লিন্ডা ভেন্ড এবং মোরো ডিওপ* দীর্ঘ দূরত্বের এই সম্পর্ক নিয়েই দিন পার করছেন। দম্পতি হয়েও দুজন পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে দুটি আলাদা দেশে বসবাস করছেন।
মোরো ডিওপ* বলেন, “দূর থেকে ভালবাসা সত্যিই খুব কঠিন। আমি আমার স্ত্রীকে সকাল, দুপুর, সন্ধ্যায় প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি।”
এই প্রেমিক যুগলের পরিচয় ২০২০ সালে। লিন্ডা ভেন্ড সেই সময় পশ্চিম সেনেগালে অবস্থিত মোরোর নিজ শহর এমবোরে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন।
মোরো যোগ করেন, “আমরা একে অপরকে দেখে প্রেমে পড়েছিলাম।”
লিন্ডা সেই সময় একজন ছাত্রী ছিলেন। স্থায়ী সম্পর্কের পর লিন্ডা জার্মানি থেকে বারবার সেনেগাল সফর করেন। অবশেষে ২০২২ সালে তারা তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের উপস্থিতিতে মোরোর নিজ শহর এমবোরে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
সেনেগালের নাগরিক মোরো ডিওপ ফরাসি এবং স্থানীয় ওলোফ ভাষায় কথা বলে। কিন্তু জার্মানিতে তার স্ত্রীর সাথে যোগদানের জন্য ভিসা পেতে হলে তাকে অবশ্যই ইউরোপীয় ফ্রেমওয়ার্ক এ১ বা প্রাথমিক স্তরের জার্মান ভাষার দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে।
মোরো বছরের পর বছর ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২২ সালের শুরুর দিকে তিনি কয়েক মাস ধরে রাজধানী ডাকারে অবস্থিত গ্যোটে ইনস্টিটিউটে জার্মান ভাষার কোর্স করতে তার বর্তমান চাকরি থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। লিন্ডা তার স্বামীর কোর্সের অর্থায়ন করতে সাহায্য করেন। এই দম্পতির ইতিমধ্যে কোর্সসহ নানা প্রশাসনিক কাজের পেছনে প্রায় ৬ হাজার ইউরো বা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ করেছেন।
মোরো ১৪ মাস ধরে জার্মান ভাষা অধ্যয়ন করে তিনবার পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন। পরীক্ষায় পাশ করতে মূলত ৬০ পয়েন্টস সমমান একটি স্কোর প্রয়োজন। তবে মোরো তার শেষ প্রচেষ্টায় মাত্র ৪০ পেয়েছিলেন।
লিন্ডা ব্যাখ্যা করেন, এই পরীক্ষা তার স্বামীর মানসিক চাপের একটি প্রধান কারণ হয়ে উঠেছে। মোরোর এক চাচা তাকে লিন্ডার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাপ দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন লিন্ডা তার স্বামীকে নিয়ে যেতে ভালোভাবে চেষ্টা করছেন না।
এ১ সমমানের ভাষাগত দক্ষতা পরীক্ষায় একজন ব্যক্তিকে জার্মান ভাষায় সাধারণ কথোপকথনের রেকর্ডিং, অডিও বার্তা ও ট্রেন স্টেশনের বিভিন্ন ঘোষণা শোনার পর একাধিক প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
কিন্তু কখনও সরাসরি জার্মানিতে না আসা ব্যক্তির জন্য এসব পরীক্ষা বেশ কঠিন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।
২০২১ সালে তিন চতুর্থাংশ সেনেগালের অংশগ্রহণকারীরা গ্যোটে ইনস্টিটিউটের এ১ ভাষা পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল। এটি প্রায় ত্রিশটি দেশের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফলাফল। ২০২২ সালে ব্যর্থতার হার ৫০ শতাংশেরও বেশি ছিল।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতানৈক্য
প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ১০ হাজারেরও বেশি লোক জার্মান ভাষা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে থাকেন। যার ফলে তারা জার্মানিতে তাদের স্বামী বা স্ত্রীর সাথে যোগ দিতে পারেন না।
এই নিয়মটি পরিবর্তনের জন্য, বামপন্থী দল ডি লিঙ্কে গত বছর একটি বিল উত্থাপন করেছিল। বিলে স্বামী/স্ত্রী্রা যেন জার্মানিতে আসার পরে ভাষা পরীক্ষা দিতে পারে সেটির সুযোগ রাখার দাবি জানানো হয়েছিল।
বর্তমান ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি এসপিডির সাংসদ গ্যুলিস্টান ইউকসেল প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, আইনটি শিথিল করা হবে। জার্মান পার্লামেন্টে তিনি বলেন, “আমি এমন লোকদের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি যারা ভাষা পরীক্ষার কারণে তাদের স্বামী বা স্ত্রীদের থেকে বছরের পর বছর ধরে আলাদা থাকতে বাধ্য হয়েছেন।”
অ্যাসোসিয়েশন অফ বাইন্যাশনাল ফ্যামিলি অ্যান্ড কাপলসের আইনজীবী এবং পরামর্শদাতা স্ভেনইয়া গেরহার্ডের মতে, “বর্তমান পরিস্থিতি অনেক সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছে। জার্মানিতে প্রবেশের আগে ভাষা পরীক্ষার নিয়ম বিলুপ্তির আহ্বান জানাই আমি।”
ভুক্তভোগী লিন্ডা ‘বিটুইন টু ওয়ার্ল্ডস’ নামে একটি বইয়ে তার নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলির প্রায় বিশ জন সংসদ সদস্যকে তার নিজের সমস্যা অবহিত করেছেন।
লিন্ডা বলেন, “আমার স্বামী মোরো এবং আমি প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যে আছি।”
এসপিডি এবং গ্রিন পার্টির বেশ কয়েকজন সাংসদ লিন্ডাকে এই আইন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও পর্যন্ত তিনি কোন কার্যকর পদক্ষেপ দেখেননি।
এদিকে এফডিপির সংসদ সদস্য এবং জার্মান সংসদে পারিবারিক কমিটির সদস্য মার্টিন গাসনার-হ্যার্জ বলেন, “জোরপূর্বক বিয়ে, অর্থের বিনিময়ে বিয়ে এবং সাজানো বিয়েের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ভাষা পরীক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।”
এই মতামতের পক্ষে সম্মতি দিয়েছে জার্মানির রক্ষণশীল রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মতে, “জার্মানিতে আগত ব্যক্তিদের অবশ্যই তাদের সঙ্গীর সাহায্য ছাড়াই স্বাধীনভাবে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হতে হবে৷”
নিয়মের ব্যতিক্রম
তবে এই নিয়মেরও ব্যতিক্রম আছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র এবং জার্মানিতে বসবাসকারী কিছু তৃতীয় দেশের নাগরিকেরা ভাষা পরীক্ষা ছাড়াই তাদের সঙ্গীকে আনতে পারেন।
লিন্ডা ভেন্ডট যদি গ্রিস বা রোমানিয়ার নাগরিক হতেন অথবা তিনি যদি তিনি ব্রাজিল বা কোরিয়া থেকে আসা অভিবাসী হতেন সেক্ষেত্রে তিনি তার স্বামীকে এ১ সমমানের ভাষা পরীক্ষা পাস না করেই জার্মানিতে আনতে পারতেন।
এছাড়া শরণার্থী মর্যাদাপ্রাপ্ত ব্যক্তি, উদ্বাস্তু, গবেষক, স্ব-নিযুক্ত কর্মী ও হাই স্কিল্ড বা উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের স্ত্রীদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
লিন্ডা ভেন্ডট বলেন, “আমি সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ।”
২০১২ সালে জার্মান প্রশাসনিক আদালত এক রায়ে এই আইনটি শিথিল করে। রায়ে বলা হয়, এ১ ভাষা পরীক্ষায় এমন লোকদের জন্য বাধ্যবাধকতা করা উচিত নয় যারা এক বছরের মধ্যে ভাষা শিখা শেষ করতে অক্ষম বা ব্যর্থ। তাছাড়া গুরুতর অসুস্থ, অক্ষম এবং যাদের কোন অক্ষর জ্ঞান নেই কাদের বেলায়ও এমন বাধ্যবাধকতা থাকা উচাত নয়৷
আইনজীবী গেরহার্ড বলেন, বেশিরভাগ বিবাহিত দম্পতিরা এই ধরনের অসুবিধা থাকার বিষয়টি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে তাদের ভাষা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
ডয়েচে ভেলে