয়েছে আধুনিক প্রযুক্তি, পরীক্ষাগার এবং চমৎকার সব বই”
দরিদ্রতা ও নিরক্ষর অতীত:
সিঙ্গাপুর এক সময় এশিয়ার দরিদ্রতর দেশগুলোর একটি ছিল। ১৯৬৫ সালে তারা যখন মালয়েশিয়া থেকে স্বাধীন হয়। তখন কেবলমাত্র অভিজাতদের শিক্ষার সুযোগ ছিল। এ কারণে দেশটির মোট জনসংখ্যার অর্ধেক ছিল নিরক্ষর। সিঙ্গাপুরের সরকারি পরিসংখ্যানে এমন তথ্য পাওয়া গেছে।সিঙ্গাপুরে তেল বা গ্যাসের মতো কোন প্রাকৃতিক সম্পদও নেই। তাই দেশটি তাদের জনসংখ্যার ওপর বিনিয়োগ করে। দেশটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৫৮ লাখ। যাদের প্রত্যেকেই জনসম্পদ। সিঙ্গাপুরে স্বৈরাচারী সরকার থাকায় সেখানকার কিছু মৌলিক স্বাধীনতা দমন হলেও সরকারের প্রতি আনুগত্য সামাজিক নিরাপত্তা এবং সমৃদ্ধির নিশ্চয়তা দিয়েছে। তাদের এই দর্শন শিক্ষা পদ্ধতি উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

 

