দেশের বাইরে কিংবা দেশের ভেতরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া সব ভ্রমণপিপাসুদের প্রধান উদ্দেশ্য ঝামেলাহীন ভ্রমণের স্বাদ পাওয়া। তবে দেশের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেকে শুরুতেই যে ভাবনায় পড়তে হয় তা হলো ভিসা প্রসেস এবং তার সঙ্গে যুক্ত থাকে হোটেল বুকিংসহ আরো অন্যান্য বিষয়। সব ভাবনার সমাধান একটি প্ল্যাটফর্মে না পাওয়ার কারণে অনেকের ভ্রমণ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা হয় না। তবে বর্তমানে ভ্রমণ খরচ, ভিসা পাওয়ার নিয়মকানুন ইত্যাদি তথ্য মেলে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে। তেমনি একটি ফেসবুকভিত্তিক ভ্রমণ বিষয়ক গ্রুপ ঘুড্ডি ট্রাভেল এইড বাংলাদেশ।
২০২৩ সালে এই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা মাছুমুল হক নিজের কানাডা ভিজিট ভিসা প্রসেস সময় তার ভ্রমণ সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট গাইডলাইনের অভাব অনুভব করেন। ইউটিউবে বাংলাভাষায় সহজে প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে জানার জন্য অনেক খোঁজ করেও কোনো পূর্ণাঙ্গ ভিডিও না পেয়ে অবশেষে তিনি নিজেই ঘুড্ডি ট্রাভেল এইড বাংলাদেশ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খোলার চিন্তা করেন। একই সময় তার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওগুলোর মাধ্যমে প্রচুর মানুষ ভিসা সংক্রান্ত সাহায্য পেতে শুরু করে। দিন দিন এত বেশি প্রশ্ন আসতে থাকে যে তিনি ব্যক্তিগতভাবে সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে সময়ের সংকটে পড়েন। এই বাস্তব চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে এবং মানুষের মধ্যে সহজে সহযোগিতা পৌঁছে দিতে তিনি ফেসবুকের এই গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে তিনি নিজে ছাড়াও অনেক ভ্রমণ অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিউনিটি গড়ে তোলেন।
গ্রুপটি প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল যাদের নিজেদের ভিসা প্রসেসে সহায়তা দরকার, তারা যেন সহজে তথ্য পেতে পারেন। ঘুড্ডি নামটি ব্যবহারের পিছনে রয়েছে মাছুমুলের শৈশব স্মৃতি। ঘুড্ডি অর্থাৎ ঘুড়ি তার জীবনে আনন্দের প্রতীক ছিল, যা তিনি এই গ্রুপের মাধ্যমে ভ্রমণকারীদের সাথে ভাগ করে নিতে চান। তিনি মনে করেন, ঘুড়ির মতোই মানুষও নিজের পথকে স্বাধীনভাবে উন্মুক্ত করতে চায় এবং তাই ট্রাভেল এইড বাংলাদেশ ট্যাগলাইনটি যুক্ত করে তাকে ভ্রমণ সহায়তা হিসেবে গড়ে তুলেছেন।
নতুন সদস্যদের গ্রহণ প্রক্রিয়া বেশ সতর্কতার সাথে পরিচালিত হয়। গ্রুপে যোগ দিতে হলে ফেসবুক প্রোফাইলটি অবশ্যই ব্যক্তিগত নামে হতে হবে এবং কোনো ভ্রমণ এজেন্সি বা প্রতিষ্ঠানের নামে অ্যাকাউন্টকে গ্রুপে অনুমতি দেয়া হয় না। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, তথ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে যেন কোনো ধরনের স্প্যামিং বা মিথ্যা প্রচারণা না ঘটে। গ্রুপের সমস্ত পোস্ট মডারেটর ও অ্যাডমিনদের দ্বারা যাচাই করা হয়। সদস্যদের পোস্টগুলো যাচাইবাছাইয়ের পরেই প্রকাশ করা হয়, যাতে করে কেউ ভুল তথ্য বা বিভ্রান্তিমূলক কিছু শেয়ার না করতে পারে।
ঘুড্ডি ট্রাভেল এইড বাংলাদেশ গ্রুপে ভিসা প্রসেস, ফ্লাইট বুকিং, এবং ভ্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে নানা তথ্য শেয়ার করা হয়। একজন ভ্রমণপ্রিয় ব্যক্তির প্রয়োজনীয় সকল তথ্য যাতে এক জায়গায় পাওয়া যায় তার জন্যে এই গ্রুপে আলাদা আলাদা মিডিয়া অ্যালবাম, ফাইল সেকশন ও পোস্টের মাধ্যমে তথ্য সাজানো হয়েছে। সদস্যরা কোনো দেশের নির্দিষ্ট ভিসা প্রসেসে যদি সাহায্য চান তবে আগেই ভ্রমণ করা ব্যক্তিদের থেকে সেই বিষয়ক উপদেশ ও তথ্য পেতে পারেন। গ্রুপে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাওয়া অভিজ্ঞ সদস্যরাও রয়েছেন যারা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে নতুন ভ্রমণকারীদের সাহায্য করতে আগ্রহী। এতে একজন নতুন ভ্রমণকারী খুব সহজে জানতে পারেন কিভাবে তার ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য জোগাড় করতে হয় এবং তার ভিসা প্রসেসিং থেকে শুরু করে ফ্লাইট টিকিট বুকিং পর্যন্ত কোন বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
