মঙ্গলবার, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৩ অপরাহ্ন
Uncategorized

মিলানে ভ্রমণ

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৯ মার্চ, ২০২১

সুইজারল্যান্ড থেকে মিলানের সেন্ট্রাল স্টেশনে এসে যখন ট্রেন থামলো, মনে হলো বড়সর কোনো মিউজিয়ামে ট্রেন ঢুকে পড়েছে। ১৯৩১ সালে উদ্বোধন হওয়া বর্তমান সেন্ট্রাল স্টেশনটি মিলানের প্রধান রেল স্ট্রেশন। মিলান সেন্ট্রাল ইউরোপের বৃহত্তম রেলস্টেশন না হলেও এটি সুবিশাল এবং আড়ম্বরপূর্ণ। মিলানের বিখ্যাত ক্যাথেড্রালটিও এই স্টেশনের দু’টি বারের মধ্যে এটে যাবে, আর এর ছাউনী প্রায় দশটি ফুটবল মাঠের সমান। রেল টার্মিনালটি ১৯৩১ সালে উদ্বোধন করা হয়েছিল, তবে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ১৯০৬ সালে, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে এর নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়। পরবর্তীতে মুসোলিনির অধীনে এর নকশা পুনরায় সংশোধিত হয়ে আর্ট নুওউ, আর্ট ডেকো এবং ফ্যাসিবাদের মিশ্রণে তৈরি হয় এর মূল নকশা। আমেরিকার বিখ্যাত প্রকৌশলী  ফ্রাংক ফ্রয়েড রাইট (Frank Floyd Wright) বলেন, মিলান সেন্ট্রাল তার দেখা ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর ট্রেন স্টেশন।

রেল স্টেশন থেকে মিলানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা মিলান ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে যখন আসলাম, মনে হলো চারপাশে সব হলিউডের নায়িকারা (ইতালির ছেলেদের অতটা পছন্দ হয়নি) র‍্যাম্প শো করছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাদের ব্রান্ড দিয়ে মোড়ানো, হোক সে আশি বছরের বুড়ো মহিলা কিংবা আঠারো বছরের যুবতী মেয়ে। প্রত্যেকে ব্রান্ড ডিজাইনার কালেকশন্সের সাদা অথবা কালো রং এর পোশাক, মুখে মেকাপ, চুল সেট করা, পায়ে বুট অথবা হাই হিল, হাতে ঝুলানো ব্রান্ডেড ব্যাগ। চোখ ধাঁধাঁনো ব্যাপার স্যাপার। আমি অনেক বয়স্ক মহিলার রূপ দেখেই প্রেমে পড়ে গেছি, আর কম বয়সীদের কথা বাদই দিলাম।

মিলান ক্যাথেড্রাল স্কয়ারেই মিলানের বিখ্যাত ল্যান্ডমার্ক ক্যাথেড্রাল ‘ডুমো দ্য মিলানো’ অবস্থিত। এই গির্জাটি ইতালির সবচেয়ে বড় গির্জা, আর ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম এবং বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম গির্জা। এটি নির্মাণ করতে সময় লেগেছিল প্রায় ৬০০ বছর। ৩৫০ ফুট উঁচু এবং ৪০,০০০ হাজার লোকের ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন এই গীর্জার স্থাপত্যশৈলী দেখে মুগ্ধ হতেই হবে। এর স্থাপত্যশৈলী আর নকশা ব্যাখ্যা করা আমার মত স্বল্প জ্ঞানের মানুষের জন্য দুঃসাহসের কাজ, তাই সেদিকে না যাওয়াই ভালো।

মিলান ক্যাথেড্রালের পাশেই রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ফ্যাশন স্ট্রিট। ‘Galleria Vittorio Emanuele II’ হচ্ছে ইতালির সবচেয়ে প্রাচীন শপিং মল। অথচ দেড়শো বছরের এই পুরনো চারটি আর্কেড বিশিষ্ট বিল্ডিং এর উপরে কাচের ছাউনি দিয়ে এই প্রাচীন মলকেই আধুনিক করে বানিয়ে ফেলা হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত ফ্যাশন স্ট্রিট। ভেতরে ঢুকে মাথা খারাপ হওয়ার মত অবস্থা। সোয়ারভস্কি, গুচি, প্রাডা, জরজিও আরমানি, লুই ভ্যুটনসহ বিখ্যাত সব ফ্যশন ব্রান্ডের চোখ ধাঁধাঁনো সব শোরুম। তবে এখান থেকে কিছু কিনতে চাইলে ইউরোপ ট্যুর সেখানেই সমাপ্ত করে ফকির হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। তাই চোখে দেখেই যতটুকু সম্ভব শান্তি নিয়ে নেওয়া।

