রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৯ অপরাহ্ন

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৩

নান্দনিক সৌন্দর্যের ঐতিহাসিক এক নগরী হলো ইতালির ভেনিস। বলা যায়, ইউরোপের সবচেয়ে রোমান্টিক শহর এটি। ভেনিস ভেনেতো অঞ্চলে আড্রিয়াটিক সাগরের ওপর অবস্থিত একটি প্রধান বন্দর এবং একটি জনপ্রিয় ও আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র।

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস

মিলান-লোমবার্ডিয়া রাস্তার পাশে ফুটে আছে রক্তাক্ত পপি। গত বছর মে মাসেও ফুটেছিল। গতবার দেখেছিলাম চর্মচক্ষে। এ বছর খবর পাই ক্ষুদে বার্তায়। পলাশ পাঠায় পপির খবর। সেদিন আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ছিল দুপুর থেকে বৃষ্টির সংকেত। তাই বলে সকালটা মোটেও গোমড়া ছিল না। বরং রোদ জ্বলজ্বল হাসিখুশি একটা দিন।

ছোট মফস্বলীয় একটি স্টেশন থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের যাত্রা ভেনিসের মূল স্টেশন ভেনিস সান্তা লুগিয়ায়। ট্রেনে ওঠার পর প্রথম প্রথম সাধারণ দৃশ্যমালা। ছোট ছোট কটেজ বাড়ি, আঙ্গুর ক্ষেত, রেল লাইনের দুই পাশে পপি আর গোলাপের সারি। ঝকঝকে নীল আকাশ। এ রকমই ছিল প্রায় পুরোটা পথ।

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস

হঠাৎই রাস্তার দু’পাশে দৃশ্যগুলো বদলে যায়। বছর দশেক আগে ঢাকা থেকে সাভার যাওয়ার পথে যেমন দেখা যেত তেমনি দিগন্তবিস্তৃত পানি আর মাঝমধ্যে উঁকি দেয়া কিছু বাড়িঘর। সারা বছরই যেন বন্যা। হুবহু প্রায় সে রকম এলাকা। বিস্তীর্ণ জলাজমি, সমুদ্রের অংশ। একটা কেমন যেন সমুদ্রের ঘ্রাণও পাই। অনেক বড় একটা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক ব্রিজ পার হয় আমাদের ট্রেন।

পাশ দিয়ে বিলাসবহুল বাস। ব্রিজ পেরোতেই ভেনিসের মূল স্টেশন। আগের দিন রাতে এসে পৌঁছেছি ভেনিস মেস্ত্রেতে। জুরিখ থেকে মিলান হয়ে মেস্ত্রে। কবেকার কোন কৈশোরের কোনো এক গোলাপি রঙা শ্রাবণী বিকেল থেকে আমার ধ্যানে-জ্ঞানে ইতালি। ছোটবেলার বন্ধুরা পর্যন্ত জানে আমার ইতালি প্রীতির কথা।

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস

স্বপ্নের সেই ইতালিতে আগের দিন সন্ধ্যাযাত্রায় তেমনটা চোখে পড়েনি কিছু। আজ সকালে তাই দুই চোখ মেলে যতটা দেখে নেওয়া যায়। রেলগাড়ির ঘষা কাঁচ, স্টেশনে বিখ্যাত ফুটবলার মালদিনির মত চেহারার ফিটফাট পুলিশ। কিছুই নজর এড়ায় না। চোখ খোঁজে পনিটেলের ব্যাজ্জিও। সুন্দর মানুষ, সুন্দর প্রকৃতির ভুবনে ভেনিস আমাদের প্রথম গন্তব্য। সঙ্গি পলাশ ভাই।

ভেনিস, সারা বিশ্বের মানুষের পরম আগ্রহের শহর হলেও পলাশ ভাইর কাছে নিতান্তই অফিস-বাড়ি। আমার কাছে শেকস্পিয়ারের ভেনিস, পোর্শিয়া আন্তনিও বা শাইলকের ভেনিস আর দূর সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে বাণিজ্যে যাওয়া সওদাগরের শহর ভেনিস। ভেনিস নিয়ে অনেক শুনেছি। করেছি অনেক কল্পনা। স্বপ্নের এই শহরে মানুষ কীভাবে থাকে, কীভাবে হাঁটে, কীভাবে চলে, কোনোমতেই মাথায় ঢুকত না।

পানির মধ্যে একটা শহর! সেই শহরের মূল স্টেশন থেকে বাইরে আসতেই দেখি লোকে লোকারণ্য। কোথায় শাইলক, কোথায় পোর্শিয়া? বেশিরভাগই তো দেখি আমার বাংলাদেশের ভাই-ব্রাদার। আমাদের পুরনো ঢাকা যেমন ৫২ গলি ৫৩ বাজারের শহর। ভেনিসও প্রায় তা-ই। অলিগলি, দোকান, বাজার আর পুরনো আদি অকৃত্রিম ছাঁচে যত্নের সাথে রেখে দেয়া গায়ে গা লাগানো বাড়িঘর। আর একটা-দু’টো সারি বাড়ির পরই কাকচক্ষু জলের খাল।

