শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩১ অপরাহ্ন

ভেনিস নামের ডিজ়নিল্যান্ড

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৪

মিলানে পিয়ার্সারে সেচ্চির বাড়িতে তখন আতিথ্য গ্রহণ করেছি সপ্তাহের দেড়েকের জন্যে। পাস্তা-পিৎজায় মাখামাখি খাঁটি ইতালিয় জীবনশৈলীর আস্বাদ নিচ্ছি চেটেপুটে। মিলান থেকে ভেনিস খুব দূরে নয়, ট্রেনে মাত্র ঘন্টাতিনেকের পথ। প্ল্যান করে ফেললাম একদিন ভেনিস যাবার। মিলানের সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে সক্কাল সক্কাল উঠে পড়লাম ভেনিসের ট্রেনে। আমার সহযাত্রীদের অনেকেই ভেনিসের টুরিষ্ট, আমারই মত। এদের মধ্যে অনেকেই অবশ্য আজ রাত্রিযাপন করবেন ভেনিসের কোন না কোন হোটেলে। আমি কিন্তু ভেনিসের ক্ষণিকের অতিথি, ভেনিসকে বিদায় জানাব আজ সন্ধ্যাতেই।

ভেনিসই খুব সম্ভবত প্রথম বিদেশী শহর যার নাম আমি ছোটবেলায় শুনেছিলাম। ছেলেবেলায় আমার একটা বই ছিল, ‘মার্চেন্ট অব ভেনিস’-এর খুব দুর্বল বাংলা অনুবাদ সেটা। কিন্তু অ্যান্টোনিও, ব্যাসানিও, শাইলক, পোর্সিয়া আর ভেনিস ত’ আমার সেই ছেলেবেলার দিনগুলোর সাথে একাকার হয়ে আছে। আর এক ভেনিসিয়ান মার্কো পোলো তার জীবনের সোনার সময়টা কাটিয়ে গেলেন সুদূর চিন দেশে। সম্রাট কুবলাই খানের রাজত্বে। ভেনিস তাই বোধ করি এক অন্য ধরণের উত্তেজনা জড়ানো শহর। ডেভিড দেখতে ফ্লোরেন্স যাবার পথে কিংবা ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার রাস্তায় ত’ এমন উত্তেজনা বোধ করি নি।

এসে পৌঁছলাম ভেনিসের সান্তা লুসিয়া ট্রেন স্টেশনে। ট্রেন থেকে দলে দলে টুরিষ্ট নেমে এল বন্দর শহরে। আমিও তাদের একজন। এক উজ্জ্বল ইতিহাসের ছড়ানো ভাঙা মৃৎপাত্রের টুকরোর মধ্যে যেন প্রবেশ করছি আমি। তরবারি হাতে ডানাওয়ালা সেন্ট মার্কের সিংহ ভেনিসের সেই উজ্জ্বল ইতিহাসের, সেই সমৃদ্ধির সাক্ষী। অন্ততঃ হাজার বছরের সে ইতিহাস এক গৌরবময় অতীতের গাঁথাচিত্র। ভেনিস বন্দর শহর। স্বাভাবিক কারণেই নৌশক্তিতে দুর্বার ভেনিস সাম্রাজ্য তার প্রভাব এবং বাণিজ্য বিস্তার করেছে ইউরোপ ছাড়িয়ে এশিয়াতে, দূর মঙ্গোলিয়াতেও। শিল্প-সংস্কৃতিতেও সমৃদ্ধির শিখরে উঠেছিল ভেনিস। ভেনিস সাম্রাজ্যের শক্তির আস্ফালন ঘটেছে একের পর এক ক্রুসেডের লড়াইতে, আর পোপতন্ত্রের সঙ্গে নিয়ত সংঘাতের মধ্যে। ভয়ঙ্কর নির্লিপ্ত ইতিহাস, গভীর নির্লিপ্তি সভ্যতার, ত্রুটি ঘটলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ হয় বিনাশে। সেদিনের মহাগৌরবময় সাম্রাজ্য আজ টুরিষ্টদের দাক্ষিণ্যে দিনাতিপাত করে চলেছে।

