শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৭ অপরাহ্ন
Uncategorized

মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কলকাতা

  • আপডেট সময় সোমবার, ১২ জুলাই, ২০২১

এবার ঢাকা থেকে আসা যাবে কলকাতা, সময় লাগবে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই হতে চলেছে। এর জন্য অপেক্ষা করতে হবে আর মাত্র বছর তিনেক। পদ্মা সেতুর রেল সংযোগ প্রকল্প চালুর পর ঢাকা-কলকাতার যোগাযোগে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটবে। এখন যেখানে ১০ ঘণ্টা সময় লাগে তিন বছর পর সেখানে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কলকাতায় পৌঁছানো যাবে। ‘সিটি অফ জয়’ খ্যাত কলকাতা শহরটি বাংলাদেশিদের কাছে ব্যাপক পরিচিত এবং শুধুমাত্র ঈদ শপিং করতে প্রতিবছর দেড় থেকে দুই লাখ বাংলাদেশির আগমন ঘটে কলকাতা শহরে। এছাড়াও রয়েছে চিকিৎসা ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে এই শহরে যাওয়া। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ক্ষেত্রে এই কলকাতা উপমহাদেশের সংস্কৃতি মনা মানুষদের এক তীর্থস্থান। বিশেষ করে বাঙালি সংস্কৃতির এক আধার এই সিটি অফ জয়। তাই দশ ঘণ্টার ভ্রমণের পরিবর্তে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় কলকাতা যাবার সংবাদটি এই অঞ্চলের মানুষের জন্য এক আলাদা আনন্দবার্তা নিয়ে এসেছে।

বর্তমানে মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেনে ঢাকা থেকে সরাসরি কলকাতায় যাওয়া যায়। কলকাতা স্টেশন থেকে নদীয়া হয়ে গেদে এবং গেদে হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত স্টেশন দর্শনা পার হয়ে ঢাকায় অবস্থিত ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছায় মৈত্রী এক্সপ্রেস। এ রুটে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার রেলপথ পাড়ি দিতে হয় যাতে সময় লাগে প্রায় দশ ঘণ্টা। ২০২৪ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর রেলের নির্মাণকাজ শেষ হতে যাচ্ছে আর তখন কলকাতা স্টেশন থেকে বনগাঁ জংশন হয়ে হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে বেনাপোল হয়ে যশোর, নড়াইল, ফরিদপুরের ভাঙ্গা হয়ে ঢাকা পৌঁছাতে পারবে ট্রেনটি। এ রুটের দূরত্ব দাঁড়াবে প্রায় ২৫১ কিলোমিটার। যা পার করতে মৈত্রী এক্সপ্রেসের গতিতে সাড়ে তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়।

অপরদিকে সড়ক পথে ঢাকা-কলকাতা যেতে প্রায় সারাদিন লেগে যায়। দূরত্ব তো আছেই, সঙ্গে পদ্মাতীরে ফেরির জন্য দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষা। সেই দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। পদ্মা নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে বহুকাঙ্ক্ষি সেতু। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আগামী জুনে চালু হচ্ছে এ সেতু। তবে সেতুর ওপর দিয়ে পুরোপুরি রেলসংযোগ পেতে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে।  রেলসেতু ও রেলপথ নির্মাণের পর ঢাকা-কলকাতা যোগাযোগে অভাবনীয় উন্নয়ন ঘটবে। সড়কপথে যেমন দূরত্ব কমে আসবে এবং সময় বাঁচবে তেমনি দশ ঘণ্টার পথ রেলে যাওয়া যাবে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় অর্থাৎ এটি চালু হলে ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার সময় দুই-তৃতীয়াংশ কমে আসবে। এছাড়া রেলপথে কলকাতা থেকে আগরতলা যেতে সময় লাগে ৩০ ঘণ্টা। সেই সময়ও কমে আসতে পারে ছয় ঘণ্টায়। পদ্মা সেতু নির্মাণ হলে এ রুটেও রেল পরিষেবা চালু হবে।

ঢাকা এবং কলকাতার মধ্যে চলাচলকারী মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রীদের সীমান্তে ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস চেকিং এর ক্ষেত্রে আগেই অনেক সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। ২০১৭ সালের পূর্বে ভারতে গেদে স্টেশন এবং বাংলাদেশে দর্শনা স্টেশনে যাত্রীদের ট্রেন থেকে নেমে পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষা করাতে হতো। সেখানে কাস্টমস চেকিংও হত। এর ফলে যাত্রীদের যেমন ভুগান্তি পোহাতে হতো ঠিক তেমনি প্রায় তিন ঘণ্টা সময় বেশি লাগতো। ২০১৭ সাল থেকে  সেই নিয়ম তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন ট্রেনে ওঠার আগেই ওইসব পরীক্ষা হয়ে যায়। সীমান্তে যাত্রীদের আর নামতে হয়না, সময়টাও বেঁচে যায়।

যাত্রা শুরুর আগেই কলকাতা এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে ট্রেনে ওঠার সময়েই পাসপোর্ট-ভিসা পরীক্ষার কাজ সেরে ফেলা হবে। বর্তমানে ঢাকা-কলকাতা ট্রেনে যাতায়াত করতে প্রায় এগারো ঘণ্টা সময় লাগে। নতুন নিয়ম চালু হলে সময় লাগবে প্রায় আট ঘণ্টা।

সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। দুই দেশ খুব গুরুত্বের সাথে কানেক্টিভিটির জায়গাকে সমৃদ্ধ করছে। শুধু পদ্মাসেতুর এ রেল প্রকল্প নয় কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি ফেনী নদীর উপরেও মৈত্রী সেতু স্থাপনের মাধ্যমে এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে ভারত-বাংলাদেশ। এই মৈত্রী সেতুকে দক্ষিণ এশিয়ার নতুন বাণিজ্য করিডোর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই সেতু একইসাথে আন্তঃ বাণিজ্যের যেমন সম্প্রসারণ ঘটাচ্ছে তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে এক বিশাল প্রভাব ফেলছে। ভারত যেমন এই সেতু ব্যবহার করে ত্রিপুরা অঞ্চলকে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বিস্তার ঘটাবে তেমনি বাংলাদেশও নেপাল, ভুটান, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য করিডোর হিসেবে ভারতের মাটি ব্যবহার করবে। তাছাড়া ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশের সেতুপথে প্রবেশাধিকার পাওয়া মানে হচ্ছে, আমরা একটা ‘বার্গেনিং পাওয়ার’ তৈরি করতে পারবো। যেমনটা আমরা নেপালের সাথে একটা তৈরি করছি।

এছাড়া ভারতে উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের পণ্যের একটা বিশাল মার্কেট আছে। ফলে বাংলাদেশ থেকে পণ্য সেই রাজ্যগুলোতে অবাধে যেতে পারবে। অন্যদিকে ত্রিপুরার সাথে বাংলাদেশ যুক্ত হলেও পাশাপাশি মেঘালয়-মণিপুরসহ যে রাজ্যগুলো রয়েছে, সেগুলোর যেহেতু মিয়ানমারের সাথেও সংযোগ স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে, সেক্ষেত্রে সড়কপথে বাংলাদেশেরও মিয়ানমারের সংযোগ স্থাপন হবে যা ব্যবসা বাণিজ্য সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে মাইলফলক ভূমিকা রাখতে পারে। আবার চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করার অনুমতি যেহেতু আগেই দেয়া আছে সেক্ষেত্রে বন্দরের বিভিন্ন সেবা নেয়ার জন্য শুল্ক আদায় করে বাংলাদেশ লাভবান হবে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ শুল্ক নিতে পারবে। তাছাড়া সম্প্রতি ভারত সরকার বাংলাদেশকে সার রপ্তানিতে ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপালে পাঠানোর ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছে। মিয়ানমার, ভারত, থাইল্যান্ড সংযোগ সড়কে বাংলাদেশ চতুর্থ দেশ হিসেবে নিজেদের নাম লেখাতে চাইছে। বিদ্যুৎ খাতে সক্ষমতা বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ রপ্তানীতেও মনযোগি বাংলাদেশ। একারণেই নেপালে বিদ্যুৎ রপ্তানীর জন্য আলাদা ট্রানজিট সুবিধা চাইছে যা হয়তো অতি শীঘ্রই পাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ অনেক আগেই ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। এই ট্রানজিটের ফলে লাভবান হচ্ছে দু দেশই। তাই ফেনী সংযোগ এক নতুন পথের সন্ধান দিচ্ছে দুই দেশকে যা বাণিজ্য সম্প্রসারণ থেকে শুরু করে মানুষের চলাচলের সুবিধা করে দিচ্ছে, সার্বিক অর্থনীতিতে অবদান রাখছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ট্রানজিটের উপর বাংলাদেশ সরকারও জোর দিয়েছে। কেননা ভৌগোলিক অবস্থানের পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির গতিপথ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় অত্যন্ত আকর্ষণীয় প্রতিবেশী করে তুলেছে। বৈশ্বিক টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম নেতা হিসেবে বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র পথ তৈরি করেছি। বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে কানেক্টিভিটির কেন্দ্র হিসেবে এর অবস্থানগত সুবিধা সর্বাধিক করতে প্রস্তুত বাংলাদেশ। আর সেকারণেই যোগাযোগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু আলাদা পদক্ষেপ নিচ্ছে দুই দেশ। ঢাকা-কলকাতা মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টায় যাবার এই পথ কানেক্টিভিটির আরেক উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় ট্রানজিটের সুবিধের প্রশ্নে শুরুতেই চলে আসে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের ঘটনা। এ কারণেই এ অঞ্চলে ট্রানজিট নিয়ে অজানা একটা বিরুপ ধারণা জনগণের মাঝে রয়েছে। এসব ধারণাকে বদলে নতুন আঙ্গিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ। কেননা দুই দেশই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছে, সীমান্ত সন্ত্রাসকে বন্ধের উদ্যোগে নানামুখী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। বিগত বছরে ভারত-বাংলাদেশ যে কূটনৈতিক দক্ষতায় অমীমাংসিত বিষয়গুলোকে মীমাংসা করেছে, সামনের দিনেও এর ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থাকবে বলে সকলের বিশ্বাস।

মূলত চিকিৎসার কারণে বাংলাদেশ থেকে অনেক মানুষ কলকাতা যান। এছাড়াও ঈদ শপিং, ভ্রমণসহ আরও নানা কারণেই যেতে হয় বাংলাদেশিরা যান কলকাতাতে। ঢাকা থেকে কলকাতা বাস থাকলেও, বেশিরভাগ মানুষের পছন্দ রেলপথ। কারণ, সড়কপথে যেতে প্রায় সারাদিন লেগে যায়। সঙ্গে থাকে পদ্মাতীরে ফেরির জন্য দীর্ঘ লাইনের অপেক্ষা। এবার সেই অপেক্ষা দূর করে দিচ্ছে পদ্মা সেতু। রেল যোগাযোগের এই সময় কমিয়ে আনাটা দু’দেশের জন্য একটি নতুন বাণিজ্য লাইফলাইন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এতে কানেক্টিভিটি শুধু বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্বই জোরদার করছে না, ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বড় সুযোগ সৃষ্টি করছে। পুরো অঞ্চলকে বৃহৎ বাণিজ্য করিডর হিসেবে রূপ দিচ্ছে।

বিডি-প্রতিদিন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com