ঢাকার সদরঘাট থেকে বিকেল সাড়ে ৫টায় ছেড়ে আসা ফারহান-৫ লঞ্চটি ভোলার ইলিশা বিশ্বরোডের মাথা লঞ্চঘাটে থামে রাত সাড়ে ১২টায়। ঘাটে মনপুরা-হাতিয়ার যাত্রীরা দলে দলে ভাগ হয়ে আছে। শীতে জবুথবু অবস্থা। চুলার পাশে দাঁড়িয়ে চা পানের ধুম। আমি যাব মনপুরা উপজেলার দখিনে। একটি পর্যটন স্পট! যার নাম দিয়েছে ‘মনপুরা দখিনা হাওয়া সী বিচ’ সম্পূর্ণ আনকোরা নতুন এক পর্যটন এলাকা।
আমি বলতে একা নই। আমার সঙ্গে আছেন আরও তিন সাংবাদিক আর তাঁদের ক্যামেরা সহযোগী। মোট ছয়জন। আরও চারজন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁরা শীত উপেক্ষা করে রাতের অভিযানে যাওয়ার সাহস করেননি। পরে তাঁরা তজুমদ্দিন থেকে স্পিডবোট দিয়ে এক দিন পরে সন্ধ্যায় পৌঁছান। আমরা যাচ্ছি ৪ ফেব্রুয়ারি।
আমাদের বসানো হলো ভিআইপি কেবিনের সামনের সোফায়। দৌলতখান বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল লঞ্চঘাটে নামলে খালি একটি কেবিন পাব, আশ্বাস দিলেন লঞ্চের সুপারভাইজার।
সুবহে সাদেকে লঞ্চ পৌঁছাল মনপুরার রামনেওয়াজ ঘাটে। মাটিতে পা দিতে চারদিকের মসজিদে ফজরের আজানের ধ্বনি কানে ভেসে আসে। মানুষের অবয়ব অস্পষ্ট। কালো কালো। আলোহীন। চিকন সড়কের ঘাটজুড়ে মোটরসাইকেল, সিএনজি আর ব্যাটারিচালিত রিকশার জট। এগুলোই মনপুরার প্রধান যানবাহন।
দিনের নির্ধারিত ভাড়া এই অন্ধকারাচ্ছন্ন ভোরে কাজে আসেনি। চালকের সঙ্গে দর-কষাকষি করে ভাড়া ঠিক করতে হলো। একটি ইজিবাইকে উপজেলা শহর হাজীরহাট যেতে হলো আমাদের। উঠব জেলা পরিষদের রেস্টহাউসে। এটি মনপুরার সবচেয়ে উন্নত রাত্রিযাপনের স্থান। মনপুরা উপজেলা পরিষদের আশপাশে এখন অনেক হোটেল হয়েছে। হয়েছে রেস্টুরেন্ট। মোটামুটি মানের, আপনি ইচ্ছা করলে রান্না করিয়ে খেতে পারেন।
ইতিহাস-ঐতিহ্যে ভরপুর এই মনপুরা দেখে মনে হবে, উপজেলাটি দিঘি আর সবুজে ঠাসা। সাগর মোহনায় ভোলার আগেই এই দ্বীপটি জেগে উঠেছে, যার বয়স প্রায় দেড় হাজার বছর। কিন্তু ভাঙনে সব ঐতিহ্য বিলীন! বর্তমানে এ দ্বীপের আয়তন ৩৭৩ বর্গ কিলোমিটার। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। চারদিকে মেঘনার জল, ম্যানগ্রোভ বনের চর। সবুজ রঙের হাতছানি। আছে বন্য প্রাণী হরিণ, বন্য মহিষ আর গরু-ভেড়া। অসংখ্য পাখি।
একসময় এখানে পর্তুগিজ দস্যুদের আস্তানা ছিল। তারা এনেছিল কেশরওয়ালা কুকুর। কপাল ভালো হলে দেখা মিলতেও পারে সেই কুকুরের বংশধর আর হরিণ। সর্বশেষ স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু মনপুরায় আসেন। এসে ভালো লেগে যায়। তিনি এখানে চিন্তা নিবাস গড়তে চেয়েছিলেন অবসর যাপনের জন্য। জমিও অধিগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুও নেই, অধিগৃহীত জমিও নেই। তারও আগে ১৯৪৮ আর ১৯৭০ সালে ভেসে গেছে ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে অগণিত মানুষ!