ভ্রমণ তথ্য ছাড়াও, গ্রুপের সদস্যরা ওয়ার্ক ভিসা ও স্টুডেন্ট ভিসা নিয়েও নানা তথ্য জানতে পারেন। যারা কোনো দেশের স্টুডেন্ট ভিসা নিতে চান, তারা এই গ্রুপের সাহায্যে শিক্ষাগত যোগ্যতা, আবেদন প্রক্রিয়া এবং প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট সম্পর্কেও জানতে পারেন। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের ভিসা সঠিক ও জেনুইন কিনা তা বোঝার জন্য গ্রুপে নির্দিষ্ট কিছু গাইডলাইন শেয়ার করা হয়। এতে গ্রুপের সদস্যরা প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে পারেন।
ঘুড্ডি ট্রাভেল এইড বাংলাদেশ গ্রুপে সদস্যদের যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট আয়োজন করা হয়। এখন পর্যন্ত তিনটি গেটটুগেদার হয়েছে। দুটি ঢাকায়, একটি মালয়েশিয়ায়। এতে সদস্যরা একে অপরের সাথে সরাসরি যোগাযোগের সুযোগ পান এবং একে অপরের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেন। এছাড়াও প্রতি মাসেই গ্রুপে একটি ট্রাভেল ফটোগ্রাফি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ভ্রমণকারীরা তাদের তোলা ছবিগুলো শেয়ার করে পুরস্কার জিততে পারেন। ভবিষ্যতে গ্রুপটি ভ্রমণ বিষয়ে আর্টিকেল লেখার প্রতিযোগিতা আয়োজনের পরিকল্পনা করছে, যা সদস্যদের লেখার প্রতিভাকে বিকশিত করবে।
সদস্যরা গ্রুপে পোস্টের মাধ্যমে ভ্রমণ সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন করে থাকেন। অভিজ্ঞ ভ্রমণকারীরা তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন। তাছাড়া, গ্রুপের ফাইল সেকশনে ভিসা প্রসেসিং এবং অন্যান্য ভ্রমণ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টেশন রাখা আছে। প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা মিডিয়া অ্যালবাম রয়েছে, যেখানে ভ্রমণ সম্পর্কিত ছবি রাখা হয়েছে যা নতুন ভ্রমণকারীদের ধারণা দিতে সহায়তা করে।
গ্রুপে শেয়ার করা তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করতে অভিজ্ঞ ট্রাভেলারের রিয়েল লাইফ অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তথ্য শেয়ার করা হয়। যে-সব তথ্য এমবাসির গাইডলাইন অনুযায়ী হওয়া উচিত, সেগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারি ওয়েবসাইট থেকে যাচাই করা হয়। ফলে সদস্যরা সঠিক ও নির্ভরযোগ্য তথ্য পেয়ে থাকেন এবং বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
গ্রুপটি প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। ভবিষ্যতে ভ্রমণ সংক্রান্ত আর্টিকেল লেখার প্রতিযোগিতা আয়োজন, নিয়মিত টুররের আয়োজন ও স্পন্সর নিয়ে দেশভিত্তিক গেটটুগেদার আয়োজন করা এবং নতুন নতুন দেশ সম্পর্কে আরো বেশি তথ্য সংগ্রহ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই গ্রুপটি বাংলাদেশের ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অন্যতম সমর্থন দানকারী কমিউনিটি হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং তাদের জন্য ভবিষ্যতে আরো বেশি সেবা প্রদান করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।
ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তার জন্য গ্রুপের পক্ষ থেকে ভিসা স্ক্যাম এবং ভ্রমণ সংক্রান্ত অন্যান্য প্রতারণা থেকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা জারি করা হয়। এতে সদস্যরা প্রতারক এজেন্সির ধোঁকা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে সক্ষম হন। স্ক্যাম বা ফেক তথ্য পোস্ট করলে রিপোর্ট করা হয়, এবং রিপোর্টকৃত বিষয়টি এডমিন ও মডারেটররা যাচাই-বাছাই করে যথাযথ ব্যবস্থা নেন।
ঘুড্ডি ট্রাভেল এইড বাংলাদেশ আজ বাংলাদেশের ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য একটি বিশ্বস্ত ও সহায়ক প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পরিচিত। গ্রুপটি তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা, তথ্য সংগ্রহ এবং নানা অভিজ্ঞতা আদান-প্রদানে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। সদস্যরা এখানে তাদের প্রশ্নের উত্তর, ভ্রমণ পরিকল্পনা ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করে নিজেদের আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সক্ষম হন। এতে একদিকে ভ্রমণকারীদের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে সঠিক ও ভেরিফাইড তথ্য প্রাপ্তির সুযোগও বেড়ে যাচ্ছে।
এমন একটি প্ল্যাটফর্মের জন্য এটি শুধু একটি গ্রুপ নয়, বরং একটি নিরাপদ ও সাহায্যকারী ভ্রমণ কমিউনিটি। ঘুড্ডি ট্রাভেল এইড বাংলাদেশের মাধ্যমে ভ্রমণপ্রেমীরা শুধু নিজেদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা বৃদ্ধি করছেন না, বরং তারা একটি সুসংহত ও সংহত কমিউনিটির অংশ হিসেবে ভ্রমণকে আরো উপভোগ্য করে তুলছেন।