ক্যাথেড্রাল স্কয়ার জমজমাট এক জায়গা, কেউ সাউন্ড বক্স এনে মিউজিক বাজাচ্ছে, তার সুর ছড়িয়ে আছে পুরো কম্পাউন্ডজুড়ে, কেউ গান করছে, কেউ কেউ স্ট্রিট শো করছে। চারপাশে আছে সব রেস্টুরেন্টের সারি, যেখানে অন্যান্য খাবারের চেয়ে পিজ্জাটাই বেশি। ইতালি গিয়েছি আর আমাদের অতি পছন্দের পিজ্জা খাবোনা তা তো হয়না। অনেক জমজমাট দেখে ঢুকে পড়লাম এক পিজ্জার দোকানে, পিজ্জার স্লাইস সাথে আনলিমিটেড ড্রিংক্স, বাহ আর কী দরকার। খেয়ে বুঝলাম আমাদের দেশের পিজ্জা আর অরিজিনাল পিজ্জার পার্থক্য।

ক্যাথেড্রালের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতেই সারাদিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আমাদের ইউরোপ ট্যুরের অন্যতম একটা ইচ্ছা ছিল স্টেডিয়ামে বসে একটা ফুটবল ম্যাচ দেখা, কিন্তু সময় সুযোগের অভাবে সেটা হয়ে ওঠেনি। তাই স্টেডিয়াম ট্যুর দিয়েই তার কিছুটা অভাব পূরণ করার জন্য চলে গেলাম মিলানের সান সিরো স্টেডিয়ামে। বিশ্ব ক্লাব ফুটবল তথা ইউরোপীয় ফুটবলের সুপরিচিত দুই জগদ্বিখ্যাত ফুটবল দল এসি মিলান আর ইন্টারমিলান ক্লাবের স্টেডিয়ামটিই হলো সান সিরো স্টেডিয়াম। এটি ইতালির সবচেয়ে বড় স্টেডিয়াম। টিকিট করে ভেতরে ঢুকে পুরো স্টেডিয়াম, সাথে খেলোয়ারদের চেঞ্জিং রুম, মিউজিয়াম, প্রেস কনফারেন্স রুম সব ঘুরে আসা যায়।

ঘুরতে ঘুরতে বিকেল হতেই চলে গেলাম মিলানের পুরনো একটি এলাকা ‘নেভিগলো’তে সুর্যোদয় দেখতে। এই জায়গাটার বৈশিষ্ট্য হলো, এখানে দুই রাস্তার মাঝখান দিয়ে রয়েছে সুন্দর ক্যানেল। ক্যানেলের দুই পাশে রয়েছে রেস্টুরেন্ট আর বার, যেগুলো কিনা সব সন্ধ্যার পর থেকেই জমজমাট হতে শুরু করে, কিছুটা ভেনিসের মত একটা ফ্লেভার পাওয়া যায়। সুর্যাস্ত দেখার জন্য সন্ধার সময়টা এখানে কাটানোর জন্য জায়গাটা পর্যটকদের কাছে অনেক সুপরিচিত।

আমাদের রাতে থাকার জায়গাটা ছিল একটা গেস্ট হাউজ, বলা যায় এয়ারবিএনবি টাইপ; কিন্তু কিচেন সুবিধা নেই। একটি বয়স্ক দম্পতি তাদের তিন তলা বাড়িতে গেস্টদেরকে রুম ভাড়া দিচ্ছে। কিন্তু রুমের সেবা পুরা পাচ তারকা হোটেলের চেয়েও বেশি বলা চলে। অসাধারণ ব্যবস্থা। প্যারিসের মত এদের কম জায়গায় আটসাট করে থাকার অবস্থা না। বরং অত্যন্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন আর খাটি ইউরোপিয়ান লাইফস্টাইল যাকে বলা যায়। বয়স্ক ভদ্রমহিলা আমাদের জন্য অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন, ইংরেজি না জানলেও আধো আধো ইংরেজিতে আমাদেরকে ঠিকানা বুঝিয়ে বলেছেন। এরপরও খুঁজে পেতে সমস্যা হওয়ায় একজন ইন্ডিয়ান লোক আর তার স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আমাদেরকে গেস্টহাউজ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে যায়। এই লোকের কথা কখনো ভোলার মত না, সে পারলে আমাদেরকে তার বাসায়ই নিয়ে যায় রাতে থাকার জন্য।

মিলানের মেট্রো সার্ভিস অসাধারণ। শহরের যেকোনো জায়গায় মেট্রো দিয়েই যাওয়া যায়। মিলান অত্যন্ত পশ এবং ব্যায়বহুল একটি শহর। ইতিহাস ঐতিহ্যের ধারক হিসেবেও মিলানের রয়েছে সুপরিচিতি। মিলানের Santa Maria delle Grazie তে রয়েছে লিউনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত পেইন্টিং ‘দ্য লাস্ট সাপার’। এছাড়াও San Maurizio al Monastero Maggiore গির্জায় দেয়াল ছাদসহ চারিদিকে শুধু ইতালির বিখ্যাত যত পেইন্টারদের পেইন্টিং। আসলে এই সবকিছু দেখার জন্য অনেক অনেক সময় নিয়ে আসতে হবে। ইতালিতে দেখার এত এত জিনিস আছে যে ইউরো ট্রিপের স্বল্প কয়েকদিনে তা সম্ভব না, তাই ইউরো প্ল্যান থেকে ইতালিকে বাদ দিলেও রুট প্ল্যানের সুবিধার্তে একটু ঢু মেরে যেতেই হলো। আর সেই সুবাদে ইতালি তথা মিলানের পশ লাইফস্টাইলের সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগটাও পাওয়া গেলো।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com