কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার মাসুম আলী। গেলো জানুয়ারি মাসে শ্রমিক হিসেবে যান মালয়েশিয়ায়। সেখানে প্রথম দুই মাস কোনো কাজ পাননি। এসময় কয়েক দালালের হাত ঘুরে একরকম ‘বন্দিদশায়’ থাকতে হয় তাকে।
মাসুম আলী তৃতীয় মাসে এসে কাজ পান একটি কোম্পানিতে। কিন্তু তখন কেড়ে নেয়া হয় পাসপোর্টসহ সকল ডকুমেন্ট।
সে সময়কার পরিস্থিতি প্রতিদিনই কুষ্টিয়ায় থাকা স্ত্রীকে জানাতেন মাসুম আলী। তিনি স্ত্রীকে জানিয়েছিলেন, কাজের অত্যধিক চাপ আর সহ্য করা যাচ্ছে না।
“সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ। আবার মধ্যরাতেও প্রায়ই ডেকে নিয়ে কাজ করাতো। খাওয়া-দাওয়াও ঠিক ছিল না। আর ছিল গালিগালাজ এবং মারধর,” বলছিলেন মাসুমের স্ত্রী রত্না বেগম।
রত্না বেগম বিবিসিকে জানান, নতুন কোম্পানিতে এক মাস কাজ করার পরই সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করেন তার স্বামী। কিন্তু ধরা পড়ে যান। রত্না বেগমের দাবি এরপর তার স্বামীর উপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। গেলো এক মাস ধরে স্বামীর আর কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না তিনি।
“এপ্রিল মাসে ঈদের কয়েকদিন আগে হঠাৎ আমার স্বামী ফোন দেয়। বলে যে তাকে খুব মারধর করছে। তার কানের পাশ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিলো। আমাকে ভিডিও কলে দেখালো। বললো আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে বাঁচাও। এই বলার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর থেকে এক মাসের বেশি হলো আমার স্বামীর আর কোনো খোঁজ নেই।”
মাসুম আলী যে দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন, তিনি নিজেও মালয়েশিয়া থাকেন। রত্না স্বামীকে বাঁচাতে যোগাযোগ করেন তার সঙ্গে। কিন্তু সেও তার স্বামীর খোঁজ দিতে পারেনি।
রত্না বেগম কী করবেন, কার কাছে যাবেন সেটাও জানেন না। তার স্বামী জীবিত নাকি মৃত সেটাও তিনি বুঝতে পারছেন না।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিশ্বের যেসব দেশে জনশক্তি রপ্তানি হয় মালয়েশিয়া তারমধ্যে অন্যতম। দেশটিতে ১৪ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি গিয়েছেন শ্রমিক হিসেবে। এসব শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই সেখানে গিয়ে প্রতারণা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে পড়ার অভিযোগ নতুন নয়।
তবে সাম্প্রতিককালে এসব ঘটনা প্রকট হওয়ায় এটা নিয়ে সরব হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়সহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
কিন্তু মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা যাওয়ার পর ঠিক কী ধরনের পরিস্থিতিতে পড়ছেন?
আর দেশটিতে কেনই বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন বাংলাদেশিরা সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
ঢাকা থেকে আট মাস আগে মালয়েশিয়া গিয়েছিলেন মান্নান মিয়া (ছদ্ম নাম)। তার সঙ্গে একই ফ্লাইটে একই কোম্পানির অধীনে দেশটিতে যান আরো ৩৫ জন।
যাওয়ার আগে রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছিলো। যেখানে বেতন এবং চাকরিদাতা কোম্পানির নাম উল্লেখ করা হয়।
কিন্তু মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পর সেই চুক্তি আর কার্যকর হয়নি। বরং মান্নান মিয়ার দাবি, মাথাপিছু প্রায় দুই লাখ টাকা দরে তাদের প্রত্যেককে বিক্রি করে দেয়া হয় ভিন্ন এক কোম্পানির কাছে। যেখানে কাজ দেয়া হয় প্রতিশ্রুত বেতনের অর্ধেকেরও কমে।
মান্নান মিয়া বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “আমাদের বেতন ছিল বাংলাদেশি টাকায় ২৫ হাজার টাকা। অথচ বেতন হওয়ার কথা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। তিন মাসের মাথায় আমরা কোম্পানির সুপারভাইজারকে বললাম যে, আমাদের ওভারটাইম দেন। তো বেতন-ভাতার কথা তুলতেই সুপারভাইজার রড নিয়ে এসে বেধড়ক মারধর করছে আমাদের সবাইকে। প্রচুর মেরেছে। পরে বলেছে যে, মারধরের কথা বাইরে কেউ জানলে মেরে ফেলবে, দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিবে ইত্যাদি।”
