সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:১৬ পূর্বাহ্ন

ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত : প্রকৃতির অপার বিস্ময়

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৩ আগস্ট, ২০২৩

জলপ্রপাত। ইংরেজিতে যাকে বলে ফলস। প্রকৃতির এক অনুপম বিস্ময় জিম্বাবুয়ের ভিক্টোরিয়া ফলস। এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের তুলনা হয় না পৃথিবীর আরে কোনো কিছুর সঙ্গেই। বিশাল জলের সাদা পর্দা ঢেকে দিয়েছে নদীর গতিপথ। বিচিত্র ছন্দময় শব্দে, সুর লহরী তুলে বিদ্যুৎ গতিতে নেমে যাচ্ছে নিচে। গভীর খাদে আছড়ে পড়া পানি বাষ্প আর মেঘ হয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে। রংধনু জন্ম নিচ্ছে সূর্যের আলোয়। এ যেন পৃথিবীর আরেক রূপ! এটি জাম্বেজী নদী। জাম্বিয়া আর জিম্বাবুয়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। ভূমিকম্প বা এ ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে নদীর নিচের মাটি বা শিলাখণ্ড হঠাৎ দেবে গেছে। ফলে নদীর পানি স্বাভাবিক স্তর থেকে হঠাৎ ১০৮ মিটার নিচে গিয়ে পড়ছে। আর তাতেই জন্ম নিচ্ছে এই নিপুণ সৌন্দর্যের আঁধার।স্কটল্যান্ডের এক ডাক্তার। নাম ডেভিড লিভিংস্টোন। তার নেশা ছিলো বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ানো।

এ জন্য তাকে আবিষ্কারক এবং পর্যটকও বলা হতো। বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ চষে বেড়িয়েছেন তিনি। ১৮৫৫ সালের কথা। লিভিংস্টোন দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পায়ে হেঁটে মিশর যাচ্ছিলেন। উদ্দেশ্য ব্যবসা বাণিজ্য এবং ভ্রমণের জন্য একটি সহজ পথ আবিষ্কার। জঙ্গলে পরিপূর্ণ ওই পথে তিনি এসে পৌঁছেন জাম্বিয়ায়। ওই বছরের ১৬ নভেম্বর জিম্বাবুয়ে এবং জাম্বিয়া সীমান্তে লিভিংস্টোন আবিষ্কার করেন এই জলপ্রপাত। অনেক দূর থেকে তিনি শুনতে পেয়েছিলেন জলের গর্জন। প্রথমে বুঝতে পারেন নি বিষয়টি। পরে কাছে গিয়ে বিস্মিত হয়ে গেলেন। জাম্বেজী নদী হঠাৎ নেমে গেছে খাড়া গভীরে। বিশাল জলরাশি গড়িয়ে পড়ছে নিচে। তারই ছান্দিক শব্দ কানে বাজছে তার। লিভিংস্টোন ইংল্যান্ডের রানীর নামে এই জলপ্রপাতের নাম দেন ‘ভিক্টোরিয়া ফলস’।

এই জলপ্রপাতের দক্ষিণ পাশেই চমৎকার সুন্দর একটি দ্বীপ। দ্বীপের বিভিন্ন চ্যানেল দিয়ে জাম্বেজী নদীর পানি প্রবল বেগে আছড়ে পড়ছে নিচে। ছবির মতো সুন্দর এই দ্বীপ থেকেই জলপ্রপাতটি দেখেছিলেন লিভিংস্টোন। তাই তিনি এই দ্বীপের নাম দেন ‘লিভিংস্টোন আইল্যান্ড’।অবশ্য ১৭১৫ সালে নিকোলাস ডি ফে নামে এক ব্যক্তির আঁকা মানচিত্রে এই জলপ্রপাতের নির্দেশনা পাওয়া যায়। যে মানচিত্রের এই অংশ দিয়ে একটি বাণিজ্যপথ দেখানো হয়েছে। বলা হয়ে থাকে লিভিংস্টোন ওই মানচিত্র অনুসরণ করেছিলেন। তবে, ২০১৩ সালে এই জলপ্রপাতের একটি স্থানীয় নাম দেয়া হয়। নামটি হলো ‘মসি ইয়া তুনইয়া’। স্থানীয় ভাষায় যার অর্থ- বজ্র সৃষ্টিকারী ধোঁয়া।

জিম্বাবুয়ে গিয়েছিলাম ক্রিকেট খেলা দেখতে। বাংলাদেশ এবং জিম্বাবুয়ের মধ্যে সিরিজ চলছিলো। রাজধানী হারারে থেকে বিমানে গিয়েছিলাম ভিক্টোরিয়া ফলস সিটিতে। বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে শহরে যাচ্ছিলাম। প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকে দেখছি আকাশে ভাসমান ঘন বাষ্প। মেঘের মতো। ড্রাইভার বললেন, ওটাই জলপ্রপাত। এতো দূর থেকে জলপ্রপাতের সৌন্দর্য দেখে অবাক হলাম। ওইদিন বিকেলে জাম্বেজী নদীতে গিয়েছিলাম। ক্রুজে। ক্রুজ বললেই সবাই বোঝেন- এক ধরনের নৌকা ভ্রমণ। জাম্বেজী নদীতে নৌকা চলছিলো। সবচেয়ে বয়স্ক মাঝি আমাদের বিভিন্ন বিষয় বর্ণনা করছিলেন। তিনি হাত দিয়ে দেখালেন- এখান থেকে পশ্চিমে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতেই ফলস। দেখেছিলাম নদীর স্রোত দ্রুত ধেয়ে চলেছে জলপ্রপাতের দিকে।

পরদিন সকালে রওনা হলাম জলপ্রপাত দেখতে। প্রধান গেটে এসে গাড়ি থামলো। যারারে জলপ্রপাত দেখতে আসেন তারা প্রথমেই রেইনকোট কেনেন। পাওয়া যায় ভাড়াতেও। আমরা নিলাম ছাতা। তারপর টিকিট কেটে মূল গেট দিয়ে ভেতঢুকলাম। শুরুতেই বিভিন্ন ছবি এবং মানচিত্রে জলপ্রপাতের চিত্র ফুঠে উঠেছে। খানিকটা পায়ে হেঁটে যেতে হয় জাম্বেজী নদীর ধারে। জলপ্রপাত দেখতে হলে যেতে আসতে সাড়ে তিন কিলোমিটারেরও বেশি হাঁটতে হয়।পথে অনেক বিশালাকার গাছ গাছালি।

আমাদের সঙ্গে জিম্বাবুইয়ান গাইড ছিলেন- মাইক। তিনি বললেন, এটি রেইন ফরেস্ট। রাস্তার দু’ধারে প্রচুর বানর। বনমোরগসহ অন্যান্য প্রাণীও প্রচুর। কিছদূর গিয়েই দেখলাম বিশাল একটা মূর্তি। মাইক বললেন, এটিই লিভিংস্টোনের স্ট্যাচু। তিনিই এই জলপ্রপাত আবিষ্কার করেছেন। মোবাইলে ছবি তুললাম লিভিংস্টোনের। সামান্য পথ এগোতেই শুনছিলাম বিপুল জলরাশির গর্জন। মাইককে জিজ্ঞেস করলাম শব্দ কিসের? মাইক জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে তাকাতে বললো। দেখি জাম্বেজি নদীর বিশাল জলরাশি নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ছে। আমরা নদীর ধারেই দাঁড়িয়ে। ছবি তুলতে ব্যস্ত হলাম। মাইক বললো, আরো সামনে চলুন।

আরো এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম নদীর ধারে। নদীর পাড় একেবারে খাড়া। তাই সাবধানে দাঁড়াতে হচ্ছিলো। এখান থেকে পড়ে গেলে বাঁচার আশা নেই। খুঁজে পাওয়া যাবে না চিহ্নমাত্র। দেখলাম, টনকে টন পানি পাগলের মতো নিচে নেমে যাচ্ছে। চোখে না দেখলে সে দৃশ্য ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। জিম্বাবুয়ের একেবারে পশ্চিম প্রান্তে ভিক্টোরিয়া শহর। জাম্বিয়ার সীমানা ঘেষা এই শহরের পশ্চিম প্রান্তে এই জলপ্রপাতের অবস্থান। জাম্বেজী নদীর উৎপত্তি জাম্বিয়ার পাহাড়ি এলাকা থেকে। এরপর এটি পূর্ব এ্যাঙ্গোলা, নামিবিয়ার পূর্ব সীমান্ত, বতসোয়ানার উত্তর পাশ দিয়ে, জাম্বিয়া এবং জিম্বাবুয়ের সীমান্ত ছুঁয়ে চলে গেছে মোজাম্বিকে।

