আমাদের পাশের বিশাল প্রতিবেশী দেশ ভারত। বুকে ধারণ করে আছে হাজার বছরের সভ্যতা এবং সংস্কৃতির ইতিহাস। বিশাল এই ভারতবর্ষ শুধুমাত্র ইতিহাস-ঐতিহ্যেই নয়, প্রাকৃতিকভাবেও যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, ভারতবর্ষ ভ্রমণ করলে দুনিয়া ভ্রমণ করা হয়ে যায়।
কি নেই সেখানে, বরফে ঘেরা পাহাড় থেকে শুরু করে উত্তাল সমুদ্র, কিংবা গহীন জঙ্গল থেকে শুরু করে ধু ধু মরুভূমি, সব ধরণের ভূ-প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের স্বাদ পাওয়া যাবে এই ভারতবর্ষে। আরও দেখা মিলবে এর হাজার বছরের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা অসংখ্য স্থাপনা এবং নিদর্শনের। শত শত শহর আর সেসব শহরের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলাটা খুব স্বাভাবিকই বটে। চলুন আজ পরিচয় করিয়ে দেয়া যাক ঐতিহাসিকভাবে সম্ভ্রান্ত এক প্রাসাদোপম শহর ‘উদয়পুর’-এর সাথে, যে শহরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত রাজপুতদের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি।
আরাবল্লী পর্বতশ্রেণীর সবুজ পাহাড়ি ঢালে অবস্থিত অপরূপ এবং মনোমুগ্ধকর শহর উদয়পুরের গোড়াপত্তন ঘটে ১৫৫৯ খৃষ্টাব্দে। মুঘল সম্রাট আকবরের মেওয়ার রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা জানতে পেরে তৎকালীন মেওয়ার রাজবংশের দ্বিতীয় উদয় সিং তার রাজধানী চিতোরগড় থেকে ১২০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরাবল্লী পর্বতশ্রেণীর বক্ষে এই উদয়পুরে স্থানান্তর করে নিয়ে আসেন।
তখন থেকেই সূচনা হয় ঐতিহাসিক এই উদয়পুর রাজ্যের। ভারতবর্ষের রাজ পরিবারগুলোর মধ্যে সবথেকে ধনী রাজ পরিবার হচ্ছে এই মেওয়ার রাজ পরিবার, যার ৭৬তম বংশধর হচ্ছেন রানা শ্রীজি অরবিন্দ সিং মেওয়ার। বর্তমানে এই মেওয়ার রাজবংশের সদস্যরা ভারতের অন্যতম বিলাসবহুল হোটেল গ্রুপ এইচআরএইট গ্রুপের মালিক।
ঐতিহাসিক ফতে প্রকাশ প্যালেস, তাজ গ্রুপ অফ হোটেলস ইত্যাদিও তাদের হোটেল গ্রুপেরই অন্তর্ভুক্ত। প্রবল পরাক্রমশালী যে শাসকগোষ্ঠী এই অঞ্চল দীর্ঘদিন শাসন করেছে তাদের বংশধরেরা আজও এখানে রয়েছে পূর্বপুরুষদের স্মৃতি আগলে ধরে পরবর্তী প্রজন্মকে সেই সময়ের গল্প বর্ণনার জন্যে।
এবার আসা যাক যা দেখবেন উদয়পুরে। দেখার মত স্থানের অভাব নেই রাজস্থানের এই শহরে। প্রথমেই শুরু করা যাক পিছোলা লেকের পাড়ে অবস্থিত ‘উদয়পুর সিটি প্যালেস’ দিয়ে। এই প্রাসাদের কাঁচের কাজ থেকে শুরু করে পাথরের কাজ, মোটিফ কিংবা দেয়ালে ঝুলতে থাকা শত শত বছরের পুরনো পেইন্টিং এবং পুরনো দিনের নানারকম জিনিসপত্রের সংগ্রহশালা মুগ্ধ করে রাখবে যেকোনো পর্যটককে।