মান্নান মিয়াসহ ৭ জন পরে সেই কোম্পানি থেকে পালিয়ে ভিন্ন একটা কোম্পানিতে কাজ নিয়েছেন। কিন্তু তাদের হাতে এখন কোনো কাজের বৈধ অনুমতিপত্র নেই। ফলে তারা দিন কাটাচ্ছেন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের আতঙ্ক নিয়ে।
মালয়েশিয়ায় শ্রমিকরা গিয়ে তাদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ প্রথমেই যে প্রতারণার মধ্যে পড়ছেন সেটি হচ্ছে, কাজ না থাকা। অর্থাৎ যে কাজের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাস্তবে সে কাজ বা চাকরি নেই।
এরপরই আসে অপর্যাপ্ত বেতন। চুক্তিতে যে বেতন লিখা আছে, বাস্তবে তা দেয়া হয় না।
তৃতীয় সমস্যা হয়, পাসপোর্ট-ভিসা আটকে রাখাকে কেন্দ্র করে। এজেন্সির লোকেরা মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পৌঁছানোর পরই ভিসার আনুষ্ঠানিকতার জন্য পাসপোর্ট নিয়ে নেন। এরপর সেটি আর ফেরত দিতে চান না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভিসা-পাসপোর্ট দেয়ার জন্য ৭০ থেকে এক লাখ টাকা বাড়তি দিতে হয় বলেই অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
এর বাইরে আছে ছোট্ট রুমে গাদাগাদি করে রাখা, তিন বেলার বদলে দুই বেলা খাবার দেয়া, সেটিও আবার পরিমাণে কম।
সবশেষে আছে নির্যাতনের অভিযোগ। সব মিলিয়ে যে অবস্থা তাকে অনেকটা জিম্মিদশার সঙ্গেই তুলনা করছেন কুয়ালালামপুরে থাকা প্রবাসী শ্রমিক খালেক মণ্ডল (ছদ্মনাম)।
তিনি বলছিলেন, “আসলে এখানে কাজ নেই। কিন্তু সবাই শ্রমিক আনছে। যারা শ্রমিক নিয়ে আসার অনুমোদন পেয়েছে, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়ার কোম্পানি, এদের কাছে এটা ব্যবসা। যে ৫০ জনের চাকরি দিতে পারবে সে আনছে সাতশত শ্রমিক। এটা কীভাবে সম্ভব? কীভাবে তারা অনুমোদন পাচ্ছে? কেন যাচাই হচ্ছে না তাদের সক্ষমতা? আসলে এখানে আমরা সবাই জিম্মি।”
খালেক মণ্ডল জানাচ্ছেন, তিনি নিজেই চুক্তি অনুযায়ী নির্দিষ্ট কোম্পানিতে চাকরি পাননি। তাকে কাজ দেয়া হয়েছে অন্য কোম্পানিতে। কিন্তু মালয়েশিয়ার আইনে এটি বৈধ না। ফলে তিনি এখন অবৈধ অবস্থাতেই একরকম ‘জিম্মি দশায়’ আছেন।
“এখানে আসতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ৬ লাখ টাকা। এখন যেখানে আছি, সেখানে থাকলে টাকা জমানো তো দূরের কথা, পরিবারের খরচ দিয়ে বেঁচে থাকাই সম্ভব না। বাধ্য হয়েই এখান থেকে পালানো ছাড়া উপায় নেই। আর না পালালে শেষ উপায় হচ্ছে দেশে চলে যাওয়া। কিন্তু সেটাও সম্ভব না। কারণ দেশে গিয়ে ঋণের বোঝা কে টানবে?” বলছিলেন খালেক মণ্ডল।
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক যাওয়ার সূত্রপাত ১৯৭৬ সালে। বাংলাদেশের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসেবে ১৯৭৬ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত প্রবাসে শ্রমিক গেছে ১ কোটি ৬০ লাখ।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনশক্তি গিয়েছে সৌদি আরবে। সংখ্যাটা ৫৭ লাখ।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৬ লাখ, ওমানে ১৮ লাখ।
এরপরই মালয়েশিয়ার অবস্থান। সেখানে এ পর্যন্ত শ্রমিক গিয়েছে ১৪ লাখেরও বেশি।
তবে শুধু ২০২৩ সালেই দেশটিতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক গিয়েছে তিন লাখ ৫১ হাজার।
আর শ্রমিকদের কাজ না পাওয়া, নির্যাতন থেকে শুরু করে শ্রমিক নিখোঁজ হওয়ার মতো অভিযোগগুলোও প্রকট হয়েছে এই বছরই অর্থাৎ ২০২৩ সালে।
এসময় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শ্রমিকদের দুর্দশার চিত্র উঠে আসে মালয়েশিয়ার মূলধারার গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবদেনগুলোতেও। সেগুলোতে জানানো হয়, বাংলাদেশের অনেক শ্রমিক দেশটিতে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। কম মজুরি, বেকার থাকা, নির্যাতন, অবৈধ হয়ে পড়ার মতো সমস্যাগুলোও বিশদ উঠে আসে সেসব প্রতিবেদনে।
