মেক্সিকো (Mexico), আনুষ্ঠানিকভাবে মেক্সিকান যুক্তরাষ্ট্র (Estados Unidos Mexicanos), উত্তর আমেরিকার একটি বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় দেশ। এটি দক্ষিণে যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে শুরু করে গুয়াতেমালা ও বেলিজ পর্যন্ত বিস্তৃত। মেক্সিকো তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত।
ভূগোল ও জলবায়ু
অবস্থান ও আয়তন
মেক্সিকোর ভৌগোলিক অবস্থান উত্তর আমেরিকার দক্ষিণাংশে। দেশটির উত্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ-পূর্বে গুয়াতেমালা ও বেলিজ, পূর্বে মেক্সিকো উপসাগর এবং পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর অবস্থিত।
এর মোট আয়তন প্রায় ১.৯৭২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার, যা মেক্সিকোকে বিশ্বের ১৩তম বৃহত্তম দেশ হিসেবে স্থান দেয়।
ভূপ্রকৃতি
মেক্সিকোর ভূপ্রকৃতি অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। এখানে রয়েছে:
- উত্তরের মরুভূমি (চিহুয়াহুয়া, সোনোরা)
- মধ্যভাগে উঁচু মালভূমি
- দক্ষিণে পাহাড়ি বনাঞ্চল
- প্রশান্ত মহাসাগর ও ক্যারিবীয় সাগরের সমুদ্রসৈকত
দেশটিতে বেশ কয়েকটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যেমন পোপোকাটেপেটল ও ওরিজাবা।
জলবায়ু
মেক্সিকোর জলবায়ু অঞ্চলভেদে পরিবর্তিত হয়:
- উত্তরে গরম ও শুষ্ক
- মধ্যাঞ্চলে নাতিশীতোষ্ণ
- দক্ষিণে গ্রীষ্মমন্ডলীয়
ইতিহাস
প্রাচীন সভ্যতা
মেক্সিকো হাজার বছর ধরে বিভিন্ন আদিবাসী সভ্যতার আবাসস্থল ছিল। এখানে গড়ে ওঠা উল্লেখযোগ্য সভ্যতাগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- ওলমেক (১৫০০-৪০০ খ্রিস্টপূর্ব) – প্রাচীন মেসোআমেরিকান সভ্যতা
- মায়া (২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ) – জ্যোতির্বিজ্ঞান ও স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত
- অ্যাজটেক (১৩২৫-১৫২১ খ্রিস্টাব্দ) – টেনোচটিটলান (বর্তমান মেক্সিকো সিটি) রাজধানী
স্পেনীয় উপনিবেশ ও স্বাধীনতা
১৫১৯ সালে হার্নান কোর্তেসের নেতৃত্বে স্প্যানিশরা মেক্সিকো দখল করে। ৩০০ বছরের শাসনের পর, ১৮২১ সালে মেক্সিকো স্বাধীনতা অর্জন করে।
মেক্সিকান বিপ্লব (১৯১০-১৯২০)
রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়, যা মেক্সিকোর আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
জনসংখ্যা ও সংস্কৃতি
জনসংখ্যা ও ভাষা
মেক্সিকোর জনসংখ্যা প্রায় ১৩০ মিলিয়ন, যা এটিকে বিশ্বের ১০ম সর্বাধিক জনবহুল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
- সরকারি ভাষা: স্প্যানিশ
- স্বীকৃত আদিবাসী ভাষা: ৬৮টি (নাহুয়াতল, মায়া, মিজটেক ইত্যাদি)
ধর্ম
মেক্সিকোর বেশিরভাগ জনগণ খ্রিস্টান (বিশেষত রোমান ক্যাথলিক)। তবে ধর্মনিরপেক্ষতা সংবিধানে স্বীকৃত।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
মেক্সিকোর সংস্কৃতি স্প্যানিশ উপনিবেশ ও স্থানীয় আদিবাসী ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে গঠিত।
- সঙ্গীত ও নৃত্য: মারিয়াচি, রাঞ্চেরা, বান্দা
- খাদ্য: টাকো, এনচিলাদা, তামালে, গুয়াকামোলে
- উৎসব: “দিও দে লোস মুয়ের্তোস” (Day of the Dead), স্বাধীনতা দিবস (১৬ সেপ্টেম্বর)
অর্থনীতি
মেক্সিকোর অর্থনীতি বিশ্বের ১২তম বৃহত্তম এবং এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান তেল উৎপাদক দেশ।
প্রধান শিল্প ও উৎপাদন
- তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস – বৃহৎ খাত
- গাড়ি শিল্প – জেনারেল মোটরস, ফোর্ড, নিসান
- পর্যটন – কানকুন, লস কাবোস, চিচেন ইটজা
- কৃষি – ভুট্টা, টমেটো, অ্যাভোকাডো, কফি
বাণিজ্য ও সম্পর্ক
মেক্সিকো নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট (NAFTA)-এর সদস্য। এর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও চীন।
পর্যটন
মেক্সিকো পর্যটনের জন্য বিখ্যাত, এখানে রয়েছে প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ, সমুদ্রসৈকত ও ঐতিহাসিক শহর।
প্রধান পর্যটন স্থান
- চিচেন ইটজা – মায়া সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা
- টিউলুম – ক্যারিবীয় সাগরের তীরে অবস্থিত
- কানকুন ও প্লায়া দেল কারমেন – সমুদ্রসৈকত ও বিলাসবহুল রিসোর্ট
- মেক্সিকো সিটি – জাতীয় রাজপ্রাসাদ, ফ্রিদা কাহলোর জাদুঘর
রাজনীতি ও প্রশাসন
সরকার ব্যবস্থা
মেক্সিকো একটি সংবিধানিক প্রজাতন্ত্র, যেখানে রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছর মেয়াদে নির্বাচিত হন।
প্রশাসনিক বিভাগ
দেশটি ৩২টি রাজ্যে বিভক্ত।
প্রধান রাজনৈতিক দল
- Institutional Revolutionary Party (PRI)
- National Action Party (PAN)
- Morena (বর্তমান ক্ষমতাসীন দল)
উপসংহার
মেক্সিকো তার দীর্ঘ ইতিহাস, বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতি, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও শক্তিশালী অর্থনীতির কারণে বিশ্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এটি একদিকে যেমন আধুনিক শহরগুলোর জন্য বিখ্যাত, অন্যদিকে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন সংরক্ষণ করে চলেছে। পর্যটন, শিল্প ও কৃষির সমন্বয়ে মেক্সিকো বিশ্বব্যাপী গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে।
প্রাসঙ্গিক তথ্য সংক্ষেপে:
| বিষয় | তথ্য |
|---|---|
| রাজধানী | মেক্সিকো সিটি |
| জনসংখ্যা | ১৩০+ মিলিয়ন |
| ভাষা | স্প্যানিশ (সরকারি), ৬৮টি আদিবাসী ভাষা |
| ধর্ম | প্রধানত ক্যাথলিক খ্রিস্টান |
| অর্থনীতি | বিশ্বের ১২তম বৃহত্তম, তেল, পর্যটন, কৃষি |
| পর্যটন কেন্দ্র | চিচেন ইটজা, কানকুন, টিউলুম, মেক্সিকো সিটি |
| সরকার ব্যবস্থা | সংবিধানিক প্রজাতন্ত্র |
| মুদ্রা | মেক্সিকান পেসো (MXN) |
মেক্সিকো শুধু ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে নয়, অর্থনৈতিকভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এটি ভবিষ্যতে আরও উন্নতি করবে বলে আশা করা যায।