এই প্রাসাদটি এখন পর্যন্ত খুবই যত্নের সাথে দেখভাল করা হয়। রাজ পরিবারের সদস্যরা এখনও এই প্রাসাদে বসবাস করেন। বিশাল বড় এই প্রাচীন প্রাসাদটি খুঁটিয়ে দেখতে বেশ খানিকটা সময় লেগে যাবে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সিটি প্যালেসের অভ্যন্তরে ‘লেগেসি অফ অনার’ নামে আলো আর শব্দের এক বিশেষ শো সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে রাজস্থানী মেওয়ার রাজপরিবারের অনেক ইতিহাস ঐতিহ্যের স্মৃতি রোমন্থন করা হয়।
এই সিটি প্যালেস কমপ্লেক্সের মধ্যেই রয়েছে ‘পালকি খানা’ নামের একটি রেস্তোরাঁ। খোলা আকাশের নিচে বসে সিটি প্যালেসের নজরকাড়া ভিউও পাবেন সেখান থেকে। বিকেল বেলার হালকা নাস্তার সাথে প্রাসাদের কারুকর্যময় ফটকও দেখতে পারেন, আবার সেখানে জড়ো হওয়া নানা দেশের নানা মানুষের সাথে জুড়ে দিতে পারেন জম্পেশ আড্ডাও। বেশ একটা ইউরোপীয় আমেজ পাবেন আপনি এখানে।
সিটি প্যালেস পরিদর্শন শেষে যেতে পারেন পিছোলা লেকের কাছে গংগৌর ঘাটে ‘বাগোর কি হাবেলি’তে। হাবেলির প্রতিটা ঘরে ঢোকা যায়। হাবেলি থেকে লেকটিও সুন্দর দৃশ্যমান। রোজ সন্ধ্যায় এখানে রাজস্থানের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এখানে ‘ধরোহার’ নামক লোকনৃত্য এবং পুতুল নাচের শো দেখার মাধ্যমে রাজস্থানী শিল্প-সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে এক নতুন সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবেন নিঃসন্দেহে।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান হল, পিছোলা লেকের মাঝে ‘জগ মন্দির প্যালেস’। উদয়পুর সিটি প্যালেস থেকে নৌকা করে জগ মন্দির প্যালেসে যেতে হয়। এই জগ মন্দির প্যালেসটি মেওয়ার রাজপরিবারের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত হোটেল গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত একটি প্রাসাদ যেখানে রাতে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু ভাড়াটা একটু চড়াই পড়বে।
উদয়পুর সিটি প্যালেস ভ্রমণ শেষ করেই চলে যেতে পারেন পাশেই বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা ‘জগদীশ মন্দির’-এ। এই মন্দিরে এখনও অতীতের আক্রমণের চিহ্ন রয়ে গিয়েছে। ফতেহ সাগর লেকের পাশে ‘সহেলিয়োঁ কি বাড়ি’ও একটি আকর্ষণীয় জায়গা। এই জায়গাটি প্রধানত একটি বাগান যেখানে রানীমা এবং রাজকুমারীর দাসীরা থাকতেন।
এছাড়াও শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে মনসুন প্যালেস তথা ‘সজ্জনগড় প্রাসাদ’-এও অবশ্যই যাবেন। এই প্রাসাদে রাজারা বর্ষাকালে এসে থাকতেন। পাহাড়ের টঙে অবস্থিতর এই প্রাসাদ থেকে খুবই সুন্দর সূর্যাস্ত দেখা যায়। উপরের উল্লেখিত প্যালেসগুলি ছাড়াও উদয়পুরে পর্যটকদের জন্যে রয়েছে আরও নানা রকমের মনোমুগ্ধকর ব্যবস্থা।
এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রিস্টাল গ্যালারি, মহারানাদের ভিন্টেজ গাড়ির প্রদর্শনী, পিছোলা লেকের পিছনে সজ্জননিবাস বাগ, লেকের উত্তরে ফতেহ সাগর, ফতেহ সাগরে রমণীয় দ্বীপ-উদ্যান নেহরু পার্ক, বিপরীতে মোতি মাগরি পাহাড়ে প্রতাপ স্মারক, ৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে উদয়পুরের নব্য আকর্ষণ শিল্পীগ্রাম এবং শহর থেকে ৩ কিলোমিটার পুবে শিশোদিয়া রাজাদের অতীতের রাজধানী পাহাড়ে ঘেরা আহার ইত্যাদি।
আরাবল্লী পর্বতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্যে সবথেকে সুন্দর ব্যবস্থা হচ্ছে করনিমাতা রোপওয়ে, উদয়পুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে ৩ কিলোমিটার পূর্বে যার অবস্থান। মচল্লা পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত শ্রী করনি মাতা মন্দির। উদয়পুরের দীনদয়াল পার্ক থেকে রোপওয়ে চড়ে যাওয়া যাবে এই মন্দিরে।
এসব তো গেলো শুধু উদয়পুর শহরের উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানসমূহ। শহরের আশেপাশেও রয়েছে অসংখ্য নামকরা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, লেক, প্রাসাদ এবং মন্দির। শহর থেকে ৬৩ কিমি দূরে রয়েছে রাজসমন্দ লেক এবং কাঁকরোলি। এটি মূলত মহারানা রাজ সিংহের তৈরি ৭ দশমিক বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট লেক, লেকের পাড়ে শিলালিপি, শ্বেতপাথরের নয়টি মণ্ডপ তথা নওচৌকি, বাগিচা, শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকাধীশ মন্দির ইত্যাদি বিশিষ্ট একটি কমপ্লেক্স।
এখান থেকে উদয়পুরের দিকে ১৮ কিলোমিটার আসতেই পৌছবেন বৈষ্ণবতীর্থ নাথদ্বার, যেখানে রয়েছে শ্রীকৃষ্ণের মন্দির। নাথদ্বার থেকে উদয়পুরের দিকে প্রায় ২১ কিলোমিটার এগিয়ে এলে হাতে পড়বে দেবীগড় যেটি ১৮ শতকের একটি দুর্গ প্রাসাদ। আরও ৭-৮ কিলোমিটার এসে একলিঙ্গজি, ৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে তৈরি পিরামিড ধাঁচের মন্দির কমপ্লেক্স। একলিঙ্গজির একেবারে পাশেই রয়েছে নাগদা, রাওয়াল নাগাদিত্যের ১১ শতকের রাজধানী, ঐতিহাসিক সুপ্রাচীন নগরী।
উদয়পুর থেকে ৯৩ কিলোমিটার দূরের রনকপুরে রয়েছে ২৯টি জৈন মন্দিরের কমপ্লেক্স নাম যার ‘দিলওয়ারাতুল্য’। রনকপুর থেকে ৩৩ কিমি দূরে আরাবল্লি পাহাড়ের ঢালে ৩ হাজার ৫৬৬ ফুট উঁচুতে রানা কুম্ভের তৈরি বিখ্যাত ‘কুম্ভলগড় দুর্গ’ অবস্থিত, যেটি কিনা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রাচীরে ঘেরা দুর্গ। দুর্গের নানা মহলে রয়েছে ফ্রেস্কো চিত্র, সুশোভিত মন্দিরের প্রতিচ্ছবি। আরও রয়েছে র্যামপার্ট থেকে মাড়োয়ারের সমতল ও আরাবল্লির জঙ্গল-পাহাড় সুন্দর দৃশ্যমান।
