গত কয়েক দশক ধরে, কানাডা নতুনদের আসার জন্য তাদের দ্বার খুলে দেয়ার একটি উন্মুক্ত দেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে।
কেননা কানাডার অভিবাসন নীতিতে জনসংখ্যা বাড়ানো, শ্রমের শূন্যতা পূরণ করা এবং বিশ্বজুড়ে সংঘাত থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার বিষয়গুলো যোগ করা হয়েছে।
তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোয়, প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন যে তিনি কানাডায় অনুমোদন দেয়া অভিবাসীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাতে চান।
এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে ,অভিবাসীদের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক সেবা পাওয়া যাচ্ছে না, জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছে এবং আবাসন বা থাকার জায়গার খরচ আকাশ ছুঁয়েছে।
এর ফলে কানাডার জনগণ ব্যাপক উদ্বেগের মধ্যে আছে।
এই উদারতা থেকে বেরিয়ে আসা কানাডা এবং ট্রুডো উভয়ের জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন।
২০১৫ সালে কানাডিয়ান পরিচয়ের একটি মূল অংশ হিসাবে দেশটি বহুসংস্কৃতিকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল।
ট্রুডো সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য উচ্চাভিলাষী অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রার উপর নির্ভর করেছিল।
সমালোচনার মুখে এবং অনুমোদনের রেটিং কমে যাওয়ায়, প্রধানমন্ত্রী এখন বলছেন যে তার সরকার ভুল করেছে এবং কানাডার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার “স্থিতিশীল” করতে হবে যাতে সরকারি অবকাঠামো চলতে পারে।
বৃহস্পতিবার, ট্রুডো এবং দেশটির অভিবাসনমন্ত্রী মার্ক মিলার তাদের এ যাবতকালের সবচেয়ে কঠোর অভিবাসন কাটব্যাক উপস্থাপন করেছেন।
এই কাটছাঁটের আওতায় ২০২৫ সাল নাগাদ দেশটিতে স্থায়ীভাবে বাস করতে আসা মানুষের হার ২১ শতাংশ কমানোর কথা বলা হয়েছে।
অর্থাৎ এতদিন স্থায়ী বাসিন্দাদের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ থাকলেও ২০২৫ সালে তা তিন লাখ ৯৫ হাজারে নামিয়ে আনা হবে।
এছাড়া কানাডায় অস্থায়ী বসবাসের প্রোগ্রামগুলোয় এই কাটছাঁটের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অস্থায়ী বিদেশি কর্মী এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরাও এই কাটছাঁটের অন্তর্ভুক্ত হবেন।
সরকারের নীতিতে এই পরিবর্তনকে “জনসংখ্যা বৃদ্ধি থামানোর” প্রয়াসে হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
যার আওতায় দেশটিতে অভিবাসনের অনুমোদনের হার অনেকটাই কমিয়ে আনা হবে। যার ফলে আগামী দুই বছরের মধ্যে কানাডায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি থামানো যাবে।
প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেছেন, বিভিন্ন রাজ্যে সরকারের স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি এবং আবাসন শক্তিশালী করার জন্য এই সময় প্রয়োজন।
তবে কানাডার অভিবাসন নীতিতে এমন পরিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে, জাস্টিন ট্রুডো একটি কথাই বলছেন। তা হল: “কানাডিয়ানরা তাদের অভিবাসন ব্যবস্থা নিয়ে গর্বিত”।
“কানাডার অভিবাসন আমাদের অর্থনীতিকে বিশ্বের দরবারে ঈর্ষান্বিত স্থানে নিয়ে গিয়েছে,” তিনি বলেন। “এভাবে আমরা শক্তিশালী, বৈচিত্র্যময় সম্প্রদায় গড়ে তুলতে পেরেছি।”
তবে ট্রুডো স্বীকার করেছেন যে তার সরকার, কোভিড-১৯ মহামারীর পরে শ্রমের যে ঘাটতি দেখা গিয়েছিল তা মেটাতে রেকর্ড সংখ্যক অস্থায়ী বাসিন্দাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়। এ কারণে অভিবাসনে “ভারসাম্য রক্ষা করা যায়নি”।
এ কারণে এখন কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থাকে “স্থিতিশীল” করা প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে।