তারপর মিশেছে ভারত মহাসাগরে।ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাতের অবস্থান প্রকৃতপক্ষে জাম্বিয়ায়। কিন্তু জিম্বাবুয়ের সীমানা ছুঁয়ে আছড়ে পড়েছে নিচে। আর এর আসল সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে আসতে হবে জিম্বাবুয়ের ভিক্টোরিয়া সিটি প্রান্তে। এই জলপ্রপাতে প্রতি সেকেন্ডে ৩৮ হাজার ৪৩০ ঘনফুট পানি আছড়ে পড়ছে নিচে। বছরে আনুমানিক ১৫ লাখ দর্শনার্থী এই জলপ্রপাত দেখতে আসেন। এর অপার সৌন্দর্যের কারণেই এটি দেশটির প্রধান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। জলপ্রপাত দেখতে আসা দর্শনার্থীদের প্রায় সবাই দেখতে আসেন জাম্বেজি ব্রিজ। জাম্বিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন এই ব্রিজ দিয়ে যাওয়া যায় জাম্বিয়ায়। ব্রিজটি পানির স্তর থেকে অনেক উঁচুতে। নিচে তাকালে দেখা যায়, কত প্রবল বেগে বইছে জলের স্রোত।

১৯০৫ সালে জলপ্রপাতের সামান্য ভাটিতে জিম্বাবুয়ে অংশে জাম্বেজি নদীর উপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কাজ শেষ হয় ১৯০৯ সালে। তখন থেকে এই সেতুর উপর দিয়ে মালবোঝাই ট্রাক এবং ট্রেন যাওয়া-আসা করে। ভাটিতে জাম্বেজি নদী অতি সরু হয়ে গেছে এবং অতি খরস্রোতা। সেইসঙ্গে ছোট্ট খাড়া একটি ভূখণ্ড দিয়ে সরু নদীটিই আবার দুভাগ হয়ে গেছে। অবশ্য সামান্য ভাটিতেই আবার এক হয়ে গেছে জাম্বেজি। জিম্বাবুয়ে স্বাধীন হয় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকেই মূলত ভিক্টোরিয়া ফলস দেখতে দলে দলে মানুষ আসতে থাকে। বিশেষ করে বিদেশিরা এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন।

তবে ইউরোপের মানুষই এখানে বেশি আসেন। এই জলপ্রপাতের গভীরতা ১০৮ মিটার। এটি প্রায় ২ কিলোমিটার (১৭০৮ মিটার) চওড়া। প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূর থেকেও পানির ধোয়াশা (কুয়াশার মতো ধোঁয়া) দেখা যায়। আরো ৮ কিলোমিটার ভাটিতে ছিলো এই ফলস। আকাশে অদ্ভুত মেঘমালা। সূর্যের আলোর সঙ্গে মিশে তৈরি করেছে অপূর্ব এক আলো। সাদা মেঘগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুরছে পুরো জলপ্রপাতের উপর দিয়ে।

পশ্চিম প্রান্তে একেবারে শেষ মাথায় পাথরের রাস্তা। সে রাস্তা ধরে বিপজ্জনক পথ ধরে খানিকটা সামনে যেতে হয়। যারা প্রবল বর্ষণ আর পিচ্ছিল, বিপজ্জনক রাস্তা পেরিয়ে প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছতে পারেন তারা দেখতে পান একটা পাথুরে প্রান্তর। সেখানে অনবরত বৃষ্টি হচ্ছে। সূর্য ঢাকা পড়ছে সেই মুষলধারে ঝরে পড়া বৃষ্টিতে। সম্ভবত এটিই পৃথিবীর একমাত্র স্থান যেখানে দিনের ২৪ ঘণ্টা তো বটেই, বছরজুড়েই বৃষ্টি হয়। পাথরের গায়ে লেখা সতর্ক বাণী চোখে পড়ল। সেখানে সামনে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। সামনে এগিয়ে গেলে যে কোনো সময় যে কেউ পরে যেতে পারে জলপ্রপাতের মৃত্যুকূপে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com