মালয়েশিয়ায় দেখা দিয়েছে নার্স সংকট। এ সংকট আরও প্রকট হতে পারে যদি দেশটির নার্সদের প্রতি সপ্তাহে অতিরিক্ত আরো তিন ঘণ্টা কাজ করতে হয়।
দেশটির ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অফ নার্সেস (আইসিএন) বলছে, সিভিল সার্ভিস রিমুনারেশন সিস্টেমের অধীনে একটি নতুন নির্দেশনার এসেছে, যেখানে ওয়ার্ড নার্সদের সপ্তাহে ৪২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৪৫ ঘণ্টা কাজ করতে বলা হয়েছে। দেশটিতে এই নিয়ম ১ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হবে।
এই পদক্ষেপটিকে একটি স্বল্পমেয়াদি দ্রুত সমাধান হলেও আইসিএন-এর সিইও হাওয়ার্ড ক্যাটন বলছেন যে, পদক্ষেপটি নার্সদের শারীরিক এবং মানসিকভাবে আরও চাপ বাড়িয়ে দেবে, যা আরও বেশি নার্স হারানোর কারণ হতে পারে।
এদিকে দেশটির ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে জানিয়েছে, মালয়েশিয়া গুরুতর নার্স সংকটের মুখোমুখি, যা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে আরও প্রকট করে তুলছে। এর কারণ হিসেবে জনপ্রিয় এ গণমাধ্যমটি জানিয়েছে, বার্ধক্যজনিত জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং ব্রেন ড্রেন সমস্যা।
ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে আরো জানিয়েছে, গত মে মাসে, দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রী জুলকেফলি আহমাদ বলেছিলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে নার্সিং কর্মী ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৬০% ছাড়িয়ে যাবে।
কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় নার্স সংকটের এ সুযোগ বাংলাদেশ নিতে পারে কি না? এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিলো মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনার, মো. শামীম আহসান-এর কাছে, তিনি এ সম্পর্কে দৈনিক মানবজমিনের মালয়েশিয়া করেসপন্ডেন্ট আরিফুল ইসলামকে বলেন;
“নীতিগতভাবে, আমরা মালয়েশিয়ায় দক্ষ কর্মী ও প্রফেশনালদের নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেই। মানব সম্পদের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সঙ্গে আমাদের শুধু শ্রমিক সম্পৃক্ততার বিষয়টি পরিবর্তনের জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে নার্সিং একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও, কেয়ার-গিভারের চাহিদা সম্পর্কে আমরা শুনেছি। অন্যান্য খাতগুলোর পাশাপাশি আমরা এই খাতগুলো নিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালাচ্ছি। তবে, একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই খাতগুলোতে পেশাদারিত্ব সম্পর্কে আমাদের আরো আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, কারণ আমাদের দেশের অধিকাংশ নার্সদের রয়েছে পেশাদারিত্বের অভাব, ইংরেজিতে দুর্বলতা, সাথে লোকাল ভাষার সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিতি। যার ফলে, কিছু নিয়োগদাতা অন্য দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করেছে।”
এদিকে মালয়েশিয়াতে ঘুরতে আসা অনেক ইউরোপীয় বিদেশিরা বলেছেন যে, তাদের দেশে নার্সরা তাদের রোগীদের ভাই, বোন ও মায়ের মতো যত্ন করেন এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখেন। তবে আমাদের নার্সদের এখনও এই ধরনের নোংরা কাজ, মানবিকতা নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি, পেশাদার মানসিকতা গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে।
মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশি একাডেমিসিয়ান, মেডিকেল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট, মেডিকেল সায়েন্টিস্ট এবং যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশপিডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত ‘সাকসেসফুল পিপল্ ইন মালয়েশিয়া’ নামক বইয়ে স্থান পাওয়া বাংলাদেশি, বর্তমানে মালয়েশিয়ার পারদানা ইউনিভার্সিটি গ্রাজুয়েট স্কুল অফ মেডিসিন-এর মেডিকেল সায়েন্টিস্ট ড. নাজমুল হাসান মাজিজ এ সম্পর্কে দৈনিক মানবজমিনকে জানিয়েছেন-
