দক্ষিণ এশিয়ার ছোট্ট এক দেশ ভুটান। এটি বজ্র ড্রাগনের দেশ নামেও পরিচিত। ভুটান পৃথিবীর একমাত্র কার্বন নেগেটিভ দেশ। ভুটানের আয়তনের প্রায় ৭০ ভাগ বনভূমি রয়েছে। এজন্য ভুটানকে বলা হয় অক্সিজেনের দেশ। পৃথিবীর অন্যতম সুখী এই দেশের উন্নয়নের মাপকাঠি হল জিএনএইচ বা গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস। সাধারণত অন্য সব দেশের ক্ষেত্রে জিডিপি বা জিএনপি হলেও ভুটানের ক্ষেত্রে এটি ব্যতিক্রম। তাদের উন্নয়ন এর মাপকাঠি হল সুখের পরিমাপ । যাইহোক, সম্প্রতি একদল ভ্রমণকারী তাদের অভিজ্ঞতা ট্রাভেল বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে বর্ণনা করেছেন। আমাদের ভুটান ট্যুরের গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল আট জন। আর আমাদেরর যাত্রা শুরু হয়েছিল কল্যাণপুর বাস টার্মিনাল থেকে। রাতের বাসে ঢাকা থেকে বুড়িমারি পৌঁছাই সকাল ৭ টায়। তারপর, ফ্রেশ হয়ে বুড়ির হোটেলে নাস্তা সেরে নেই। এবার ইমিগ্রেশন-এর পালা। বুড়িমাড়ি পোর্টে ইমিগ্রেশন চলে বাস এর সিরিয়াল অনুযায়ী। স্পীড মানি ছাড়া ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করা খুব কঠিন। আর ট্রাভেল ট্যাক্স চেষ্টা করবেন ঢাকা থেকে দিয়ে যেতে। তাহলে বর্ডারে সময় বাঁচবে। চ্যাংড়াবান্ধাতেও একই অবস্থা । আমরা ঈদের সময় গিয়েছিলাম তাই আমাদের দুই দেশের ইমিগ্রেশন শেষ করতে প্রায় ১টা বাজে।
তারপর কারেন্সি এক্সচেঞ্জ করি এবং একটি জিপ নিয়ে জয়গাও এর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। চ্যংড়াবান্ধা থেকে জয়গাও এর দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার এর মতো। যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা। ভুটানে কিন্তু ইন্ডিয়ান রুপি চলে। তাই সব টাকা বা ডলার রুপিতে কনভার্ট করে নিবেন। ইন্ডিয়ান রুপি এবং ভুটানিজ় নিউলট্রাম এর মান সমান। আমরা জয়গাও পৌছাই প্রায় ৪ টার দিকে। জয়গাও-এর ইমিগ্রেশন অফিস খুব নিরিবিলি। সাধারণত মানুষের তেমন ভিড় থাকেনা। জয়গাও-এর ইমিগ্রেশন শেষ করে আমরা চলে গেলাম ভুটান গেট। মেইন গেট দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। এর পাশেই হেঁটে যাওয়ার জন্য ছোট গেট আছে। তারপর পায়ে হেটে ভুটান প্রবেশ করি। ফুন্টশোলিং থেকে ভুটানের ভিসা নিয়ে এবং ইমিগ্রেশন শেষ করে থিম্পুর উদ্দেশ্যে রওনা দেই প্রায় সারে পাঁচটায় এবং থিম্পু পৌঁছাই রাত ১১ টায়।
বাংলাদেশের সাথে যেহেতু ভুটানের কোন বর্ডার নেই তাই বাই রোডে ভুটান যেতে হলে ভারতের ট্রানজিট ভিসা লাগবে। ট্রানজিট ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হল ১. মিনিমাম ৬ মাস মেয়াদসহ পাসপোর্ট এবং পাসপোর্টের কপি ২. জাতীয় পরিচয় পত্র অথবা জন্ম নিবন্ধন-এর কপি । ৩. বিদ্যুৎ বিল অথবা গ্যাস বিল অথবা যেকোনো ইউটিলিটি বিলের কপি ৪. ব্যাংক স্টেটমেন্ট অথবা ডলার এন্ডোর্সমেন্ট অথবা ইন্টারন্যাশনাল ক্রেডিট কার্ড-এর কপি । ৫. পেশার প্রমাণপত্র অর্থাৎ চাকুরীজীবী হলে এন ও সি, ব্যবসায়ী হলে ট্রেড লাইসেন্স, স্টুডেন্ট হলে আইডি কার্ডের কপি ইত্যাদি। ৬. ১ কপি ছবি ২’ বাই ২’ সাইজের সাদা ব্যাকগ্রাউন্ড সহ । ৭. ঢাকা-বুড়িমারি-ঢাকা বাস টিকেট । ৮. হোটেল বুকিং। ৯. পূর্বের ভিসা থাকলে এর কপি । ১০। সকল পুরাতন পাসপোর্ট জমা দিতে হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল ভিসার জন্য এপ্লাই করার তারিখ। ট্রানজিট ভিসার মেয়াদ যেহেতু খুব কম মাত্র ১৫ দিন, তাই খুব হিসাব নিকাশ করে এপ্লাই করতে হবে। সবচেয়ে বেস্ট টাইম হল যাত্রার তারিখ থেকে ৭ অথবা ৮ কর্ম দিবস আগে জমা দেয়া। এর চেয়ে বেশি আগে জমা দিলে ট্যুর শেষ হওয়ার আগেই ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যেতে পারে। আবার এর চেয়ে পরে জমা দিলে ভিসা পাওয়ার আগেই ট্রাভেল ডেট পার হয়ে যাবে ।
