শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৪০ অপরাহ্ন
Uncategorized

মাটির নিচে ঘুমন্ত নগরী

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৮ আগস্ট, ২০২১
উত্তরবঙ্গের প্রবেশপথ নামে খ্যাত বগুড়া জেলা সদর থেকে আরও ১২ কিলোমিটার উত্তরে যেতে হবে। বিশ্বরোড নামে পরিচিত বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক ধরে যে কোনও যানবাহন ব্যবহার করে নেমে পড়া যাবে বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন নগরীতে। এখন থেকে আড়াই হাজার বছর আগে এখানে গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ নগর, যার নাম পুণ্ড্রনগর বা পুণ্ড্রবর্ধন নগর। কালের আবর্তনে এর বর্তমান নাম দাঁড়িয়েছে মহাস্থানগড়।
বিভিন্ন কারণে মহাস্থানগড় প্রত্নতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন প্রত্নস্থল বলে সারা পৃথিবীর পর্যটক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে মহাস্থানগড় আকর্ষণীয়। মহাস্থানগড় কথাটার শেষ শব্দ ‘গড়’-এর মানে হল উচ্চস্থান। স্বাভাবিক ভূমির চেয়ে এ জায়গাটা অনেক উঁচু। অসংখ্য প্রাচীন রাজা ও ধর্মপ্রচারকের বসবাসের কারণে এই উচ্চভূমিটি ‘মহাস্থান’ বা গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

লুকিয়ে থাকা নগর

মহাস্থানগড়েই এক সময় গড়ে উঠেছিল পুণ্ড্রবর্ধন বা পুণ্ড্রবর্ধন নগর নামের এক প্রাচীন বসতি। যিশু খ্রিস্টের জন্মেরও আগে এখানে সভ্য জনপদ গড়ে উঠেছিল প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই তার প্রমাণ মিলেছে। জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে খ্রিস্টীয় ১৫ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে এই নগর এক সমৃদ্ধ জনপদ হিসেবে বিস্তার লাভ করে। বেশ কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এখানে অসংখ্য হিন্দু রাজা ও অন্যান্য ধর্মের রাজারা রাজত্ব করেন। এর ভেতর রয়েছেন মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সামন্ত রাজবংশের লোকেরা। এরপর এখানে ধর্মীয় সংস্কার করতে আসেন ইসলাম ধর্মপ্রচারকরা। অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক আর ইতিহাসবিদ মহাস্থানগড়কে হারিয়ে যাওয়া কিংবদন্তির নগরী পুণ্ড্রবর্ধন বলে উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ৬৩৯ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে পুণ্ড্রনগরে এসেছিলেন। ভ্রমণের ধারাবিবরণীতে তিনি তখনকার প্রকৃতি ও জীবনযাত্রার উল্লেখ করে বর্ণনা করেন। দশম শতকের মধ্যবর্তী সময়ে এখানে রাজত্ব করেন রাজা নরসিংহ বা পরশুরাম।
কিংবদন্তি অনুযায়ী রাজা পরশুরাম ছিলেন অত্যাচারী। তাকে উচ্ছেদ করে ইসলাম ধর্মের শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে আসেন হজরত শাহ্ সুলতান বলখী (র.) মাহী সওয়ার। ধর্ম প্রচারক শাহ্ সুলতান বলখী (র.) সম্পর্কে রয়েছে আশ্চর্য কিংবদন্তি। শোনা যায়, তিনি মহাস্থানগড় অর্থাৎ প্রাচীন পুণ্ড্রনগরে প্রবেশ করার সময় করতোয়া নদী পার হয়েছিলেন একটা বিশাল আকৃতির মাছের পিঠে চড়ে। এজন্য তার নামের শেষে উল্লেখ করা হয় মাহী সওয়ার বা ‘মাছের পিঠে আরোহণকারী’। বাস্তববাদীরা বলেন, মাহী সওয়ার নদী পার হয়েছিলেন ঠিকই তবে তা মাছের পিঠে চড়ে নয়। বরং মাছের আকৃতিতে তৈরি করা নৌকার পিঠে চড়ে। উদাহরণস্বরূপ তারা বলেন, যেরকম ময়ূরের মুখ সদৃশ্য নৌকাকে ময়ূরপঙ্খি নৌকা বলা হয়। এরকম একটি ঘটনাই হয়তো শেষ পর্যন্ত এই মিথের সৃষ্টি করেছে।

দুচোখ মেলে দেখি

মহাস্থানগড় জুড়েই যেন এক বিচিত্র পরিবেশ। প্রাচীনত্ব আর আধুনিকতার এমন সম্মেলন খুব বেশি জায়গায় চোখে পড়বে না। এখনও মহাস্থানগড়ের এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে প্রাচীন আমলের অসংখ্য ভবনের ভগ্নাংশ। এখানকার স্থানীয় অধিবাসীরা কাদামাটির সঙ্গে প্রত্নধতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই পোড়ামাটির ইটগুলো দিয়ে তাদের বাসগৃহ তৈরি করেন। তারা যে কত অমূল্য সম্পদকে নষ্ট করে ফেলছে তা নিজেরাই জানেন না। এখানে প্রায়ই খনন কাজের সময় মাটির নিচ থেকে উঠে আসে ইটের টুকরা বা পোড়ামাটির আসবাবের ভগ্নাংশ। কখনও কখনও পাওয়া যায় ছোটখাটো মূর্তি বা মুদ্রা। বগুড়া-রংপুর মহাসড়ক ধরে উত্তরে যাওয়ার সময় বাসের জানালা দিয়ে তাকালেই চোখে পড়বে অস্বাভাবিক উচ্চভূমি।
আরেকটু  দৃষ্টিতে তাকালে গাছ-পালার সবুজ পেরিয়ে চোখে পড়বে দুর্গনগরীর প্রাচীর। দীর্ঘাকৃতির এই প্রাচীরই বলে দেয় সমৃদ্ধ সেই নগরবাসী নিরাপত্তাকে কতটা গুরুত্ব দিত। লাখ লাখ পোড়ামাটির ইট আর সুড়কি দিয়ে ১ বর্গমাইল এলাকাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে, নিজের চোখে না দেখলে এ বর্ণনা বিশ্বাস করা কঠিন। দেয়ালের মতো যে বিশাল কাঠামো মহাস্থানগড়কে ঘিরে রেখেছে তার দৈর্ঘ ৫০০০ ফুট আর প্রস্থ ৪৫০০ ফুট। সমতল ভূমি থেকে এ দেয়ালের উচ্চতা ১৫ থেকে ৪৫ ফুট। প্রাচীরটি যথেষ্ট চওড়া। ৫ থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত এই প্রাচীরের উপরিভাগ দেখলে চীনের গ্রেটওয়ালের কথা মনে পড়বে। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের তত্ত্বাবধানে এখানে কয়েক দফা খনন ও সংস্কার কাজ করা হয়েছে। পর্যটকরা দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে পারবেন এই প্রাচীরের উপর হেঁটে।
ভ্রমণপিপাসুরা এখানে নির্বিবাদে ঘুরে বেড়াতে পারবেন। প্রাচীর ঘেরা এ অংশের ভেতরে অনেক চিহ্নিত স্থাপনা রয়েছে। বিভিন্ন রাজবংশের আমলে নির্মিত এসব পুরনো ভবনের ধ্বংসাবশেষের বেশিরভাগই রয়েছে মাটির নিচে। বিভিন্ন সময়ে প্রতœতাত্ত্বিকরা এসব খুঁড়ে তাদের পর্যবেক্ষণ সমাপ্ত করে আবার সংরক্ষণের তাগিদেই মাটি দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। শুধু রসকষহীন ইটের টুকরো নয়, পুণ্ড্রবর্ধনের ঐতিহ্যের খবর রাখলে পর্যটকরা এখানে এসে আরও বেশি রোমাঞ্চ বোধ করবেন।
বর্তমান মহাস্থানগড়ের অন্যতম আকর্ষণ হল হযরত শাহ্ সুলতান বলখী (রঃ) মাহী সওয়ারের মাজারটি। মহাস্থানগড় দুর্গপ্রাচীরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় মাজারটি অবস্থিত। সমতলভূমি থেকে টিলার উপর ওঠার জন্য রয়েছে অসংখ্য ধাপবিশিষ্ট সিঁড়ি। মাজার চত্বরে রয়েছে একটি প্রাচীন কুয়া ও অনেক বেদি। এছাড়া অতিথিদের জন্য রান্নার জায়গা ও বিশ্রামের ছাউনিও রয়েছে।
এখানকার একটি মাত্র যে প্রাচীন মসজিদ পাওয়া গেছে তা সুলতান ফারুক শাহের রাজত্বকালে, ১৭১৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা। ব্রিটিশ শাসনামলে এই মাজার থেকেই ফকির বিদ্রোহের কর্মসূচি পরিচালিত হত।

