শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৫ পূর্বাহ্ন

ভূস্বর্গ কাশ্মিরের ডাল লেক

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৩

গৌতম বুদ্ধ গৃহত্যাগী হয়েছিলেন এক ধবল পুর্নিমা রাতে। জগত সংসার তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়েছিল। কাশ্মীর ভ্রমনের উদ্দ্যেশে আমরা পাঁচ সদস্যের স্বজন দল ২০১৮ র সেপ্টেম্বরের ২২ তারিখ দেশ ত্যাগ করি এমনই এক পুর্নিমা রাতে। আকাশপথে দিল্লী হয়ে দীর্ঘ ভ্রমন শেষে এক অপরাহ্নে কাস্মীরের দ্বিতীয় রাজধানী শ্রীনগর এসে পৌঁছি ।

এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়েই মিষ্টি রোদের অভ্যর্থনা পাই । রুপসী শ্রীনগরের ঝকঝকে আকাশ, না শীত না গরম আবহাওয়া ক্লান্তি দূর করে দেয় । আমাদের জন্য অপেক্ষমান মাইক্রোবাসের ড্রাইভার মধ্যবয়সি সুদর্শন আরেফিন অভ্যর্থনা জানালো হাসি মুখে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী আজ আমাদের  শ্রীনগরের কেন্দ্রস্থলে শহুরে হ্রদ ডাল লেকের হাউজ বোটে প্রথম রাত্রি যাপনের কথা। দুপুর প্রায় গড়িয়ে গেছে। সবাই আমরা ভীষণ ক্ষুধার্ত। খাবার হোটেলের সন্ধানে রওয়ানা হলাম।

সবুজ গাছপালা, পাহাড় ঘেরা শান্ত পরিস্কার শহর শ্রীনগর। পথের দুই পাশে সফেদি চিনার গাছের সারি। ফাঁকেফাঁকে নানান রঙের সাধারন চার পাঁচতলা বাড়ি। ছোট মাঝারী দোকান সার বেঁধে। রাস্তায় লোক চলাচল কম। ভারতীয়  আর্মিদের গাড়ি ও বন্দুক হাতে টহল চোখে পরে অহরহ । কেমন একটা গা ছমছমে ভাব!

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য ভূস্বর্গ নামে খ্যাত প্রায় পঁচাশি হাজার বর্গমাইলের পাহাড় ঘেরা এই দেশটির জনসংখ্যা মাত্র এক কোটি পঁচিশ হাজারের মতন। জনসংখ্যার শতকরা  ৯৮%  ভাগই মুসলমান। এদের ভাষা কাশ্মিরী বা কাশুর।

ডাল লেক পাড়ে প্রচুর হোটেল গড়ে উঠেছে । বেশ পরিস্কার ও ভাল মানের একটা হোটেলে আমরা তৃপ্তি করে ভাত, সবজি, মাংস খেলাম। পরিবেশনা, খাবারের স্বাদ সবকিছুতেই এদের রুচি ও আভিজাত্যের ছাপ দেখলাম।

ডাল লেককে বলা হয় ” শ্রীনগরের রত্ন ‘। ডাল লেকের বুকে আছে মৎস সম্পদের ভান্ডার।  আমরা খাওয়া শেষে ঘাটে এলাম। এখান থেকেই নৌকা করে অন্য প্রান্তে ভাসমান হাউজবোটে যেতে হবে।

আকর্ষনীয় এই  ডাল লেকের দৈর্ঘ্য প্রায় ৭ কিঃমিঃ, প্রস্থে ৩ কিঃমিঃ ও গভীরতায় সাড়ে ৪ ফুট। লাকুতিডাল, বড়াডাল, গাগরিডাল এই তিনের সমন্বয়ে এই শ্রীনগরের ডাল লেক। ঝিলাম নদীর কিছু অংশ ডাল লেকে মিশেছে। পাহাড় ও সবুজ ঘেরা এ শহুরে হ্রদকে নাগিন লেকও বলা হয়। শীতকালে বরফে ঢাকা থাকে।