১. পাসপোর্ট এবং পাসপোর্ট-এর কপি ২. ১ কপি পাসপোর্ট সাইজ ছবি ৩. হোটেল বুকিং এর কপি ৪. পূরণকৃত ভিসা এপ্লিকেশন ফর্ম (এপ্লিকেশন ফরম ইমিগ্রেশন অফিসেই পাওয়া যায়) এই কাগজগুলো জমা দেয়ার পর আমাদেরকে ৭ দিনের ভিসা দেয়। এই ভিসা শুধু থিম্পু আর পারোর জন্য। এর বাইরে অন্য কোথাও যেতে হলে থিম্পু থেকে পারমিশন নিতে হবে।
ঢাকা থেকে বুড়িমারী পর্যন্ত নন এসি বাস ভাড়া ৬,৫০টাকা। আর এসি বাস ভাড়া ৮,৫০ টাকা । তবে, শ্যামলীর এসি বাস শিলিগুড়ি পর্যন্ত ভাড়া ১,৫০০ টাকা। চ্যাংড়াবান্ধা থেকে জয়গাও এর ট্যাক্সি ভাড়া ১,২০০ থেকে ১,৫০০ রুপী আর টাটা সুমো এর ভাড়া ২,২০০-২,৫০০ রুপী। ট্যাক্সিতে ৪জন আর টাটা সুমো তে ৮ জন যাওয়া যায় । আমরা আমদের গাইড এর মাধ্যমে ৫দিনের জন্য গাড়ি বুক করি। ফুন্টশোলিং থেকে আমাদের পিক করবে এবং ফুন্টশোলিং এ আমাদের ড্রপ করবে। গাড়ি ভাড়া ১৮,৫০০ রুপি।
ভুটান সম্পূর্ণ ধূমপান মুক্ত দেশ । তাই ধূমপান করে ধরা পড়লে জরিমানা গুনতে হবে। সেজন্য প্রকাশ্যে ধূমপান থেকে বিরত থাকবেন। ভুটান দেশটি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না।
আগের দিনের ভ্রমণ ক্লান্তিতে সকালে ঘুম ভাঙ্গতে একটু দেরি হয়ে যায়। তারপর হোটেলের নিচেই নাস্তা সেরে ফেলি। নাস্তা করার পর তাসি নামক একটি অপারেটরের সিম কিনি। সিম কিনার জন্য পাসপোর্টের এর কপি লাগে। তারপর বেরিয়ে পুনাখা ও হা ভ্যালির জন্য পারমিশন নিতে। পারমিশনের জন্য পাসপোর্টের কপি আর ভুটান ভিসার কপি সহ একটি ফরম ফিলাপ করে জমা দেই। ১ ঘণ্টা পর পারমিশন দিবে। আমরা কাগজপত্র জমা দিয়ে ১ঘন্টা সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে পড়ি বুদ্ধা পয়েন্ট এর উদ্দেশ্যে। বুদ্ধা পয়েন্ট যাওয়ার আগে আমরা একটি ভিউ পয়েন্টে নামি। সেখান থেকে পুরো থিম্পু শহরটা দেখা যায়। আমরা সেখানে কিছু সময় অতিবাহিত করে চলে যাই বুদ্ধা পয়েন্ট। বুদ্ধা পয়েন্ট একটি পাহাড়ের উপর অবস্থিত। তাই অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। বুদ্ধা পয়েন্টে কিছু সময় কাটিয়ে ও ছবি তোলে আমরা ফিরে আসি। আসার সময় আমরা আপেল বাগানের সামনে নামি। বাগানের ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। তাই বাইরে থেকেই দেখে নিলাম। আপেল তখনো পরিপক্ব হয়নি।। তারপর আমরা ইমিগ্রেশন অফিসে চলে যাই এবং পারমিশন পেপার নিয়ে হোটেল এ ফিরে আসি। বিকেলে আমরা একটি মনেস্ট্রি ঘুরে দেখি। এরপর আমরা যাই হেরিটেজ মিউজিয়াম।
তারপর আমরা চলে যাই ওয়াকিং বুদ্ধা দেখতে। এটি একটি পার্ক এর ভিতরে অবস্থিত। এর পাশেই রয়েছে থিম্পু চু। ভুটানিজ ভাষায় চু মানে হল নদী। নদীর তীরে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে চলে যাই আর্চারী গ্রাউন্ড। সেখানে তীরন্দাজদের হাতের নৈপুণ্য দেখে চলে আসলাম ক্লক টাওয়ার। এই ক্লক টাওয়ার ভাল লাগার মত একটা জায়গা। এখানে কেউ গান গাইছে। কেউ ডান্স নাচছে। কেউ উদ্ভ্রান্ত হয়ে বসে আছে। কেউবা বই পড়ছে। কেউ আড্ডা দিচ্ছে। এর আশেপাশে খাবারের দোকান আছে। আমরা সেখান থেকে কিছু ফুড টেস্ট করলাম। সন্ধ্যার পর আমরা লোকাল ফ্রুটস খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ খোজার পর সবজি মার্কেটে কিছু ফ্রুটস পেলাম । ভুটানে সবচে বেশী যে ফলটি পাওয়া যায় সেটি হল পিচ। তারপর ভুটানের মার্কেটে ঘুরলাম। একটা জিনিস খুব ভাল লাগছে ভুটানে বাংলাদেশের অনেক প্রোডাক্ট পাওয়া যায়। বিশেষ করে প্রাণের প্রডাক্ট। বি: দ্র: ভুটান দেশটি খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাই যেখানে সেখানে ময়লা ফেলবেন না ।
সাব্বির হোসেন