একপর্যায়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয়ে থেকেও বিবৃতি দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে জাতিসংঘের কন্টেম্পোরারি স্লেভারি বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার তমোয়া ওবোকাতা বলেন, মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমিকরা যে অবস্থায় আছেন তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার যথেষ্ট কারণ আছে।
দেশটিতে শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়ার সঙ্গে দুই দেশেরই একটি সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র জড়িত।
“এখানে বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার ভেতেরে একটি শক্তিশালী অপরাধী চক্র গড়ে উঠেছে। যারা চাকরি এবং ভালো বেতনের কথা বলে শ্রমিকদের মালয়েশিয়ার নিয়ে প্রতারণা করছে। তারা পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে শ্রমিকদের কাছ থেকে। ফলে শ্রমিকরা ঋণের চক্রে আটকে যাচ্ছে।”
“এছাড়া নির্দিষ্ট কোম্পানিতে কাজ না পাওয়ায় শ্রমিকরা অবৈধ হয়ে পড়ে। এই অবৈধ শ্রমিকদের যারা চাকরি দেয়, তারাও এদের শোষণের সুযোগ হাতছাড়া করে না। ফলে সমস্যাটা এখানে বেশ গভীর,” বলছিলেন তমোয়া ওবোকাতা।
তার মতে, বাংলাদেশ এবং মালয়েশিয়া- দুই দেশের সরকারকেই শ্রমিক নিয়োগের পুরো প্রক্রিয়া সংশোধন করতে হবে যেন শ্রমিকরা নির্যাতিত না হয়।
শ্রমিকদেরকে যেসব কোম্পানিতে কাজের কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়, সেসব বিষয় যাচাই-বাছাই করে শ্রমিকদের চূড়ান্ত ছাড়পত্র দেয় বাংলাদেশ সরকার।
এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার যে কোম্পানিতে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে, সে কোম্পানির বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার কথা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনের।
কিন্তু এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি হাইকমিশনের ভূমিকা কী? তারা কেন ভূয়া কোম্পানিগুলো চিহ্নিত করতে পারছে না?
এসব প্রশ্ন করা হয় সেখানে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার শামীম আহসানকে। মি. আহসান অবশ্য সেখানে নিয়োগ পেয়েছেন ছয় মাস আগে।
তবে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেন। জানান, এসব অভিযোগ নতুন নয়। এসব অভিযোগের নিষ্পত্তিও করা হচ্ছে। তবে কোনো কোনো কোম্পানির কারণে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে এটাও সত্য।
তিনি বলেন, “আসলে ভূয়া কোম্পানির কারণে মানুষ প্রতারিত হচ্ছে এমনটা নয়। কোম্পানিগুলো এখানে আইনগতভাবে বৈধ। তবে কোম্পানির অনৈতিক আচরণ, কমিটমেন্ট না মানার কারণে এ বিষয়গুলো ঘটছে। এগুলোর তড়িৎ সমাধান দূতাবাসের একার হাতে নেই। এখানে নিয়োগকর্তা যারা মালয়েশিয়ার, তাদেরও আন্তরিকতার বিষয় আছে।”
“তাদেরকে আইনের আওতায় আনাটা আসলে মালয়েশিয়ার সরকারের উপর বর্তায়। তবে বাংলাদেশের তরফ থেকেও নানারকম পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যেখানে এতো শ্রমিক কাজ করছেন, সেখানে কিছু সমস্যা হতেই পারে। তবে সমস্যাগুলো আমরা সমাধানের ক্ষেত্রে সচেষ্ট আছি।”
মি. আহসান এটাও স্বীকার করেন যে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ভিসা বের করার একটি প্রবণতা নিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে আছে। তার মতে, মানুষের প্রতারণার মুখে পড়ার বড় কারণ এটা।
তিনি জানান, এসব বিষয় নিয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এছাড়া খুব দ্রুতই দুই দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠকেও সমস্যাগুলো তুলে ধরা হবে।
বিবিসি বাংলা