আরও দেখবেন যা

মহাস্থানগড় দুর্গপ্রাচীরের উত্তর পাশে রয়েছে এখানে পিকনিক করতে আসা দলের নির্ধরিত জায়গা। এখান থেকে আরেকটু উত্তরে রয়েছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের স্থাপনকৃত জাদুঘর। জাদুঘরে মহাস্থানগড় ও আশপাশের অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করা অসংখ্য প্রতœবস্তুর নমুনা রয়েছে। মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও অন্যান্য রাজবংশের অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন এখানে যতেœর সঙ্গে সংরক্ষিত আছে। রয়েছে কালো পাথরে খোদাইকৃত দেব-দেবীর মূর্তি, ধ্যানমগ্ন বুদ্ধমূর্তি, নকশা করা ইট-পাথরের টুকরো ও মূল্যবান পাথরের অলংকার। আরও রয়েছে বিভিন্ন ধাতুর তৈরি অস্ত্র ও পাত্র, মুদ্রা ও স্মারক। মহাস্থানগড়ের পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রের দেখাও এখানেই মিলবে। জাদুঘরের প্রদর্শন কক্ষের বাইরে রয়েছে সুদৃশ্য বাগান। নানা রঙের ফুল ও ফল গাছের সমারোহ সেখানে। বাইরের চত্বরেও রাখা হয়েছে বেশকিছু প্রতœতাত্ত্বিক নমুনা।
জাদুঘরের সীমানার পূর্ব পাশে রয়েছে গোবিন্দ ভিটা নামে পরিচিত একটি প্রাচীন স্থাপনা। ধারণা করা হয়, এখানে একটি বিষ্ণু মন্দির ও প্রমোদ ভবন ছিল। গোবিন্দ ভিটার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে করতোয়া নদী। শোনা যায়, এই করতোয়া নদী এক সময় সুদূর ময়মনসিংহ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কালের আবর্তনে এখন শুধু থেকে গেছে শীর্ণ একটি জলধারা। শুধু বর্ষাকালেই এতে দুকূল উপচানো জলের ধারা দেখা যায়। গোবিন্দ ভিটার দক্ষিণে রয়েছে প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের নিজস্ব রেস্টহাউস। পূর্ব অনুমতি সাপেক্ষে এখানে থাকাও যাবে। মহাস্থানগড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তি। সবকিছু দেখে ফেলতে হলে হাতে সময় নিয়ে আসতে হবে। যেহেতু এখানে বৌদ্ধ, হিন্দুসহ আরও-আরও ধর্মের রাজত্বকাল অতিবাহিত হয়েছে তাই সব ধর্ম ও সমাজের আদি সংস্কৃতির নমুনাই এখানে একসঙ্গে পাওয়া যাবে।  এখানে আরও রয়েছে মৌর্য শাসনামলের নান্দাইল দিঘি, গুপ্ত আমলের ওঝা ধনন্তরীর বাড়ি, চাঁদ সদাগরের বাড়ি, বেহুলা-লখিন্দরের বাসরঘর, নরপতির ধাপসহ অসংখ্য প্রত্নস্থল।

যাতায়াত

ঢাকা থেকে খুব সহজেই সড়ক পথে বগুড়া যাওয়া যায়। রাজধানীর কল্যাণপুর, গাবতলী ও মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে প্রতি ৩০ মিনিট পর পর বাস ছাড়ে। সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা এবং ভাড়া পড়বে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ট্রেনেও বগুড়া আসা যায়। বগুড়া শহরের হাড্ডিপট্টি বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসে এবং দত্তবাড়ি থেকে টেম্পু অথবা সিএনজি বেবিতে চড়ে আধাঘণ্টার মধ্যেই পা রাখা যাবে মহাস্থানগড়ে।

থাকা-খাওয়া

মহাস্থানগড়ে রাতযাপনের জন্য ভালো কোনও হোটেল নেই। তাই থাকার জন্য বেছে নিতে পারেন বগুড়া শহরের হোটেলগুলো। সব ধরনের ও মানের থাকা-খাওয়ার জায়গা পাবেন এখানে। ২০০ থেকে ১০০০ টাকায় ভালো ব্যবস্থা হয়ে যাবে। বেছে নিতে পারেন থ্রি স্টার হোটেলও কিংবা পর্যটন মোটেল। খাবারের ব্যবস্থা আছে সবগুলোতেই।
তবে বগুড়া এলে এখানকার প্রসিদ্ধ দই, ক্ষিরসা ও মহাস্থানগড়ের কট্কটির স্বাদ নিতে ভুলবেন না।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com