শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৪ অপরাহ্ন

মেঘের রাজ্যে বিলাসবহুল এক হোটেল, রক্ষা করবে জীববৈচিত্র্য

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩

ইকুয়েডরের চকো ক্লাউড ফরেস্ট বিখ্যাত তার বৈচিত্র্যময় বন্য প্রাণী আর উদ্ভিদের জন্য। উঁচু উঁচু সব গাছপালার ওপরে ঝুলে থাকা মেঘেদের জন্য এ ধরনের জঙ্গল ‘মেঘ অরণ্য’ বা ক্লাউড ফরেস্ট নাম পায়। ক্লাউড ফরেস্টে প্রচুর বৃষ্টিপাতও হয়। চকো ক্লাউড ফরেস্ট সম্প্রতি আরেকটি কারণে মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছে। সেটি বনের মধ্যে তৈরি করা বিলাসবহুল এক হোটেল।

চকো ক্লাউড ফরেস্টের মাত্র ২ শতাংশ প্রাকৃতিক বন অবশিষ্ট আছে এখন। এমন পরিস্থিতিতে মাশপি লজ বিলাসবহুল কিন্তু জঙ্গল ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে উদ্ভাবনী এক পদক্ষেপ নিয়েছে। রোমাঞ্চপ্রেমী অতিথিদের জঙ্গল অভিযানে এখানকার বন্য প্রাণী সম্পর্কে জানার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ইকুয়েডরের রাজধানী কুইটো থেকে হোটেলটির দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের আশপাশে।

সকালের সূর্যের আলো যখন ঘন কুয়াশার পর্দায় ঢাকা চকো ক্লাউড ফরেস্টের গাছপালার মাঝখান দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে বের হচ্ছে, তখন মাশপি লজের একজন পর্যটক হয়তো গাছের শাখায় শাখায় উড়ে বেড়ানো রঙিন প্রজাপতি দেখছেন মুগ্ধ চোখে। এটা তিনি করছেন তাঁর শয্যায় শরীর এলিয়ে দিয়ে। বাইরের জগৎ এবং তাঁর মধ্যে ব্যবধান বলতে একটি কাচের দেয়াল। ‘ইকো-ট্যুরিজম’ নামের যে শব্দটির সঙ্গে আমরা পরিচিত, ইকুয়েডরের জঙ্গলের মাঝখানে অবস্থিত মাশপি লজের চেয়ে এর বড় উদাহরণ আর কিছু হতে পারে না।

জঙ্গলের মধ্যে অনেক উঁচু কোনো দালান নয় এটি। বিশাল সব কাচের জানালাসহ এর নকশা এভাবে করা হয়েছে, যেন জঙ্গল ও লজটির মধ্যে একটি নিবিড় সম্পর্ক থাকে।

হোটেলটি হয়তো ধনী পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। তবে এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে স্থানীয় অধিবাসীদের জীবন। মাশপির শতকরা ৮০ শতাংশ কর্মচারী আশপাশের অঞ্চলের বাসিন্দা। পর্যটনের বিকাশ মানেই এখনকার মানুষের বেঁচে থাকার একটি অবলম্বন তৈরি হওয়া। এর বিকল্প পেশা তাঁদের কাছে বনের গাছ কাটা ও খনি থেকে স্বর্ণ আহরণ। আর এগুলো করেই এখানকার মূল প্রাকৃতিক অরণ্যের কেবল ২ শতাংশ অবশিষ্ট আছে আর। এসব তথ্য জানা যায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

এই হতাশাজনক পরিসংখ্যানই কুইটোর সাবেক মেয়র রোক সেভিয়াকে ২০০১ সালে চকো ক্লাউড ফরেস্টের এক টুকরো জমি কিনতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এটা তিনি করেন শুধু সংরক্ষণের স্বার্থেই। তারপর তিনি ক্রমাগত জমি কিনতে থাকেন। এর ফলাফল ব্যক্তি মালিকানাধীন একটি সংরক্ষিত বন, ৬ হাজার ১৭৮ একরের মাশপি রিজার্ভ।