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস

সমুদ্র থেকে সরাসরি এসে ভেনিস শহর এফোঁড়-ওফোঁড় করে মিলেছে আবার সমুদ্রে। এ রকম কয়েকশো খাল বা ক্রিকের ফাঁকে ফাঁকেই গড়ে উঠেছে কিংবদন্তির ভেনিস। সেই ভেনিসের পথঘাট, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় পুরোটাতেই বাঙালির প্রাধান্য। রাস্তার ধারে রং-বেরঙের ফলের দোকান বা ভাসমান মুখোশের টং, জমজমাট ওয়ান স্টপ পিৎজা শপ থেকে বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্ট, সবখানেই বাঙালির পদচারণা।

এক ঝলক ভেনিস দেখায় মনে হয় এখানে দুই রকম মানুষ। এক রকম বাঙালি আরেক রকম টুরিস্ট। সারা বিশ্ব থেকে টুরিস্ট আসে ভেনিস দেখতে আর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী মানুষ ভেনিস দেখায়। আমরাও সেদিন ভেনিস দেখি।
সকাল থেকে গা ভাসানো মিষ্টি রোদ, দুপুরের পর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। রোদ বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে পার হয়ে যাই গলির পর গলি, তস্য গলি। ছোট্ট ছোট্ট পুল। কোন কোনটা তো ৪০০ বছরের পুরনো। খালের ধারে গাছের নিচে অনেকটা জায়গা রেখে একটা পিৎজার দোকান। মালিক দুই বাংলাদেশি ভাই। প্রমাণ সাইজ রিয়েল ইতালিয়ান পিৎজায় সারা হল দুপুরের খাবার।

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস

বিকেলের আগে এসে পৌঁছনো একটা খোলা চত্বরে। পিয়াৎসা সান্তা মার্কো বা সেন্ট মার্কস স্কয়ার। চারদিকে অনেক পুরনো অভিজাত প্রাসাদের মত দেখতে বাড়িঘর। একটু দূরে একটা বনেদি গির্জা। পুরো চত্বর ছুটি কাটানো মানুষের হই-হট্টগোলে মুখর। এর থেকে কিছুটা দূরে এগিয়ে গেলেই সমুদ্র, উদার। ঘাটে বাঁধা একেকটা গন্ডোলা একাই দোলে ঢেউয়ের তালে।

মাঝ দরিয়ার ভেতর কিছু একলা বসতবাড়ি। কি জানি কে থাকে, কারা থাকে দূরে পানির ভেতর ওইসব ঘরে। আকাশ থেকে পানি পড়ে, পায়ের নিচে পানি, নিঃসঙ্গ ওই বসতি দেখে আমার চোখেও পানি।

ভেনিস মেস্ত্রেতে আমাদের তিন দিনের অবস্থানে আমি সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি মানুষের নিঃসঙ্গতা। মাইলের পর মাইল লোক নাই, জন নাই। হঠাৎ পথের ধারে একলা একটা রেস্টুরেন্ট। মনে হয় কোন সুদূর থেকে হঠাৎ মাথা তুলে বের হয়েছে। উঠোনজুড়ে ঝরাপাতার দল। এক বিকেলে ওখানটায় গিয়ে আরেকবার মোচড় দেয় ভেতরটা।

অদ্ভুত গাঢ় সবুজ রঙের ধান আর গমের ক্ষেত প্রায় পুরোটা মেস্ত্রে জুড়েই। বরফ গলার পর থেকে আবার বরফ পড়া পর্যন্ত যেটুকু সময় পাওয়া যায় তার মধ্যে তিনটা ফসল উঠবে। ধানগাছ বা গমগাছ তাই সময় পায় খুব কম। চোখের সামনে ধেই ধেই করে বড় হয়ে ওঠে। এই রকম একটা দিগন্তজোড়া ধানের ক্ষেতের কাছে, কুয়ার্তো ডি আলতিনো নামে ছোট্ট একটা রেল স্টেশনের পাশে হাতে গোনা কয়েকটা ভিলা নিয়ে একটা লোকালয়। প্রায় সবগুলো বাড়িই খালি থাকে বেশি সময়। বেশিরভাগই শহুরে লোকের ছুটি কাটানোর ঠিকানা।

ভেনিস; জলে ভাসা মায়াবী নগরী
ভেনিস

এই স্বপ্নের শহর ভেনিস সম্পর্কে প্রবাসী মেজবাউদ্দিন জানান, ভেনিসে এবার পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি। মূলত ভেনিসের আয় দিয়ে অঞ্চলটির খরচ মেটানো হয়। পৃথিবীর সকল দেশ থেকে শহরটি দেখতে আসেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। সানমার্কো ঘুরতে ঘুরতে দেখা মেলে লিমা চৌধুরী নামের এক বাংলাদেশির। লিমা জানান, তিনি এই ভেনিস দেখার জন্যই ঢাকা থেকে এসেছেন। বলেন, ভেনিস না এলে চোখ জুড়ানো এ সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিত হতাম। সুযোগ পেলে রোমেও যাবেন তিনি।

ভেনিসের ইতিহাস বলে, জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য এখানে প্রবাসীরা বসতি গড়ে তোলে। পরে লোক সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং পানির ওপর গড়ে উঠে এ শহর। সবশেষ জরিপ অনুযায়ী ভেনিসের লোকসংখ্যা ২ লাখ ৬৫ হাজার। এখানে বিভিন্ন ধরনের রেস্টুরেন্ট এবং নানা ধরনের স্যুভেনিরের দোকানগুলো আকর্ষণ করে পর্যটকদের।

লেখক ইসমাইল হোসেন স্বপন- ইতালি প্রবাসি

 

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com