শনিবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন

মেলবোর্ন থেকে শায়লা ‘শনিবার সকালে’

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৩

ঠিক তিন মাস আগে আগস্টের মাঝামাঝি শীতকাল, শনিবার সকাল, বরাবরের মতোই মেঘে ঢাকা কুয়াশা ঘেরা চিরচেনা মেলবোর্ন। এহেন ছুটির দিনে সকালে ঘুম ফেলে ওঠার কোনো মানে নেই তারপরেও উঠতে হলো, সিটিতে একটা সেমিনার আছে, আগেই নিবন্ধন করা ছিল যাবো বলে। ইনভাইটেশন মেইলে লেখা ছিল পেইড পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে তাই ঝটপট তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়েই বের হলাম। সকাল ৮টা প্রায়… কুয়াশা ভেজা অদ্ভুত সুন্দর সুনসান চারপাশ, শুধু থেকে থেকে কিছু গাড়ি ছুটছে যার যার গন্তব্যে…

পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট আগেই, পার্কিং করে মেইলের ঠিকানা অনুযায়ী ইমারত নম্বর এবং গেট নম্বর খুঁজছি… কিছুতেই পাই না। একসঙ্গে অনেকগুলো জায়ান্ট ইমারতে, কোনটা যে! শহরের এদিকটা আসা হয়নি আগে। আমার নার্ভাস লাগা শুরু হলো কারণ হাতের দশ মিনিট শেষ, এহেন শীতের সকালেও ঘামতে শুরু করলাম, দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে হাঁটছি, অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ইমারত পেলাম, কিছুটা স্বস্তি কিন্তু গেট নম্বর ১ দেখছি, আমার যেতে হবে ১৪ নম্বর! সময় দেখলাম, সেমিনার শুরু হয়ে গেছে, হৃদস্পন্দন অতিরিক্ত… নিজের ওপর নিজেই কিঞ্চিৎ বিরক্ত, চারপাশে কাউকেই দেখছি না যে জিজ্ঞাসা করবো।

jagonews24

ছুটির দিনের সকাল, প্রয়োজন ছাড়া কেউ নেই। অগ্যতা ১ নম্বর গেটের দিকে এগোতে থাকলাম, একটু পরে দেখি ২ নম্বর গেট, সেখানে একজন ইউনিফর্ম পরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার নাম ও অর্গানাইজেশনের নাম দেখে নিশ্চিত হলাম সিকিউরিটি লোক। উত্তাল সমুদ্রে ডিঙি নৌকা পেয়ে গেছি এমন আশ্বস্ত হলাম যেন , শুভ সকাল বলে জিজ্ঞাসা করলাম ‘তুমি কী জানো গেট নম্বর ১৪ কোনদিকে?’

তিনি স্মিত হাসি দিয়ে বললেন ‘শুভ সকাল, অবশ্যই জানি…
চলেন দেখিয়ে দেই…’

আমি বললাম, ‘তোমার কষ্ট করে আসতে হবে না, আমাকে শুধু বলো কোনদিকে?’

বললো ‘কোন সমস্যা নেই, তোমাকে বললেও বুঝে উঠবে না, যদি এখানটা আগে না এসে থাকো, ১৪ নম্বর গেট একটু দূরেই কিন্তু আমি যেহেতু এখানে কাজ করি সুতরাং শর্টকাট ওয়েটা জানি।’

আমি কথা না বাড়িয়ে ‘ধন্যবাদ, আচ্ছা চল’ বলে তাকে অনুসরণ করলাম,
হাঁটছি… তো হাঁটছি মাঝে টুকটাক ভদ্রতার কিছু কথা যা অবশ্যই আবহাওয়া নিয়ে বা কোন লোকাল কোন ফুটি খেলা অথবা কে কোন দেশ থেকে এসেছি।

jagonews24

প্রায় মিনিট তিনেক হাঁটার পর কিছু মানুষজন চোখে পড়লো, গেট নম্বর ১৩ দেখলাম… সেখানেও কোনো একটা সেমিনার হচ্ছে। বুঝলাম কাছাকাছি চলে এসেছি সাহায্যকারী ব্যক্তিকে বললাম তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি আসলেই এত তাড়াতাড়ি খুঁজে পেতাম না, অলরেডি ১৩ মিনিট লেট, আমি একা হলে আরও ১৩ মিনিট লাগতো।’

সে আবারো হেসে বললো, ‘নো ওরিস,এটা আমার কাজ, আমি তোমার জন্য বাড়তি কিছুই করিনি, কিন্তু তুমি আমার কিছু ধারণা বদলে দিয়েছো, সেজন্য ধন্যবাদ।’

জিজ্ঞাসা করলাম ‘কেমন?’

‘মাফ করো, বলতে চাচ্ছি না, তোমার সেমিনার কতক্ষণ? দুপুর পর্যন্ত গড়াবে? নাকি আগেই শেষ?’

কেন?