একটি গাছও কাটা পড়েনি গোটা লজটি বানাতে। তবে এটি তৈরির উপকরণ সংগ্রহ করা হয়েছে আশপাশের এলাকা থেকে, যেন গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসারণ কম হয়।

গত এক দশকে মাশপি রিজার্ভের গবেষণায় ১৬টি নতুন প্রজাতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যা চকো ক্লাউড ফরেস্ট সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে।

লজের রেস্তোরাঁটিতে ব্যবহার করা বেশির ভাগ উপাদানের উৎস ৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকা। এটি ১৫টি স্থানীয় পরিবারের জীবিকা নির্বাহে এবং নারী উদ্যোক্তাদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে সাহায্য করে।

অরণ্যটি রক্ষায় এবং টেকসই পর্যটনের শক্তি ব্যবহার করে স্থানীয় সম্প্রদায়কে দারিদ্র্য থেকে বের করে আনার মিশন নিয়ে কাজ শুরু করা সেভিয়া একটি পুরোনো করাতকলের জায়গায় মাশপি লজ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ‘আমি দেখতে চাই যে মাশপির অতিথিরা এই বিস্ময়কর বন সংরক্ষণের উৎসাহী একজন মানুষ হিসেবে তাঁদের বাড়িতে ফিরে যাবেন।’ তিনি বলেন। সেভিয়া আশা করেন, এখানকার জঙ্গল ভ্রমণে যে অভিজ্ঞতা হয়, তা-ই অতিথিদের অরণ্যের প্রতি ভালোবাসার জন্ম নেয়।

মাশপির একজন আবাসিক জীববিজ্ঞানীর নেতৃত্বে চকো ক্লাউড ফরেস্ট সম্পর্কে পরিচিতিমূলক কিছু আলোচনার পর পর্যটকদের একটি দলের সঙ্গে হয়তো আপনি মাশপির প্রধান আকর্ষণ ‘ড্রাগনফ্লাই ক্যানোপি গন্দোলা’য় চেপে বসবেন। এটি আসলে জঙ্গলের ওপর দিয়ে দুই কিলোমিটারের একটি কেব্‌ল কার রাইড।

ছাদ ছাড়া ধাতুর তৈরি কেব্‌ল কারটিতে ভ্রমণের সময় উঁচু উঁচু গাছগুলোর মাঝখান দিয়ে যাবেন। চাইলেই কোনো গাছের পাতা ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। হয়তো বৃক্ষ শিখরে উঠে পড়া কোনো কাঠবিড়ালির দেখা মিলে যাবে। পাশ দিয়ে রঙিন ডানা মেলে উড়ে যাবে কোনো পাখি। ওপর থেকে নিচের অরণ্যও অন্য এক সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেবে আপনার চোখে। এত ওপরের আশ্চর্য শান্ত পরিবেশও আনন্দিত করবে আপনাকে।

এই যাত্রাপথে সঙ্গে থাকা গাইড হয়তো আপনাকে সংরক্ষণে মাশপি লজের নেওয়া নানা পদক্ষেপের বিষয় জানাবে। এখানকার বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষার উদ্দেশ্য নিয়েই এর পুরো নকশা করা হয়েছে। ‘বনের রক্ষক’ নামে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সৌরশক্তিচালিত ১০টি অডিও রেকর্ডার বসিয়েছে মাশপি লজ কর্তৃপক্ষ সংরক্ষিত বনটির বিভিন্ন অংশে। এটি করাতের শব্দ শনাক্ত করতে এবং এই অবৈধ কার্যকলাপের বিষয়ে পার্কের রেঞ্জারদের সতর্ক করতে সক্ষম।

গাইড জঙ্গল2

প্রাণীদের গতিবিধি ও চলাফেরা পরীক্ষার জন্য ক্যামেরা ট্র্যাপও বসানো হয়েছে জঙ্গলের নানা অংশে। লজের পাশের একটি ছোট পরীক্ষাগারে মাশপিস রিসার্চ সেন্টারের গবেষকেরা ক্যামেরাবন্দী হওয়া ছবিগুলো বিশ্লেষণ করেন। সংরক্ষিত বনটিতে ১৬টি নতুন প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মাশপি ম্যাগনোলিয়া নামের একটি উদ্ভিদ। এর কাণ্ডে বেড়ে ওঠে অর্কিডের মতো কয়েক ডজন পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ।