“মালয়েশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যদি নতুন পলিসি করে, সার্কুলার দিয়ে বিদেশ থেকে নার্স নেওয়ার ঘোষণা দেয় তখন সরকারিভাবে বাংলাদেশ থেকে নার্স নিয়ে আসা সম্ভব। যদিও প্রাইভেট সেক্টরে এখনো নার্স নিয়ে আসা সম্ভব তবে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশনের ভিসা জটিলতা এবং আমাদের দেশের নার্সদের ভাষা জটিলতার কারণে তা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।”
স্বাস্থ্যসেবায় নিরাপত্তার বিষয়টিকে খুব সতর্কতার সাথে গুরুত্ব দিতে হয়। এখানে ভুলের পরিণতি খুব ভয়াবহ। নার্সরা ক্লান্ত হলে সেবার মান ও কার্যকারিতা কমে যায়। যদি একজন নার্স ভুল করে, তবে তার পরিণতি ভুল নম্বরে ডায়াল করার মতো না যে, কেটে দিয়ে সঠিক নাম্বারে ডায়াল করলাম। এটা জীবন সম্পর্কিত বিষয়, যদি তা পেশাদারিত্বের সাথে নিতে পারা যায়, তবেই না মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি নার্স নিয়ে আসার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় মালয়েশিয়াস্থ বাংলাদেশি কমিউনিটির পরিচিত মুখ ডা. শংকর চন্দ্র পোদ্দারের সাথে। যিনি দীর্ঘদিন মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি কমিউনিটির ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি জানিয়েছেন, “মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশি নার্স নিয়ে আসার ব্যাপারে আমি প্রথম কাজ শুরু করি কিন্তু আমাদের দেশের নার্সদের রয়েছে পেশাদারিত্বের অভাব, ইংরেজিতে দুর্বলতা এবং লোকাল (মালয়) ভাষা না শেখার প্রবণতা।
ভাষাগত জ্ঞান না থাকার ফলে ইমার্জেন্সি রোগীর চিকিৎসায় গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোগীর অবস্থা সঠিকভাবে চিকিৎসককে জানানো কঠিন হয়ে যায়, যা সঠিক চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় বিলম্ব ঘটায়। ভুল বোঝাবুঝি বা অপর্যাপ্ত তথ্য প্রদান রোগীর স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ব্যাঘাত ঘটে, যা কখনো কখনো রোগীর জীবনকে সংকটাপন্ন করে তোলে। এই সমস্যাগুলো এড়াতে ভাষার প্রাথমিক ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
বাংলাদেশ থেকে নার্স নিয়ে আসার সঙ্কটের সমাধান নিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, বাংলা প্রেসক্লাব মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট, দৈনিক যুগান্তর ও যমুনা টিভির মালয়েশিয়া প্রতিনিধি, আহমাদুল কবিরকে, তিনি জানিয়েছেন
আমাদের দেশের নার্সদের পেশাদারিত্ব মনোভাবের পরিচয় দিতে হবে। কাটাতে হবে ইংরেজিতে দুর্বলতা, সাথে মালয় ভাষা অনর্গল বলতে শিখতে হবে কারণ মালয়েশিয়াতে একজন নার্সকে সার্বক্ষণিক একজন ডাক্তারদের তত্ত্ববধানে থাকতে হয়। আর এর জন্য প্রয়োজন আমাদের দেশে প্রফেশনাল নার্স ইনস্টিটিউট এবং ল্যাঙ্গুয়েজ সেন্টার গড়ে তোলার। যা মালয়েশিয়া তথা বিশ্বের স্বাস্থ্য খাতের পলিসিগত বিষয়কে প্রভাবিত করতে পারে।
যদিও মালয়েশিয়া সকল ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এর ব্যবহার নিয়ে ভাবছে, তবে সময়ের প্রয়োজনে স্বাস্থ্যসেবায় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এর ব্যবহারের এক প্রশ্নে ক্যাটন বলছিলেন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) নার্সদের বিকল্প হতে পারবে না, কারণ রোগীরা স্বাস্থ্য সমস্যার ক্ষেত্রে মানুষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে পছন্দ করে। আমরা সেই মানবিক যোগাযোগ চাই। এটি কেবল আমাদের শারীরিক প্রয়োজন নয়, আমাদের মানসিক প্রয়োজনও মেটায়। যা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স রোবট কখনোই তা বিকল্প হতে পারবে না।
সে হিসেবে আমাদের দেশের নার্সদের ভাষাগত জ্ঞান এবং পেশাদারিত্বের সকল স্তরে উন্নীত করার পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দেশের নিয়োগদাতাদের সকল শর্ত মেনে নার্সদের বৈশ্বিকভাবে তৈরি করতে এখন থেকেই সঠিক পদক্ষেপ, পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন করতে পারলেই খুব দ্রুতই খুলতে পারে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা পৃথিবীর অন্যতম আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের দেশ মালয়েশিয়ার আরেক নতুন দুয়ার।