কানাডায় অভিবাসনকে ঘিরে জনসমর্থন কমে আসার পরপরই ট্রুডোর এই ঘোষণা আসে।
কানাডায় ১৯৭৭ সাল থেকে অভিবাসনের প্রতি কানাডিয়ানদের মনোভাব কেমন যা পর্যবেক্ষণ করে আসছে এনভায়রনিক্স ইন্সটিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
সবশেষ চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের জরিপ থেকে জানা যায়, গত ২৫ বছরে প্রথমবারের মতো, ৫৮ শতাংশ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বলেছে যে দেশটিতে অভিবাসনের সংখ্যা এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির মতে, মানুষের মনোভাবে এই পরিবর্তনের প্রাথমিক কারণ হল সেখানকার আবাসন সংকট।
অভিবাসনের তুলনায় আবাসন সীমিত হওয়ায় স্থানীয়রা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।
একই সময়ে, কানাডার বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় দশমিক পাঁচ শতাংশে এবং তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ শতাংশে।
তবে অর্থনীতি, অতিরিক্ত জনসংখ্যা এবং অভিবাসন ব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে সেটাও মানুষের মনোভাব পরিবর্তনের বড় কারণ।
ট্রুডো এবং তার সরকার জনসেবা বা আবাসন নির্মাণ না করেই অভিবাসনের হার বাড়ানোয় সমালোচিত হয়েছে এবং অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে কানাডার ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা আবাসন এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো জনসেবা খাতগুলোর উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে।
অক্টোবরের একটি নিউজলেটারে, অ্যাবাকাস ডেটা নামক সংস্থার জরিপ পরিচালনাকারী (পোলস্টার) ডেভিড কোলেটো বলেছেন,
“আমার মনে হয় অভিবাসনের ব্যাপারে যে ঐকমত্য ছিল তা এখন ভেঙ্গে গিয়েছে এবং আশা করা হচ্ছে, আগামী বছরে এটি ফেডারেল এবং প্রাদেশিক রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটি হবে”।
কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর কানাডার জনসংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে ৯৭ ভাগ কারণ ছিল অভিবাসন।
২০১৫ সালে জাস্টিন ট্রুডো নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে, তার সরকার বার্ষিক স্থায়ী বাসিন্দার লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৭২ হাজার থেকে বাড়িয়ে চার লাখ ৮৫ হাজারে উন্নীত করে।
তবে কোভিড -১৯ মহামারীর পরে ২০২১ সালে অভিবাসনের হার সবচেয়ে বেশি বাড়তে দেখা গিয়েছে।
কানাডা মূলত অভিবাসীদের স্বাগত জানিয়ে আসছে। তথ্য অনুযায়ী, শরণার্থী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে কানাডায় বিশ্বে সবচেয়ে শীর্ষে রয়েছে। দেশটি গত ৫০ বছরে নতুনদের মূল্য দেয়ার একটি খ্যাতি অর্জন করেছে।
১৯৮৮ সালে পাস হওয়া কানাডিয়ান বহুসংস্কৃতি আইন, কানাডার পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়। এর বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংবিধানেও সংরক্ষিত।
টরন্টো ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাইকেল ডনেলি বিবিসিকে বলেছেন, “১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক থেকে বা তার পরে, কানাডিয়ান মনোভাব ব্যাপকভাবে অভিবাসনের পক্ষে ছিল।”
২০১৯ সালে, পিউ রিসার্চ রিপোর্ট অনুযায়ী ১০টি শীর্ষ অভিবাসন গন্তব্য দেশের মধ্যে কানাডা অভিবাসন ইস্যুতে সবচেয়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছিল।
অধ্যাপক ডনেলি বলেছেন যে, অভিবাসীরা কানাডার ভোটারদের একটি বড় অংশ। যার কারণে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অভিবাসন বিরোধী অবস্থান নিতে পারে না।
অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনের কারণে অন্যান্য দেশগুলো যেসব সংকটের মুখে পড়েছিল, সেক্ষেত্রে কানাডাও খুব কমই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।
এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে কানাডা ভৌগলিক অবস্থান। কারণ দেশটি তিনটি মহাসাগর এবং দক্ষিণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা বেষ্টিত।
দেশটির অভিবাসন ব্যবস্থা বেশ উন্মুক্ত এবং সুনিয়ন্ত্রিত বলে মনে করে সেখানকার মানুষ।
কিন্তু এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গত কয়েক বছরে অনেকটাই বদলে গিয়েছে, অধ্যাপক ডনেলি তাই মনে করেন।
এর একটি কারণ হল কানাডায় অস্থায়ী বাসিন্দাদের সংখ্যা প্রচুর বেড়ে যাওয়া।
কানাডিয়ান ব্যুরো ফর ইন্টারন্যাশনাল এডুকেশন অনুসারে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যা প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে, সরকারি তথ্য অনুযায়ী কানাডায় অস্থায়ী বিদেশি কর্মীর সংখ্যা গত পাঁচ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।
অভিবাসন নিয়ে কানাডিয়ানদের নেতিবাচক ধারণার আরেকটি বড় কারণ, তারা মনে করে কানাডার অভিবাসন ব্যবস্থা তার সততার জায়গা হারিয়েছে।
অধ্যাপক ডনেলির মতে, এর পেছনে কানাডিয়ান সরকারের ভুল অনুমান আংশিকভাবে দায়ী।
২০১৬ সালে কানাডা মেক্সিকান পর্যটকদের জন্য ভিসা থাকার বাধ্যবাধকতা তুলে দেয়ার পর কানাডায় শরণার্থী আশ্রয়ের আবেদনের সংখ্যা রাতারাতি বেড়ে যায়।
পরে চলতি বছরের শুরুতে মেক্সিকানদের জন্য ভিসা থাকার বিধান পুনরায় আরোপ করতে বাধ্য হয় দেশটি।
কানাডার গণমাধ্যমও জানিয়েছে যে কিছু আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী তাদের অস্থায়ী ভিসা ব্যবহার করে দেশে স্থায়ী আশ্রয় দাবি করছে – এই প্রবণতাকে মন্ত্রী মিলার “আশংকাজনক” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
অধ্যাপক ডনেলি বলেন, এই ঘটনাগুলোর কারণে “মানুষ ভাবতে বাধ্য হয়েছে যে অভিবাসন প্রবাহের ওপর সরকারের আর নিয়ন্ত্রণ নেই”।
দেশটিতে অভিবাসনের হার বেড়ে যাওয়ায় তীব্র আবাসন সংকট দেখা দেয় যার প্রভাব পড়ে সারাদেশের কানাডিয়ানদের ওপর।
চাহিদার তুলনায় থাকার মতো বাসাবাড়ি কম থাকায় বাড়ি ভাড়া করতে গেলে বা কিনতে গেলে আগের চাইতে অনেক বেশি পয়সা গুনতে হচ্ছে।
এ কারণে মানুষের মনে অভিবাসন নিয়ে উদ্বেগ বাড়তেই থাকে।
“কানাডিয়ানরা প্রচুর সংখ্যক নতুন অভিবাসীদের আসতে দেখছে। এ কারণে আবাসনের ঘাটতি দেখতে যাচ্ছে এবং এটাই সংকটের প্রধান কারণ,” তিনি বলেন।
অধ্যাপক ডনেলি উল্লেখ করেন, অভিবাসন নিয়ে কানাডা অনেক বর্ণবাদী বক্তব্যের মুখোমুখি হলেও, যেভাবে ইউরোপে বা প্রতিবেশী যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন নিয়ে মনোভাব তৈরি হয়েছে, শুরুর দিকে কানাডায় পরিবর্তনের পেছনে সেরকম বিষয় ছিল না।
বরং অভিবাসন প্রক্রিয়ার কার্যকারিতা নিয়ে কানাডার মানুষের চাওয়াই সেখানে গুরুত্ব পেয়েছে
“ট্রুডো সরকার স্পষ্টভাবে একটাই বার্তা দেয়ার চেষ্টা করছেন। আর সেটা হল ‘সব আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে’।
তবে অভিবাসন লক্ষ্যমাত্রা কমানোর বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা করেছে মাইগ্রেন্ট রাইটস নেটওয়ার্কের মতো অভিবাসন বিষয়ক অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো।
সংস্থাটি ট্রুডো এবং মিলারের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখে জানিয়েছে যে কানাডার সংকটের জন্য অভিবাসীদের অন্যায়ভাবে দায়ী করা হচ্ছে।
“কানাডার আবাসন সংকট, চাকরির অভাব, বা অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা বা অন্যান্য পাবলিক পরিষেবার জন্য অভিবাসীরা দায়ী নয়,” তারা বলেন।
তাদের মতে এই সংকটের পেছনে মূল কারণ “ফেডারেল এবং প্রাদেশিক নীতির কারণে দশকের পর দশক সরকারি পরিষেবাগুলোয় যথেষ্ট তহবিল দেয়া হয়নি এবং বেসরকারিকরণ করা হয়েছে”।