‘এ কারণেই এখানে গবেষণা করা এত গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অনেক নতুন প্রজাতি আবিষ্কারের অপেক্ষায় আছে।’ বলেন মাশপির আবাসিক জীববিজ্ঞানী চিয়ারা করেরা। তিনি সংরক্ষিত এলাকাটির বন্য প্রাণী নিয়ে গবেষণা করছেন এবং লজের ধারেই বিজ্ঞানের কাছে নতুন এক জাতের অর্কিড আবিষ্কার করেছেন।

গাইড জঙ্গল

মেঘ-অরণ্যের বন্য প্রাণী, গাছপালা ও সংরক্ষণের প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানতে পর্যটকদের জঙ্গলের গভীরে নিয়ে যাওয়ার কেবল একটি পদ্ধতি ক্যানোপি গন্দোলা। এ ছাড়া লজের ‘লাইফ সেন্টারে’ প্রজাপতি এবং এদের আচরণ সম্পর্কে জানানো হয়। আবার দুজন উঠতে পারেন গন্দোলার এমন একটি পা-চালিত সংস্করণ স্কাই বাইকে চেপেও জঙ্গলের অন্ধি-সন্ধিতে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়। এ সময় হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে খুদে পাখি হামিংবার্ডদের সঙ্গে।

শুধু জঙ্গলে ঘুরে বেড়ালে তো হবে না, খেতেও হবে। লজের ডাইনিং রুমে চারপাশের অরণ্যের দৃশ্য উপভোগ করতে করতে তিন বেলা খেতে পারবেন। মেন্যু ঋতুভেদে বদলায় এবং জঙ্গল থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন উদ্ভিদ স্বাদে, গন্ধে খাবারগুলোকে করে তুলে অনন্য। যেমন বন্য রসুন এবং চিল্লাগুয়া (ধনেপাতার মতো) ব্যবহার করা হয় এখানকার নানা পদের খাবারে।

গাইড জঙ্গল1

হয়তো সবজিতে ভরপুর একটি ‘মাউন্টেন স্টু’ ভাজা কাঁচা কলার পাশে প্লেটে ছড়িয়ে দেওয়া হবে আপনার। এতে শোভা বর্ধক হিসেবে থাকবে খাওয়ার উপযোগী ফুল। আখের রসের সঙ্গে মিষ্টি আনারস দিয়েও একটি পদ পরিবেশন করা হতে পারে।

বেশির ভাগ উপাদানই লজের ৫০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা হয়। ইকুয়েডরের নারীদের একটি নিয়মিত আয়ের উৎস তৈরির জন্য নারী উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে কেনা হয় মধু, জ্যামসহ অনেক জিনিসই।

রাতেও গাইড জঙ্গল ভ্রমণে নিয়ে যাবে আপনাকে। হেডল্যাম্পের আলোয় দেখবেন নানা ধরনের গাছ। হয়তো কোনো গাছে দেখা পেয়ে যাবেন একটি অপোসামের (বৃক্ষচর স্তন্যপায়ী প্রাণী), কিংবা চোখ আটকে যাবে বিশ্রামরত কোনো ট্যারান্টুলা মাকড়সায়। সকালে লজের কাছের ৮৫ ফুট উঁচু অবজারভেশন টাওয়ারে দাঁড়ালেই চোখ জুড়িয়ে যাবে, দেখবেন মেঘেরা কীভাবে উঁচু গাছপালার ওপরে আর পাহাড়চূড়ায় জেঁকে বসেছে। তারপর যখন আশ্চর্য এই অরণ্য ও মাশপি লজ থেকে ফিরে আসবেন, আপনার মন চাইবে সেখানে কিংবা এমন কোনো মনোমুগ্ধকর রাজ্যে ফিরে যেতে এখনই তল্পিতল্পা গুছানো শুরু করতে। সূত্র: বিবিসি

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com