উত্তর দিলো ‘এই যে বাম পাশে সিঁড়ি দেখছো তার পেছনেই রেস্টরুম, তারপরেই প্রেয়ার রুম আছে, তোমরা তো দুপুরে প্রে করো, তাই দেখিয়ে দিলাম যেন তোমার খুঁজে পেতে কষ্ট না হয়।’

jagonews24

আমি এবার চমকে গেলাম অন্তরে, অন্তর চমকে দিতে খুব কম মানুষ পারে, সবাই খুব ওস্তাদ অন্তরে যন্ত্রণা দিতে। এই প্রথম ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে তাকালাম, কোন দেশ থেকে এসেছেন আগেই শুনেছি কিন্তু চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘নাহ, সেমিনার মোটে দুই ঘণ্টা যার ১৭ মিনিট এরই মধ্যে পেরিয়ে গেছে।
কিন্তু তুমি বুঝলে কি করে আমি প্রে করি?’

বললো ‘এই যে তোমার মাথার চুল কভার করা, মাথার চুল কভার করা যত মুসলিম লেডি আমি কর্মক্ষেত্রে দেখেছি তাদের সবাইকে আমি প্রে করতে দেখেছি।’

দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে বললাম তুমিও কিন্তু আমার ধারণা বদলে দিলে আজ, সেজন্য তোমাকে ও তোমার পরিবারের জন্য শুভেচ্ছা।

সেও সুন্দর করে হাসলো, হাতের তর্জনী উঠিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিক দেখিয়ে বললো ‘ওই যে তোমার গেট নম্বর ১৪, তোমার জন্য আজ আমার সকালের শুরুটা সুন্দর হলো, তোমার উইকেন্ড ভালো কাটুক’।

দেখিয়ে দেওয়া দিকে তাকিয়ে যেই অর্গানাজেশনের সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে এসেছি তাদের ইউনিফর্ম পরা বেশ কিছু মানুষজন দেখতে পেলাম। আবারো হেসে বললাম, ‘তোমাকে ধন্যবাদ দিলে কম হয়ে যাবে, তুমি ভালো থেকো, তোমার সাথে আর কখনো দেখা হবে কি না জানি না তবে যে শিষ্টাচার তুমি আমাকে দেখালে সেজন্য আমি তোমাকে মনে রাখবো। তোমার উইকেন্ডও আনন্দময় হোক,’ বলে এগিয়ে গেলাম ১৪ নম্বর গেটের দিকে এবং মুহূর্তেই বুঝে গেলাম কেন আজ আগে বেরিয়েও আমার দেরী হলো, স্রষ্টা এভাবেই জীবনের ঝুড়িতে ছোট ছোট প্রাপ্তি ও অভিজ্ঞতা যোগ করেন, আমরা অনেকেই বুঝি আবার অনেকেই বুঝি না।

পুরো অস্ট্রেলিয়াই এমন, শত’র বেশী সংখ্যক দেশের মানুষের চমৎকার সহাবস্থান যারা একে অন্যকে সম্মান করে, আর করে বলেই সম্মান ফেরত পায়। কর্মক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম না, লাগাতার দেশ ক্রিকেটে হারলে প্রতিবেশী দেশের কলিগদের খোঁচা মাঝে মধ্যে শুনতে হয় কিন্তু হেসে পাল্টা সঠিক উত্তরও আমরা দিতে জানি কিন্তু দেশকে কখনো ছোট করি না।

jagonews24

হ্যাঁ, এখানেও কালে ভদ্রে কখনো কানে আসে অমুক স্টেট্ এ লেবু তে লেবু তে মারামারি, তমুকে চিঙ্কু চিঙ্কু তে রেশারেশি, বা পাকি তে পাকি তে গ্যাঞ্জাম, আর পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছের চুলোচুলি তো অহরহ শোনা যায়।

কিন্তু আমি কখনোই শুনি নাই এক জাতির সাথে অন্য জাতির কোনো প্রকট ঝামেলা, অন্তত মেলবোর্ন এ। অতিরিক্ত শীতল আবহাওয়া কী কোনো পরিপূরক ভূমিকা রাখে এই সহনশীলতায়? আমার তো তা মনে হয় না।

অপরের প্রতি সহনশীলতা ও সম্মান প্রদর্শন পুরো অস্ট্রেলিয়ার সব স্টেটজুড়েই বিরাজমান। কারণ প্রতিটা মানুষ এখানে তার দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে, স্বজ্ঞানে কেউই চায় না সেই ধারা কলুষিত হোক।

দু’চারটে অনিয়ম, অপরিপক্কতা তো থাকবেই, কারণ নানা দেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সহাবস্থান। সেটুকু সন্তর্পণে পেছনে ফেলে আমরা এগোই বলেই না সবাই মিলে সহনশীল অস্ট্রেলিয়া বেশ পাকাপোক্তভাবেই দাঁড়িয়ে।

সম্মান, অধিকার, ভালোবাসা আদায় করতে হয় নিজের আচরণ যোগ্যতা দিয়ে, অন্যের আচরণকে হেয় বা ক্ষুণ্ন করে নয়।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com
%d bloggers like this: