শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০২:১৭ অপরাহ্ন
Uncategorized

মধ্য এশিয়ার ইসলামি স্থাপত্য ভুবনে

  • আপডেট সময় রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২১

সমাধিক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে রেজিস্তানের দিকে হাঁটতে থাকি। শুনেছি রেজিস্তানে আছে বেশ কিছু পুরোনো মাদ্রাসা ভবন। বলা চলে, সেগুলোই সমরখন্দ শহরের মূল আকর্ষণ। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে যায় বিশ্ববিদ্যালয়গামী একপাল ছেলে। হঠাৎ তাদের মধ্য থেকে দলছুট হয়ে একটি ছেলে আমার পাশে হাঁটতে থাকে। আমি প্রথমে ওকে খেয়াল করিনি। কারণ, চলার পথে আমি খুঁটিয়ে দেখছিলাম পাশের ভবনে আঁকা বিশাল ম্যুরাল। উজবেক পোশাক পরিহিতা তিনটি যুবতী মেয়ে দোতরা বাজাচ্ছে (দোতরাকে ওরা বলে দুতরা), মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পেখম গোটানো একটি ময়ূর। এমন একটি ম্যুরাল আমাদের দেশের কোনো বসতবাড়ির দেয়ালে আঁকলে সেটি হয়তো দিন কয়েকের মধ্যেই ঢেকে যেত ‘অমুক ভাইয়ের সালাম নিন’ পোস্টারে।

একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সেসব কথা ভাবার সময় লক্ষ্য করি, পাশাপাশি হেঁটে চলা ছেলেটি কিছু একটা বলতে চায়। সংকোচপূর্ণ কয়েক মুহূর্ত অতিবাহিত করার পর সে কিছুটা কুণ্ঠিত স্বরে বলল, ‘আমি কি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?’ বিদেশি লোক দেখলে তৃতীয় বিশ্বের বহু দেশেই কিছু মানুষ যেচে এসে আলাপ করতে চায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেই আলাপের পেছনে তাদের কিছু ফরিয়াদ থাকে। নিছক কৌতূহলও যে থাকে না, তেমন নয়। এই ছেলেটি সেই দুই প্রকারের মানুষের মধ্যে কোনটিতে পড়ে ভাবতে ভাবতেই সে ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ‘আমার নাম আনোয়ার নাজিরভ। তোমার?’ আমি নাম বলি। ‘তুমি কি ভারতীয়?’ বাংলাদেশের নাম বলাতে ছেলেটি মাথা নেড়ে জানায়, এমন দেশের নাম ও আগে শোনেনি। তারপর নিজ থেকেই বলে, কাছের এক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পড়ে। কিছুদিন হলো ইংরেজি শিখছে। তাই পথে-ঘাটে বিদেশি দেখলেই যেচে পড়ে আলাপ করে নিজের ইংরেজি জ্ঞান ঝালাই করে নেয়।

নাজিরভ আমাকে একেবারে রেজিস্তানের ময়দান পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যায়। বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে বলে, ‘সময় থাকলে বিকেলবেলা আবার এসো। খুব চমৎকার আলোর কারসাজি হয় এখানে।’ বলেই ও নির্দেশ করে ময়দানের সামনে উঁচু পাঁচিলে থাকা কয়েকটি বিশালাকৃতির আলোক প্রক্ষেপণ যন্ত্রের দিকে। করমর্দনের পালা শেষ করে আমি রেজিস্তানে চত্বরের ডান ধার ধরে এগিয়ে যাই। পিত দেশীয় একদল পর্যটকের গমনাগমনের পথরেখা দেখে অনুমান হয়, এদিক ধরে মূল কমপ্লেক্সে ঢুকতে হবে।

রেজিস্তান শব্দের মূল অর্থ বালুকাবেলা, অথবা হয়তো মরুভূমিও বলা যেতে পারে। যে সময়ে এই মাদ্রাসাগুলো গড়া হয়েছিল, সেই সময়ে এলাকাটি ছিল বালুকাময়। তার ওপর বেশ কায়দা-কসরত করে এই ইমারতগুলো নির্মাণ করা হয়। চত্বরের সামনের দিকটি উন্মুক্ত। তিন পাশে তিনটি বিশাল মাদ্রাসা ভবন। এগুলো অবশ্য একই সময়ে নির্মিত হয়নি। কিছুটা আগে-পরে হয়েছে। এই যেমন, একেবারে বাঁয়ের উলু বেগ মাদ্রাসা নির্মিত হয়েছিল সবচেয়ে আগে। সেই চতুর্দশ শতকে। তৈমুরের দৌহিত্র উলু বেগের সময়ে। বাকি দুটো নির্মিত হয়েছিল তারও প্রায় দুইশ বছর বাদে। সেই দুটোর মধ্যে ডান দিকেরটি, অর্থাৎ শের দোর মাদ্রাসায় পা রাখামাত্র এক সুতন্বী নারী আমার দিকে এগিয়ে আসে। পরনে ধবধবে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। রোদের কবল থেকে বাঁচার জন্য হাতে একটি ছাতা। গলায় ঝুলতে থাকা একটি আইডি কার্ড নির্দেশ করে জানায়, এ এলাকায় ও একজন তালিকাভুক্ত গাইড। নাম দিলনাজ। পুরো দিনের জন্য নানা স্থানে ও আমাকে নিয়ে ঘুরতে পারে। বিনিময়ে দিতে হবে ত্রিশ ডলার। প্রস্তাব মন্দ মনে হয় না আমার কাছে। কারণ, ইতিহাস আমি যতই জানি, স্থানীয় কেউ আশপাশে থাকলে রাস্তাঘাট চিনতে যেমন সহজ হয়, তেমনি সমকালীন সমাজের বহু কথা জেনে নেওয়া যায়। আমি প্রস্তাবে সায় দিয়ে বলি, ‘তোমাকে কি দিলনাজ বলেই ডাকতে হবে? নাকি ছোট করে দিল বললেই চলবে?’ আমার প্রশ্নের জবাবে দিলনাজ কেবল মৃদু হাসে।

গুর-এ-এমির

শের দোর মাদ্রাসা চত্বরে ঢোকার আগে দিলনাজ আমাকে নিয়ে মাদ্রাসার মূল প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়ায়। তারপর প্রকাণ্ড সেই ফটকের একেবারে চূড়ার কাছে মোজাইক করা কারুকাজের দিকে নির্দেশ করে বলে, ‘আচ্ছা, এই যে মোজাইকের ডিজাইন, এখানে কোনো বিশেষ কিছু কি লক্ষ্য করছ?’ ওর এই প্রশ্নে আমি ডিজাইনটি বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি। প্রথমত কথা হলো, এই মাদ্রাসা তো বটেই, সেই সঙ্গে পুরো উজবেকিস্তানেই তৈমুর জামানার স্থাপত্যকলায় জ্যামিতিক প্যাটার্নের সমুজ্জ্বল উপস্থিতি রয়েছে। সেই ছয়-সাতশ বছর আগে কী অদ্ভুত নিপুণতায় এগুলো স্থাপন করা হয়েছে, ভাবলে অবাক হতে হয়। যে প্যাটার্নগুলোতে আয়তক্ষেত্রের উপস্থিতি, সেখানকার সবগুলো চতুর্ভুজের আকার একই, একটুও কমবেশি নেই। যেন একেবারে স্কেল-কম্পাস ধরে মেপে নেওয়া।

আরও একটি ব্যাপার হলো, মোজাইকের রংগুলোতে প্রধানত তিনটি রঙের উপস্থিতি- সাদা, নীল ও সবুজ। এর পেছনে কারণ আছে। উজবেকদের কাছে নীল রং হলো শান্তির প্রতীক, সবুজ হলো জীবন-প্রকৃতি-বেহেশতের প্রতীক, আর সাদা হলো প্রিয় নবীজির প্রতীক। সে না হয় হলো, কিন্তু দিলনাজের সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমি খুঁজে পাই না। ওর কাছে শেষ অবধি পরাজয় স্বীকার করলে ও আমাকে ছাদের কোণের দিকে তাকাতে বলে। সেদিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ম দন্ত প্রদর্শনকারী দুটি ব্যাঘ্র শাবকের ম্যুরাল অবশ্য দেখতে পাই। শের দোর, অর্থাৎ বাঘের দরজা নামটি তাহলে এসেছে এই ছবির কারণে। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, হোটেল ম্যানেজারের কাছ থেকে টাকার বান্ডিল বুঝে নেওয়ার সময় খেয়াল করেছি, এদের দুইশ সোমের ব্যাংক নোটেও চিত্রিত আছে বাঘের ছবি। তখন সেটির গূঢ় কারণ বুঝিনি। এখানকার নকশায় কিন্তু শুধু সেই বাঘই নয়, আরও আছে প্রাণভয়ে পলায়নরত হরিণশাবক। আবার ওদিকে বাঘের পিঠে আঁকা হয়েছে উদীয়মান সূর্য। সূর্যের একেবারে পেটের ভেতরে মনুষের মুখ।

পরাবাস্তব নকশা

‘হুম, বাঘের ছবি দেখতে পাচ্ছি, সেটাই কি বিশেষ কিছু?’ দিলনাজের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করি। রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ও অবশ্য এর মধ্যেই ছাতা ফুটিয়ে নিয়েছে। ‘বাঘ দেখলে, আর বাঘের মাথার কেশরগুলো দেখলে না? বাঘের কেশর থাকে?’ দিলনাজের জবাবে আমার দৃষ্টির সীমাবদ্ধতা চকিতে ধরতে পারি। আরে, তাই তো, এ কেমন অদ্ভুত বাঘ! তবে কি এ কেবলই খেয়ালি স্থপতি কিংবা ম্যুরালশিল্পীর ভুল? ‘মোটেই তা নয়,’ দিলনাজ জবাব দেয়। তারপর সেই সূর্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে, ‘আসলে এখানে শিল্পী বাঘ কিংবা সিংহ আঁকার বদলে আঁকতে চেয়েছিলেন কোনো অতিপ্রাকৃত জন্তুর ছবি, যে জন্তুর অস্তিত্ব হয়তো আছে মননে, বাস্তবে নয়। কারণ, বাস্তব পৃথিবীর জন্তুর ছবি আঁকার ব্যাপারে ইসলামে যে নিষেধ আছে, সে কারণেই পালিয়ে যাওয়া যে হরিণটি দেখছ, খেয়াল করে দেখো, হরিণটি লোচনহীন; পরাবাস্তব।’

‘কিন্তু এই সূর্যের ভেতর থেকে তাকিয়ে থাকা ভ্রুকুঞ্চিত মানুষ?’ সে কথার জবাব না দিয়ে দিলনাজ এবার সেই ফটকের মাঝবরাবর স্থানটির কিছুটা নিচে একটি বিশেষ নকশার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলল, ‘এই নকশাটা দেখো। প্রথম নজরে এটা দেখে কী মনে হয়?’ অস্ফুট স্বরে আমি বলি, ‘স্বস্তিকা চিহ্ন’; যে চিহ্নটিকে ধরা হয় প্রগতি আর পুনর্জন্মের প্রতীক হিসেবে। তবে কথাটি বলার সঙ্গে বিস্ময়বোধ গ্রাস করে আমাকে। প্রাণীর অবয়ব, সূর্যের আলো ধারণকারী মনুষের মুখ, স্বস্তিকা চিহ্নের ছায়া- এসবই তো মাদ্রাসা নামক পীঠস্থানের সঙ্গে ঠিক সমাপতিত হয় না। কারণ, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুইয়ের অবস্থান যে একেবারেই দুই মেরুতে। আমার এই সন্দিগ্ধ মনোভাব আঁচ করে দিলনাজ বলে, ‘ভুলে যেও না, আমাদের এ অঞ্চল ইসলাম আগমনের পূর্বে জরথুস্তিয়ান ধর্মের উন্মেষ স্থল ছিল। ফলে কালান্তরে মানুষের ধর্ম পরিবর্তিত হলেও পূর্বপুরুষের আচরিত ধর্মের নানা সংস্কৃতি কিংবা ছায়া হয়তো মানুষের অজান্তেই এখানে-ওখানে রয়ে গিয়েছিল। এই যে ব্যাঘ্রচিত্র কিংবা স্বস্তিকা চিহ্নের উপস্থিতি, সে হয়তো ওই পূর্বতন ধর্মেরই কোনো না কোনো আবছায়া। ও হ্যাঁ, ভালো কথা, ওই চিহ্নটি দূর থেকে স্বস্তিকার মতো মনে হলেও খুব কাছে গিয়ে মোজাইকগুলো খুঁটিয়ে দেখলে দেখতে পাবে, ওখানে মূলত লেখা আছে নবীজি আর আল্লাহর আটটি নাম।’

ভবনে আঁকা বিশাল ম্যুরাল

শের দোর মাদ্রাসা নিয়ে এত আলোচনা করলেও দিলনাজ কিন্তু প্রথমেই আমাকে নিয়ে চলে উল্টো দিকের উলু বেগ মাদ্রাসাটির দিকে, অর্থাৎ যেটি কিনা নির্মিত হয়েছিল সর্বপ্রথমে। ভবনটি দেখে শের দোরের মতো মনে হলেও এই দুইয়ের মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। শের দোর নির্মাণের সময় ইচ্ছা করেই এর স্থপতি অবিকল আরেকটি উলু বেগ মাদ্রাসা ভবন বানাতে চাননি। এর পেছনে কারণ খুব সম্ভবত দুটি- যদি আগের কোনো ভবনের অনুকরণে হুবহু আরেকটি দালান তোলা হয়, তবে স্থপতির কোনো বাহবা পাওয়ার জায়গা থাকে না। লোকে বলে, এতে আবার ওর কৃতিত্ব কোথায়? যা সব কৃতিত্ব, সবই তো ওই মূল আদি ভবনের স্থপতির। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো, সেই সময় ধারণা ছিল, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারোর পক্ষেই সুচারুরূপে কোনো বস্তু বা নির্মাণের অনুকরণ করা সম্ভব নয়। নির্মাণশিল্পী তাই অনেক সময় ইচ্ছা করেই তার কাজে কিছু খুঁত রেখে দিতেন। প্যাঁচানো লতাপাতার মোজাইক আঁকার সময় ইচ্ছা করেই একপর্যায়ে সেই নকশায় সৃষ্টি করতেন অসামঞ্জস্য।

বিবি খানুম মসজিদ

লতাপাতার কথা যেহেতু এলো, তাই বলি, মধ্য এশিয়ার ইসলামি স্থাপত্য ভুবনে জ্যামিতিক রেখাভিত্তিক নকশা আর লতানো ফুলের আধিক্য প্রবল। জ্যামিতিক নকশাগুলো মূলত গড়ে উঠেছে ত্রিভুজ, বৃত্ত আর বর্গক্ষেত্রের যূথবদ্ধ পদচারণে। আর তার মাঝে মাঝে অজস্র বক্ররেখাভিত্তিক যে নকশাগুলো দেখা যায়, সেগুলো মূলত রাখা হয় সৃষ্টিকর্তার অসীম রূপটিকে মূর্ত করার জন্য। জীবন্ত প্রাণী আঁকার ক্ষেত্রে হাদিসে নানা বিধিনিষেধ থাকায় সেকালের মুসলিম স্থপতিরা ভবনের অঙ্গসজ্জা বৃদ্ধিকল্পে এই বিশেষ পদ্ধতি বেছে নিয়েছিলেন, যেটি পরে পরিচিতি পায় আরাবেস্ক স্থাপত্যরীতি হিসেবে। মধ্য এশিয়ার এই আরাবেস্ক ধারাকে পরে মোগলরা ভারতীয় উপমহাদেশে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল বলেই মোগলদের ভবনেও আমরা একই স্থাপত্যধারার উপস্থিতি দেখতে পাই। আগ্রা, দিল্লির মোগল স্থাপনা আগে দেখা থাকলে এখানে এসে তাই মনে হতে পারে- আরে! ঠিক এমন ভবন আগে কোথায় যেন দেখেছি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com