ভেনিস ‘ফ্লোটিং সিটি’। জল আর জল। একূল অকূল ভাসিয়ে দেওয়া। ভেনিস ‘সিটি অব ক্যানালস’। ক্যানালগুলিই এ শহরের প্রাণের চাবিকাঠি। তাই শহরটাকে কেউ বা বলেন, ‘সিটি অব ওয়াটার’। শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে ক্যানালগুলো। স্বচ্ছ, স্থির জল। শহরের গায়ে যেন শিরা আর ধমনীর চালচিত্র। আর পাঁচটা শহরের থেকে ভীষণ আলাদা। কিন্তু দারুণ মিল আমষ্টারডামের সঙ্গে। খানিকটা ‘এস’-এর মত দেখতে গ্র্যান্ড ক্যানাল-টা। তাতে রয়েছে ওয়াটার ট্যাক্সি আর ওয়াটার বাস, পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন হিসেবে। আর রয়েছে ট্রাডিশনাল রোয়িং বোট গন্ডোলা, টুরিষ্টের বিনোদন আর পয়সা খসানোর জন্য। কয়েক শতাব্দী ধরে এই গন্ডোলাই নাকি ছিল ভেনিসবাসীর যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম। মার্ক টোয়েনের ‘দ্য ইনোসেন্টস অ্যাব্রড’ শীর্ষক বইটিতে রয়েছে গন্ডোলার আর গন্ডোলা-চালকদের জীবনযাত্রার চমৎকার বর্ণনা। গ্র্যান্ড ক্যানাল বয়ে খানিক গন্ডোলায় না চড়লে ত’ ভেনিস ভ্রমণই বৃথা।

ভেনিসের রাস্তায়-ঘাটে আনাচে-কানাচে উদ্দেশ্যহীন আমি ঘুরে বেড়াই সমস্তটা দিন ধরে। আসলে আমি এই শহরের সুরটাকে ধরতে চাই, বাজাতে চাই আমার হৃদয়তন্ত্রীতে। মাঝে এখানে-ওখানে দাঁড়িয়ে পড়ে দু-একবার কফি কিংবা আইসক্রিম, দু-চারটে ছবি তোলা। মাত্র কয়েক ঘণ্টাই আমার বরাদ্দ ভেনিসের জন্যে। তার মধ্য থেকে লাঞ্চ করার সময়টুকুও বাজে খরচ করা যাবে না।

ক্যানালের উপরে অনেক ছোট ছোট সেতু। ফোসকারি সেতু, সান্তা মার্গারিটা সেতু। এদের মধ্যে ‘রিয়্যালটো ব্রিজ’ যে প্রধানতম বা সবচাইতে বিখ্যাত তা আগে না জানলেও এখানে টুরিষ্টের ভিড় আর ছবি তোলার ধূম দেখে বুঝে ফেলতে কোন কষ্ট হবার কথা নয়।

ভেনিস জগৎবিখ্যাত তার কার্নিভ্যাল আর মুখোসের জন্য। ভেনিস ‘সিটি অব মাস্কস’। টম ক্রুজ আর নিকোল কিডম্যান অভিনীত স্ট্যানলি কুব্রিকের ‘আইজ ওয়াইড শাট’ ছবিটিতে রয়েছে এই মুখোসের প্রদর্শণী। এটা অবশ্য কার্নিভ্যালের সিজন নয়। তা হলেও শহরের অলিতে-গলিতে হরেক রকমের সেই মুখোস আর গন্ডোলার মডেলের শতেক বিপণী। এর কিছু কিনে না নিয়ে গেলে টুরিষ্টের ভেনিস ভ্রমণে মস্ত বড় ফাঁক থেকে যাবে।

আমি ঘুরে চলেছি উদ্দেশ্যহীনভাবে। এটাই সেন্ট মার্ক স্কোয়ার, ভেনিসের প্রাণকেন্দ্র। এখনকার ওই হোটেলগুলো অসম্ভব এক্সপেন্সিভ। ঢুকলাম পাশের সেন্ট মার্ক ব্যাসিলিকায়। ব্যাসিলিকার তেজীয়ান উদ্যত ব্রোঞ্জের এই চারটে অশ্বমূর্তী ভেনিস প্রজাতন্ত্রের গৌরবোজ্জ্বল প্রাধান্যের দিনগুলিকে স্মরণ করায়। এই ঘোড়ার মূর্তীগুলোকে কনস্ট্যান্টিনোপল থেকে লুট করে আনা হয়েছিল আটশ’ বছর আগে। শেক্সপীয়ারের আর এক অমর সৃষ্টি ‘ওথেলো’ এই ভেনিস আর টার্কির মধ্যে যুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা নয়?