জীবনে প্রথম দেখা হাউজবোট আমাদের সবার কাছে ছিল বিস্ময়! বোট বা নৌকা হলেও এগুলো চলাচল করে না, পানিতে স্থির ভাসমান থাকে। এইরকম কয়েকশো হাউজবোট ডাল লেকে আছে। এগুলো পুরোটাই দামি কাঠের তৈরী। একে বোট বা নৌকা না বলে আলিসান রাজপ্রাসাদ বলা চলে। প্রতিটা হাউজবোটে বিশাল ড্রইং, ডাইনিং, এটাচড বাথ সহ শোবার ঘর আছে। ঘরের সাথে আছে লাগোয়া বারান্দা, ছাদ বাগান। জানালা দরজায় ঝুলছে পশমিনা পর্দা। সিলিঙে বিশাল ঝাড়বাতি। মান ও সৌন্দর্য ভেদে প্রতি রাতে হাউজবোটের ভাড়া ৮৫০- ২৮০০০ রুপি পর্যন্ত। কাশ্মীরে পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন হলো এই হাউজবোট। একরাত এখানে না কাটালে কাশ্মির ভ্রমন অসম্পুর্ণ থেকে যায়।

আমরা যে যার ঘরে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে লেকমুখি  বারান্দায় এসে গদির মোড়ায় আরাম করে বসি।
তখন সবে  সন্ধ্যা। আবছা আলোয় ডাল লেকের বিস্তৃত জলরাশি চিকচিক করছে। তাকিয়ে দেখি আকাশ জুড়ে মস্ত চাঁদ। আজ কোজাগরি পূর্ণিমা। চন্দন জোছনায় ধুয়ে যাচ্ছে চারিদিক। নিস্তব্ধতা ভেংগে কখনো ঝটকা বাতাস মৃদু দোল দিচ্ছে বোটটিকে। জল আয়নায় কাঁপছে পূর্ণ চাঁদ। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা হাইজবোট গুলি থেকে ছোট বড় আলোর বিন্দু অন্ধকারে পুঁতির মালা যেন লেকের গলায় ঝুলে আছে যেন।

ভ্রমনের উত্তেজনা, রাতের জ্যোৎস্না বিলাস সব মিলিয়ে অনেক রাত হয়ে গেল আমাদের ঘুমাতে।
সকালে উঠে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম বোটটিকে। মেঝেতে বিছানো জমকালো কারুকাজ করা কাস্মিরী কার্পেট।  দরজা, জানালার কাঠে সূক্ষ শৈল্পিক কাজ।
এখানকার বেশির ভাগ মানুষের জীবন জীবিকা পর্যটক নির্ভর। ওদের তৈরি শাল, শাড়ি, মালা দুল চুরি, টুপি,ব্যাগ, মশলা, সব্জি,  ফুল,  বাদাম, হাতে বানানো কাঠের বাক্স  ইত্যাদি জিনিষ শিকারায় করে  লেকে ঘুরতে থাকে বিক্রির উদ্দেশ্যে।  শিকারা হচ্ছে মানব চালিত বিশেষ ধরনের  ডিঙি নৌকা।

এবার আমাদের শিকারা চড়ে লেকে ঘুরে বেড়ানোর পালা। এ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা! সোফার মতন নরম গদিতে রাজকীয় ভংগিতে বসে বা আধ শোয়া হয়ে উপভোগ করা যায় শিকারায় নৌভ্রমন। মানুষ দ্বারা বৈঠা চালিত এই নৌকা গুলো নীচু হওয়ায় পানি ছুঁই ছুঁই করে জল কেটে এগোয় প্রায় নিঃশব্দে ।  জলের কাছাকাছি বসে  ভেসে থাকতে বেশ লাগে!!

শিকারায় পর্যটক বহনের চেয়ে পণ্য বিক্রেতাদের  ভীড় লক্ষ্যনীয়। বিক্রির জন্য বাহারি সব পণ্য সাজিয়ে এরা ভেসে বেড়ায় ডাল লেকে।

কিছু দূরে দেখি এক ভ্রমন জুটি শিকারাতে বসে কাশ্মিরী সাজে ছবি তুলছে। রুপকথার রাজকন্যা কে না হতে চায়! এমন সূযোগ কেউ হাতছাড়া করে!  হাত ইশারায় ডাক এক লাফে  উঠে গেলাম ওই শিকারাতে।  জরির কাজ করা রঙ চং কাশ্মিরী পোশাকে বাক্স ভরা !  ঘন্টা হিসাবে পর্যটকদের এগুলো ওরা ভাড়া দেয়া হয়। আমি মেজেন্টা মখমলের উপর সোনালী জরীর কাজ করা একটা ড্রেস পছন্দ করলাম। দ্রুত হাতে আমায় তা পরিয়ে, ভারী গলার হার, মাথায় তিন লহরের স্পেশাল ঝাপ্টা দিয়ে সাজিয়ে কাস্মিরী কন্যা বানিয়ে ফেললো। সত্যিই রুপকথার রাজকন্যা মনে হচ্ছিল নিজেকে। ওদের ক্যামেরায় ঝটপট আমার ছবি তুলতে লাগলো।এই সূযোগে আনিও বইঠা হাতে, বসে, হেলান দিয়ে, ফুলের ঝাড় হাতে, কাত হয়ে, চিত হয়ে, পানিতে পা দুলিয়ে, হাত ঝুলিয়ে কত যে ছবি তুললাম।  কাস্মীর ভ্রমন আমার সার্থক হলো যেন!

এইসব করে বেলা গড়িয়ে গেল। বিকেলের সোনালী আলোয় শান্ত জলে অনেকদুর পর্যন্ত  ঘুরে বেড়ালাম লেকের বুকে। সবুজাভ পানির উপর  পাতলা শেওলার চাদর  বিছানো অথবা কোথাও বড় কচুরি পানার দল ভেসে বেড়াচ্ছে। ঠিক আমাদের দেশের ডোবা পুকুরের মতন।

পরিবেশ দুষনের কালো হাত শ্রীনগরের ডাল লেককেও গ্রাস করছে ক্রমশঃ।  বানিজ্যিকরন গ্রাস করছে এর স্নিগ্ধ রুপ। দিন দিন পর্যটক বাড়ছে। বাড়ছে হাউজ বোটের সংখ্যা, দোকান, হোটেল,  শিকারা, লোক সমাগম। লেকের পানি ঘোলা হয়ে যাচ্ছে। ময়লা ভাসছে। কিছুদিন আগে কর্তৃপক্ষ লেকটি বন্ধ রেখেছিল সংস্কার ও উন্নয়নের কাজের জন্য।

আমাদের শিকারা লেক পাড়ে বিরাট এক হ্যান্ডিক্র‍্যাফটের দোকানে ভিড়লো।  এটাও ওদের সংযোগ বানিজ্য,  বুঝলাম। এশিয়ান ক্রাফট নামে এই দোকানে পণ্যের বাহার দেখে,শাল, শাড়ি ইত্যাদির বিশাল সংগ্রহ দেখে কেনাকাটা বিমুখ মানুষও এখানে সর্বস্বান্ত হতে চাইবে । আমাদের ভ্রমন দলের সদস্যরাও সেদিন প্রায় সর্বসান্ত হয়েই ফিরেছিলাম।

ইতিমধ্যে  যুবতী রাতের অভিসার শুরু হয়ে গেছে।  আমাদের হাউজবোটে ফিরতে হবে। আবার শিকারায় উঠলাম। ঝিরঝির ঠান্ডা বাতাস বইছে। শীতের কাপড় গায়ে আরেকটু জড়িয়ে নিলাম। নরম গদিতে জাঁকিয়ে বসি হেলান দিয়ে। শব্দহীন নৌযান চলছে ধীরে।

আকাশে ধুসর কালো মেঘ ছড়িয়ে ছিটিয়ে।  উঁকি দিচ্ছে গতকালের পুর্নিমা ক্লান্ত পূর্ণ চাঁদ। নীরবতা ভেংগে  ছোট বোন সুরেলা গলায় গেয়ে উঠে ‘  সেদিনের সোনা ঝরা সন্ধ্যা –‘।  ওর সাথে সবাই সুর মেলায়।

আমি দেখি রাতের সুন্দরী ডাল লেককে।  দুরের হাউজ বোট থেকে বিন্দু বিন্দু আলো পানিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। রাতের অন্ধকার ফুঁড়ে যেন হাজার জোনাক পোকা পানিতে ভাসছে !

অপার্থিব এ দৃশ্য!!  ঘোর লাগা নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের  হাউজ বোটে। আজ রাতটুকু এখানে কাটিয়ে কাল ভোরে  পহেলগাওয়ের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রা করতে হবে। হয়তো এ জীবনে আর এখানে আসা হবে না।

দুদিনের জলের জীবনের উপর কেমন মায়া পরে গেছে । ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না স্থলে।  শিকারায় ঘুরে ঘুরে ফেরারি হতে ইচ্ছে করছে।  মানুষের মন বড় রহস্যময়।

ডা: মালিহা পারভীন

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com