ব্যক্তিমালিকানা বনায়ন ছাড়াও বন বিভাগের বনায়ন আছে উপজেলাজুড়ে। মনপুরা, হাজীরহাট, পঁচাকোড়ালিয়া বিট, শ্বাসমূলীয় গাছের মধ্যে নারকেল-সুপারি, খেজুর, তেঁতুলও আছে। গাছে গাছে জলচর পাখি, আমাদের ভাড়া করা ইজিবাইক বোরাক ছুটছে, সবুজ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। কখনো ভাঙনে বনের আড়াল ভেঙে মেঘনা চলে আসে। খেজুরগাছে প্লাস্টিকের বোতল, রস ঝরছে ফোঁটা ফোঁটা। অটোরিকশার চালক জানালেন, মনপুরার খেজুর গুড়ে এখনো ভেজালের ছোঁয়া লাগেনি, এখানকার বাতাসের মতো।
দখিনা হাওয়া বিচের সন্ধান পেতে গিয়ে পুরো মনপুরা দেখা হয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলে মনপুরার পশ্চিমে সূর্য ডোবে, পূর্বে ওঠে ভোরে। ডিমের কুসুমের মতো সূর্যের উদয়াস্ত দেখতে পারেন কুয়াকাটার মতো। গোধূলিবেলায় মাটির প্রবেশপথ ধরে যখন বিচে পৌঁছালাম, তখন একটি পিকনিক পার্টির ট্রলার ছেড়ে গেল। দেখে মনে হলো, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে যা-ই হোক, এখানে এসে এক বিকেল কাটিয়ে দেওয়া যায়।
সম্মুখে সাগর মোহনায় বিশাল জলরাশি। তীর ঘেঁষে বন। বালিতে ঢাকা পদস্থল। এখানকার দক্ষিণ সাকুচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অলিউল্লাহ কাজল তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে পর্যটকদের বিশ্রামের জন্য বসিয়েছেন অসংখ্য ইজি চেয়ার। কুঁড়েঘর। ঘরে খরের ছাউনি, চতুর্মুখী জানালা। দুজনে বসার মতো গাছের গুঁড়ির চেয়ার। বনের গাছে বাঁধা হেমক (জালের দোলনা)। ঝাউ আর কেওড়াগাছের ছায়ায় হেমকে শুয়ে একচোট ঘুমিয়ে নিতে পারেন। রাত্রি যাপন করতে পারেন ট্রাভেল তাঁবু খাঁটিয়ে। সব ব্যবস্থাই আছে ফ্রিতে।
দিনে দিনে জনপ্রিয় হচ্ছে দুই বছর বয়সী এ সৈকত। পর্যটক আসছেন-যাচ্ছেন। জেলেরা নদীতে মাছ ধরছেন। লাল চেউয়া, সাদা চেউয়া, টাইগার চিংড়ি, পোয়া, ভেটকি, তাপসী, চুলের ডাঁটি, লইট্যা। আর ইলিশ তো আছেই। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ভেতরে জেলেপল্লি। জেলেনিরা মাঠের ভেতর শুকাতে দেন বাঁধা জালে ধরা মাছ।
আমি সৈকতে দাঁড়িয়ে, জোয়ারের জল উঠে পা ভিজে যায়। শিউরে উঠি! দক্ষিণের মুখে যত দূর চোখ যায় জল আর জল। পূর্বে বন, পশ্চিমে বন। সূর্য ডুবছে, ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যায় আপন আলয়ে। ভরে যায় মন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর মনপুরায় আরও একটি পর্যটন এলাকা যোগ হলো। শুধু একটাই কষ্ট, কোন সময়ে এ নয়নাভিরাম সবুজ, ভাঙনে শেষ হয়ে যায়!