লুইজি বারজিনি নাকি দ্বিধাহীনভাবে ভেনিসকে মানুষের তৈরী সুন্দরতম শহররূপে বর্ণনা করেছেন। সেরকম বাঁধনছাড়া ভাল লাগার অনুভূতি না হলেও, ভেনিসকে আমি যে বেশ উপভোগ করছি তা বলাই বাহুল্য। সেন্ট মার্ক স্কোয়ারের গায়ে একটা কফি শপে বসে পড়লাম। ইউরোপকে বুঝতে গেলে বিভিন্ন শহরের স্কোয়ারগুলিতে কফি শপে বসে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে। আর দেখতে হয় স্কোয়ারে আর তার আশেপাশের বিপিনিগুলিতে ছেলে-বুড়োর আনাগোনা আর হই-হট্টগোল। তেমনটাই আমি করে থাকি সর্বত্র। তেমন করেই উপলব্ধি করবার চেষ্টা করে চলেছি ‘আড্রিয়াটিকের রাণি’ এই শহরকে। দেশ-বিদেশের অজস্র ভ্রমণার্থীর ভিড় আর কত না অজানা ভাষার কলরব। উজ্জ্বল এক ঝাঁক পায়রা চড়ে বেড়াচ্ছে, টিপিক্যাল ইউরোপের স্কোয়ারগুলোর মতই। স্কোয়ারের একধারে দু’তিনজন তরুণ প্যালেট আর ক্যানভাস নিয়ে জগৎ ভুলেছে। তাদের মধ্যে আমি টিনটরেটোকে খুঁজ বেড়াচ্ছি, হয়ত’ জায়গাটা ভেনিস বলেই। ধূমায়িত কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ভাববার চেষ্টা করলাম ব্যাসানিও আর পোর্সিয়াকে, এই পরিবেশের প্রেক্ষিতে।

পরদিন রাতে পিয়ার্সারে সেচ্চির বাড়িতে ডিনারে বসে ভেনিস নিয়ে জমাটি গল্প আর আড্ডা। আমার ভেনিসের দিনটার ধারাবিবরণী ওরা বড় আবেগ দিয়ে শুনল। এমনকি কোথায় কোথায় দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেয়েছি তাও। আসলে ভেনিস ওদের মহা পছন্দের জায়গা, পিয়ার্সারে আর এলিনা তাদের হানিমুন করেছিল ভেনিসে। ভেনিস সম্পর্কে পিয়ার্সারের এক অদ্ভুত গভীর সমবেদনা। ওর ভাষায় আর অভিব্যক্তিতে ভেনিস যেন এক বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি। ভেনিসের কথা ভাবলেই ওর মনে এক গভীর মেলানকলি কাজ করে। হিসেবের খাতায় কোন এক গড়মিলের জন্যই হয়ত’ বা এককালে গৌরবের অভ্রভেদী শিখরে ওঠা ভেনিসের গরিমা আজ ধুলোয় গড়াগড়ি যায়।

অতীতের মহাসাম্রাজ্য আজ যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক জীবন্ত মিউজিয়াম মাত্র। কিন্তু সেখানেই যেন শেষ নয় তার দুর্দশার। প্রতিদিন সকালে সেজেগুজে ভেনিস তৈরী হয় সকালের ট্রেনে আসা শত শত টুরিষ্টের জন্য, পসরা সাজিয়ে, যাদের খাইয়ে, হোটেলে আপ্যায়ন করে, সুভেনির বেচে, টুরিষ্ট স্পটের টিকিট এবং সার্ভিস বিক্রি করে আর গন্ডোলায় চড়িয়েই মূলতঃ  ভেনিসের দিনযাপন। এই টুরিষ্ট আসা বন্ধ হলে অতীতের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা এ বন্দর শহরের জীবনের চাকাও যাবে থেমে। এ যেন এক বারবণিতার জীবনচিত্রণ। পিয়ার্সারে যেন দেখতে পায়, কোন এক ভবিষ্যতে, হয়ত’ বিশ বা পঞ্চাশ বছর পরে, ভেনিস হয়ে উঠবে আর এক ডিজনীল্যান্ড। টুরিষ্ট সেখানে ডিজনীল্যান্ডের মতই ফান প্যাকেজ কিনে ঢুকবে, মজা করবে, প্যাকেজ শেষে উদ্দামতার ক্লান্তি নিয়ে ফিরে যাবে ঘরে। উত্তুঙ্গ ভেনিসের অবক্ষয়ের চিত্রণ হবে সম্পূর্ণ। বলতে বলতে পিয়ার্সারেও এক বিষণ্নতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com