উদয়পুর শুধুমাত্র নামকরা এসব স্থাপনার জন্যেই নয়, এটি বিখ্যাত স্থানীয় মজাদার রাজস্থানী খাবারের জন্যেও। উদয়পুরে এসে রাজস্থানী খাবারের স্বাদ গ্রহণ না করলে এই ভ্রমণ অপূর্ণই থেকে যাবে। কিন্তু সব জায়গায় স্থানীয় খাবারের আসল স্বাদ পাওয়াটা একটু দুষ্করই বটে। কারণ স্থানীয় লোকদের হাতের রান্না ছাড়া স্থানীয় খাবারের মজাটা আসলে পাওয়া যাবে না উদয়পুরে তাই সেই ব্যবস্থাও আছে।
এখানে স্থানীয়রাই ছোট পরিসরে তাদের ঘরবাড়ির সামনে বসিয়েছেন একেকটা রেস্তোরাঁ। সেখান থেকে চাইলেই স্বল্প খরচে খেতে পারবেন ‘ডাল বাটি চুরমা’ অথবা ‘গাট্টে কি সাবজি’ নামক নানা রকম মজাদার স্থানীয় খাবার। এছাড়াও ক্যাফেতে খেতে চাইলে গংগৌর ঘাটের আশেপাশের গলিতে প্রচুর ক্যাফে রয়েছে যেখানে সব ধরণের খাবার পাওয়া যাবে।
শুধু খাওয়া নয় থাকার ব্যাপারেও এখানে রয়েছে এক বিশাল বৈচিত্র্যের ছাপ। সাধারণ নানারকম হোটেলের মাঝ থেকে মনের মতো হোটেল বাছাইয়ের সুবিধা রয়েছে। একই সাথে ‘বুটিক হোটেল’ নামে এক বিশেষ ধরণের হোটেল এর খোঁজও পাওয়া যায় এখানে। বুটিক হোটেল হচ্ছে মূলত ছোট পরিসরে, কিন্তু বেশ পরিপাটি কোনও হোটেল যেটা স্থানীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতির ছাপে সাজানো হয়ে থাকে।
এখানে নিজস্ব পছন্দ মত এবং সামর্থ্য অনুযায়ী হোটেল বাছাই এর স্বাধীনতা রয়েছে । এছাড়াও আপনি যদি কিছুটা সৌখিন হয়ে থাকেন এবং পুরনো দিনের বাড়িঘরে থাকতে চান তাহলে সেই ব্যবস্থাও আছে এখানে। প্রাসাদসম পুরনো বাড়িঘরগুলো সংস্কার করে এখানে হোটেল হিসেবে পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়। এতে করে আপনার কেবল পুরনো দিনের বাড়িঘর দেখার ইচ্ছাই মেটে না, সেখানে থাকার মতো রোমাঞ্চকর সুযোগও মেলে।
উদয়পুর যেন এক স্বপ্ননগরী, যা বারবার পর্যটককে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে। একবার এই শহরে গেলে এর মোহে আটকে যাওয়া নতুন কিছু নয়। রাজস্থানী কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর ঐতিহ্যের আসল স্বাদ পেতে হলে আপনাকে উদয়পুর আসতেই হবে। পিছোলাকে কেন্দ্র করে নানান মর্মর প্রাসাদ, কারুকার্যময় হাভেলি, প্রাচীন মন্দির, মিউজিয়াম, ম্যানসন গড়ে উঠেছে, ‘ভ্যানিস অব দ্যা ইস্ট’ নামে খ্যাত রাজস্থানের ‘সিটি অব ডন’ উদয়পুরে।
কীভাবে যাবেন :
রাজধানী দিল্লী থেকে রাতে বাস বা ট্রেনে উঠে সকালেই পোঁছে যেতে পারবেন উদয়পুরে। ট্রেনে সময় লাগবে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা, বাসে করে গেলে আরো কম। শিয়ালদাহ থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার সরাসরি উদয়পুর যায় ১২৩১৫ অনন্যা একপ্রেস (ছাড়ে দুপুর ১.১০ পৌঁছায় তৃতীয়দিন ভোর ৩ টে)। শালিমার থেকে প্রতি রবিবার ১৯৬৫৯ উদয়পুর সিটি একপ্রেস (ছাড়ে রাত ৮.২২ পৌঁছায় তৃতীয়দিন সকাল ৮.৫৫)। তবে রাজস্থানের যেকোন অংশের সঙ্গে বাস যোগাযোগ রয়েছে উদয়পুরের। দিল্লী থেকে সরাসরী উদয়পুরের উদ্দেশ্যেও বাস ছেড়ে যায়।
সিফাত শরীফ