বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫, ০৩:৩৪ অপরাহ্ন

ভারতে চিকিৎসা পর্যটকদের ৭০ শতাংশই ছিল বাংলাদেশী

  • আপডেট সময় বুধবার, ৫ মার্চ, ২০২৫

বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশীদের চিকিৎসার জন্য ভারত যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশটিতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশীদের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশীরা।

বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশীদের চিকিৎসার জন্য ভারত যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশটিতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশীদের মধ্যে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশীরা। ভারত সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে দেশটিতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে চিকিৎসা পর্যটনে আসা মোট বিদেশীর মধ্যে বাংলাদেশীর হার দাঁড়ায় ৭০ শতাংশের কাছাকাছিতে।

এ বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত ছিল ২০২৩ সালেও। দেশটির সরকারের এক প্রাক্কলিত তথ্য অনুযায়ী, ওই সময়ও দেশটিতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশীদের মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ৭০ শতাংশের বেশি। একই সঙ্গে ছয় বছরের ব্যবধানে দেশটির চিকিৎসা পর্যটন খাতে (এমভিটি) বাংলাদেশী চিকিৎসাগ্রহীতার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিগুণের বেশিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চিকিৎসাসেবার মান নিয়ে বাংলাদেশীদের মধ্যে সবসময়ই দেখা গেছে আস্থার সংকট। বিশেষ করে জটিল রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী ভারতে গিয়েছেন প্রচুর বাংলাদেশী। এছাড়া বাংলাদেশকে এমভিটি খাতের পর্যটকদের বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে এ নিয়ে বিশেষ কার্যক্রমও চালিয়েছে দেশটির বেসরকারি হাসপাতালগুলো। এর বাইরেও ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক নৈকট্য এবং ভারতের চিকিৎসাসেবার মানও এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৪ লাখ ৯৪ হাজার ৭৬৫ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২১ হাজার ৬৯৪ জন, যা ওই বছরের মোট চিকিৎসা পর্যটকের ৪৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২২ সালের মধ্যে চিকিৎসা পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা কমে নেমে আসে ৪ লাখ ৭৪ হাজার ৬৮১ জনে। যদিও এ সময়ের মধ্যে দেশটিতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বাংলাদেশীর সংখ্যা ব্যাপক মাত্রায় বেড়েছে। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ লাখ ২৭ হাজার ৫৫। চিকিৎসা পর্যটনে আসা মোট বিদেশীর মধ্যে এ হার দাঁড়ায় ৬৯ শতাংশে।

আর সর্বশেষ প্রাক্কলিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশটিতে মোট চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা ছিল কমবেশি ৬ লাখ ৩৫ হাজার। এর মধ্যে বাংলাদেশী চিকিৎসা পর্যটক ছিলেন ৪ লাখ ৪৯ হাজার ৫৭০ জন, যা দেশটিতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়াদের মোট সংখ্যার প্রায় ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ।

তবে এ চিত্রে আমূল পরিবর্তন দেখা দিয়েছে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর। কূটনৈতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটিতে বাংলাদেশীদের ভিসা কার্যক্রম অত্যন্ত সীমিত হয়ে আসে। চিকিৎসা ভিসা চালু করা হলেও তা পাচ্ছে খুব কম সংখ্যক আবেদনকারী। এ অবস্থায় ভারতের পরিবর্তে বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য থাইল্যান্ড-সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোকে বেছে নিচ্ছেন বাংলাদেশীরা।

এতে ভারতের চিকিৎসা পর্যটন খাতেও এখন দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ধস। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় এখন চিকিৎসা পর্যটকদের উৎসে বৈচিত্র্যায়ণের পথ খুঁজছে দেশটি। গত বছরের শেষ দিকে ভারতীয় থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর রিসার্চ অন ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক রিলেশনসের (আইসিআরআইইআর) পক্ষ থেকে এক পলিসি পেপার তৈরি করা হয়। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ভারতের চিকিৎসা পর্যটন খাতের পরিকল্পনা নিয়ে নতুন করে ভাবনার অবকাশ তৈরি হয়েছে।

ওই পলিসি পেপারের তথ্য অনুযায়ী, চিকিৎসা পর্যটন খাতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে ২০২২ সালে ‘‌ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড রোডম্যাপ ফর মেডিকেল অ্যান্ড ওয়েলনেস ট্যুরিজম’ প্রণয়ন করে ভারতের পর্যটন মন্ত্রণালয়। এতে দেশটির চিকিৎসা পর্যটন খাতকে একটি শক্তিশালী ব্র্যান্ড তৈরিতে অংশীজনদের দ্বারা মানসম্পন্ন পরিষেবা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোর বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। আর এ পরিকল্পনার বড় অংশ জুড়ে ছিল বাংলাদেশী রোগীরা।

আইসিআরআইইআরের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বিগত বছরগুলোয় ভারতের চিকিৎসা পর্যটনে সবচেয়ে বড় অবদান রাখা দেশ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। কিন্তু ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাবলি ভারতের এমভিটি খাতকে ব্যাপক মাত্রায় প্রভাবিত করেছে। ২০২৪ সালের আগস্টের প্রথম দিকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কারণে স্থল সীমান্ত দিয়ে যাত্রী চলাচল সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে ভারতীয় ভিসা কেন্দ্রগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ভিসা কেন্দ্রগুলো সীমিত আকারে কার্যক্রম আবার শুরু করলেও এখনো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে অনেক সময় লাগবে। আর চিকিৎসার উদ্দেশে আসা পর্যটকের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পাওয়ায় ভারতে শুধু হাসপাতাল নয়, আনুষঙ্গিক আরো অনেক সেবা-পরিষেবায়ও (যেমন হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতান, ওষুধের দোকান ইত্যাদি) নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর এমভিটি খাতে প্রভাব পড়েছে সবচেয়ে বেশি। কারণ স্থল সীমান্ত ও নৈকট্যের কারণে এ অঞ্চল চিকিৎসার জন্য বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী রোগীদের পছন্দের জায়গা হয়ে উঠেছিল।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা খাতে বড় ধরনের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু মানুষের সেবা পাওয়ার অনিশ্চয়তা, চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীদের আন্তরিকতার অভাব, সময়স্বল্পতা ও রোগীবান্ধব পরিবেশের অনুপস্থিতিও প্রকট। দেশে চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত না হওয়ায় বাংলাদেশীরা বিদেশমুখী হচ্ছেন। ভারতে না পেলে অন্য দেশে যাচ্ছেন তারা। আর এতে লাভবান হচ্ছে বিদেশী চিকিৎসাসেবা খাত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নানাবিধ কারণে বাংলাদেশ থেকে ভারতে মানুষ চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য যায়। আমাদের দেশের চিকিৎসা সিস্টেমের ওপর মানুষের আস্থা কমে গেছে। সে আস্থা কমার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। আমাদের ডায়াগনস্টিক সেবার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যেখানে যাচ্ছে, সেখানে একটি জায়গায় গেলেই সেবাটা পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে সেবা পেতে গিয়ে পদে পদে ঘুরতে হচ্ছে। আমাদের দেশে কোন জায়গায় কোন সেবাটা মানুষ পাবে, সে তথ্যটিও কোথাও ভালো করে নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে ডাক্তাররা রোগীদের পর্যাপ্ত সময় দিতে চান না। অথচ বাইরের দেশে সে সেবাটি পাওয়া যাচ্ছে। ভারত, সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ডের হাসপাতালের চিকিৎসকরা বেশি পয়সা নিলেও রোগীকে বেশি সময় দিচ্ছেন। আমাদের দেশে সে সিস্টেম গড়ে ওঠেনি। অথচ বিদেশীরা বাংলাদেশের মানুষের সাইকোলজি স্টাডি করেছে। তারা জানে কী করলে বাংলাদেশীরা খুশি হন এবং তারা সেটাই করেন। ফলে রোগীরা বিদেশে যান।’

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক টানাপড়েন তৈরি হয়। এমনকি বিভন্ন ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উভয় দেশের নাগরিক পর্যায়েও উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে। এমনকি ভারতের হাসপাতালগুলোয় বাংলাদেশী রোগী ভর্তি না করার অনানুষ্ঠানিক ঘোষণার কথাও শোনা গিয়েছিল। একই সময়ে অনেক হোটেল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশী নাগরিকদের হোটেলে থাকার অনুমতি দেয়াও বন্ধ করেছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বস্তিদায়ক হলে এ দেশের রোগীরা যাবে, আর না হলে যাবে না। ওখানে গিয়ে যদি হোটেল না পায়, সেখানে গিয়ে যদি মানুষ নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হয় তাহলে যাবে না। কাজেই উভয় দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ওপর নির্ভর করছে এ দেশের চিকিৎসা পর্যটকরা কতটা আস্থা নিয়ে সেখানে যাবেন।’

বিগত বছরগুলোয় ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে যাওয়া বাংলাদেশী পর্যটকের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়লেও অন্যান্য দেশের চিকিৎসা পর্যটকের সংখ্যা কমেছে। ভারতীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়া বিদেশীদের তালিকায় বাংলাদেশীদের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ইরাকিরা। দেশটি থেকে সে সময় ভারতে যাওয়া চিকিৎসা পর্যটকের সংখ্যা ছিল ৪৭ হাজার ৬৩৮ জন। ২০২২ সালে সে সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ৬৯০১ জনে। একইভাবে ২০১৭ সালে ওমান থেকে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে এসেছিলেন ২৮ হাজার ১৫৫ জন। ২০২২ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ হাজার ১২৫-এ। ২০১৭ সালে মালদ্বীপ থেকে ভারতে চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন ৪৫ হাজার ৩৫২ জন পর্যটক। ২০২২ সালে তা নেমে আসে ১০ হাজার ৯৭১ জনে।

তবে উন্নত দেশগুলো থেকে ভারতে চিকিৎসার জন্য খুব কমসংখ্যক পর্যটক যায়। ২০২২ সালে দেশটিতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া বিদেশীদের মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে।

দেশের চিকিৎসা খাতে রোগীদের আস্থা ফেরানোর বিষয়ে সম্ভাব্য নীতিনির্ধারণী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমানের কাছ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com