অভিজাত স্কুল:
সিঙ্গাপুর-বাসীর মধ্যে একটি অনুভূতি বা চিন্তাধারা রয়েছে যেটা কিনা সেখানকার মানুষের মানসিকতার ওপর অনেক বড় প্রভাব রাখে। এই অনুভূতিটি “কিয়াসু” নামে পরিচিত। যেটা বেশিরভাগ মানুষ পাশ কাটিয়ে যায়। সাবেক শিক্ষক ডন ফুং জানান, “কিয়াসু নামের এই উদ্বেগ শিশুদের ওপর কঠিন প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে যাদের পরিবার এই ভয়ে থাকে যে তাদের সন্তান ভাল ফল অর্জন করতে ব্যর্থ হবে।”
সেরা স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর জন্য, সিঙ্গাপুরের শিশুরা অনেক আগে থেকেই তাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।যেটা প্রাইমারি স্কুল লিভিং এক্সামিনেশন বা পিএসএলই নামে পরিচিত। এই পরীক্ষার ফল নির্ধারণ করে যে তারা কোন ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়বে।”এবং এই প্রস্তুতি তাদের দুই বছর বয়স থেকেই শুরু হয়” বলে জানান ফুং। এটি একটি প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি। এজন্য সিঙ্গাপুরের বেশিরভাগ শিশুদের প্রাইভেট শিক্ষক আছে। জ্যাকের মা শেরিল আইও তার ছেলের প্রাইভেট পড়ানোর পেছনে প্রতি মাসে ৭শ ডলারের মতো খরচ করে থাকেন। তিনি চেয়েছিলেন তার ছেলে অভিজাত স্কুলে পড়বে। সেজন্য জ্যাক কঠিন রুটিন মেনে চলার পাশাপাশি অতিরিক্ত ক্লাস করে। তবে অভিজাত স্কুলে ভর্তি হতে পিএসএলই পরীক্ষায় যে নম্বরের প্রয়োজন হয় সেটা অর্জন করতে পারেনি জ্যাক।
শিক্ষা শিল্প ও এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের জন্য পিএসএলই পরীক্ষা কতোটা কঠিন সেটার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার প্রাইভেট টিউশন শিল্প দেখে। আসলে শিক্ষা, সিঙ্গাপুরের একটি লাভজনক শিল্প। স্থানীয় পত্রিকা স্ট্রেইট টাইমসের মতে যার মূল্যমান প্রায় ৭৫ কোটি ডলার। তবে দেশটির সম্পূরক পাঠের কার্যকারিতা নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। ডন ফুং বলেন, “আমরা কেন এই পদ্ধতিতে সহজ করছিনা। কেন আমাদের বাচ্চারা তাদের বয়সের জন্য উপযুক্ত পরীক্ষা দিচ্ছে না?”ফুং যখন মা হয়েছিলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি এই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তে হোম স্কুলিং বা বাড়ির ভেতরে শিক্ষাকে বেছে নেবেন।”
“আমি বিশ্বাস করি, যে শিক্ষা পদ্ধতি আমাদেরকে অসুখী করে তুলছে, সেটার অংশ হওয়া ভুল। যে শিক্ষা পদ্ধতি ইতিবাচক ফলাফল দেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না, সেখানে শিশুদের ঠেলে দেয়া নিষ্ঠুরতা।” এমনই জানান তিন সন্তানের মা ফুং। ফুংয়ের মতো অন্যান্য যেসব পরিবার তাদের শিশুদের জন্য হোম স্কুলিং বেছে নিতে চান তাদের জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুযায়ী পিএসএই তে নিতে হবে। এবং তাদের প্রাপ্ত ফলাফল জাতীয় গড় নম্বরের নিচে হতে পারবেনা।
উদ্বেগ এবং আত্মহত্যা:
জ্যাকের মা শেরিল আইও দুশ্চিন্তা করছেন যে, পিএসএলই-তে প্রয়োজনীয় নম্বর না পাওয়ায় তার ছেলের মর্যাদাহানি হবে।
“জ্যাক অনেক দু:খ পেয়েছে,” জানান মা শেরিল আইও। জ্যাক স্বপ্ন দেখে একজন পাইলট হওয়ার, সেই লক্ষ্য পূরণে সে আবারও ওই পরীক্ষায় বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা সামারিটানস জরিপ অনুযায়ী সবক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের অনুসন্ধানের একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে: সেগুলো হল মানসিক চাপ ও উদ্বেগ। এসব মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত তরুণদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এবং এটি তরুণদের আত্মহত্যার হার বাড়িয়ে দিতে পারে। এটা সিঙ্গাপুরের ১০ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে জরিপে উঠে এসেছে। চলতি বছরের শুরুতে, সরকার স্বীকার করেছে যে এই শিক্ষা পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের উপর চাপ প্রয়োগ করছে।
এ ব্যাপারে দেশটির যোগাযোগমন্ত্রী ওং ইয়ে কুং বলেন, “আমরা নিশ্চয়তা দেব যে এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রতি কঠোর হতে নয় বরং তাদের সহায়তা দিতে তৈরি করা হয়েছে।”
এক্ষেত্রে তিনি শিক্ষার্থীদের একে অপরের মানসিক স্বাস্থ্য দেখভালের আহ্বান জানিয়েছেন। সরকার “থিংকিং স্কুলস, লার্নিং নেশন” নামে একটি নীতি প্রণয়ন করেছে। যেটি মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে শেখার প্রক্রিয়ার ওপর বেশি গুরুত্ব দেবে। এই নীতির মূলমন্ত্র “পড়াও কম, শেখাও বেশি”।
এটি শিক্ষার্থীদের নিজেদের মতো কাজ করতে, দলের সঙ্গে কাজ করতে সেইসঙ্গে নিজেদের ব্যাপারে ভাবতে অনুপ্রেরণা দেয় বলে জানান ডিমক।
“ভুলে যাওয়া” শিক্ষার্থীরা:
এখনও, যেসব শিক্ষার্থীরা সেরা নম্বর পায়না তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যাথিউ এ্যাটেনসিও ২০১১ সালে সিঙ্গাপুরে গিয়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের পারফর্মেন্সে শিক্ষকদের ভূমিকার বিষয়ে পড়তে গিয়েছিলেন তিনি। তবে এই শিক্ষা পদ্ধতিতে তিনি বড় কিছু মনে করেন না। কেননা তিনি এই খাতে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য দেখতে পেয়েছেন।
ম্যাথিউ এ্যাটেনসিও বলেন, “কিছু পরিবারের অনেক আয় এবং সম্পদ রয়েছে যেটা দিয়ে তারা প্রাইভেট টিউশনের খরচ দিতে পারে, যেটা কিনা শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ শিক্ষা, সামাজিক ও পেশাগত নেটওয়ার্কের উপর প্রভাব রাখে।
“শিক্ষা ব্যবস্থা এমন হওয়া উচিত যেটা বছরের পর বছর ধরে পিছিয়ে পড়া মানুষের চাহিদাগুলো পূরণ করবে, কেননা শিক্ষা সামাজিক ন্যায়বিচারের ব্যাপার।” মিস্টার এ্যাটেনশিও মনে করেন “সমাজে সব ধরণের খাতের বড় ধরণের অবদান রয়েছে। শিক্ষা কেবল অভিজাতদের সুবিধা দিতে পারে না।”
-বিবিসি বাংলা

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com
%d bloggers like this: