ভারতে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে চেন্নাইতে। ফেনীর বিলোনিয়া সীমান্তে ভারতীয়রা বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ করেছে। বিক্ষোভের প্রতিবাদ করেছে বিজিবি। বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারতের পর্যটন ও চিকিৎসা ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছে।
অনুমতি না নিয়ে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ করায় ৫০০ ভারতীয়কে গ্রেফতার করেছে চেন্নাই পুলিশ। এদের মধ্যে ১০০ জন নারী। টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বুধবার (৪ ডিসেম্বর) চেন্নাইয়ের রাজা রত্নম স্টেডিয়ামের সামনে বাংলাদেশে হিন্দুদের নিরাপত্তার দাবি এবং সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত হামলা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিক্ষোভ করছিলেন তারা। এই প্রতিবাদে অংশ নেন বিজেপি, আরএসএস, এবিভিপি, হিন্দু মুনানি এবং অন্যান্য হিন্দু সংগঠনের সদস্যরা।
বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেন হিন্দু মুনানির সংগঠক রাজু। এতে উপস্থিত ছিলেন সাবেক রাজ্যপাল তামিলিসাই সাউন্দারারাজন, আরএসএস নেতা কেশব বিনয়গম এবং বিজেপি নেতা করু নাগরাজন ও ভি পি দুরাইস্বামী।
এ সময় বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশের সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান দেন এবং হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি তোলেন। বিক্ষোভ শেষে তারা আন্না সালাইয়ের দিকে মিছিল করার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের আটক করে।
আটককৃতদের পুলিশের গাড়ি এবং এমটিসি বাসে করে আরআর স্টেডিয়াম থেকে সরিয়ে আনা হয়। তাদেরকে শহরের আন্না অডিটোরিয়াম ও পেরিয়ামেটের একটি করপোরেশন কমিউনিটি হলে আটকে রাখা হয়। পরে পুলিশের অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ করার অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এজমোর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
ফেনীর সীমান্তবর্তী পরশুরামের বিলোনিয়া স্থলবন্দরের ভারত অংশে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। সনাতনী হিন্দু সমাজের ব্যানারে কিছু ভারতীয় নাগরিক ২ ডিসেম্বর বিকেলে বিক্ষোভ করেন। এ বিষয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি ৪ ফেনী ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রোববার দিবাগত রাত ১২টার দিকে বিলোনিয়া সীমান্তেও ওই বিক্ষোভের ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গত রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিলোনিয়া স্থলবন্দরের ওপারে ৫০ থেকে ৬০ জন ভারতীয় নাগরিক জড়ো হয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। তাঁরা ইসকনের পক্ষে এবং বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেন। এ ছাড়া বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য ও বিদ্যুৎ রপ্তানি বন্ধের দাবিতে স্লোগান দেন। এ সময় ভারতের নো ম্যানস ল্যান্ড অংশে ঢুকে বাংলাদেশের দিকে মাইক তাক করে উচ্চ শব্দে প্রায় আধা ঘণ্টা নানা স্লোগান দেন। পরে বিএসএফ সদস্যরা তাঁদের সরিয়ে দেন।
বিলোনিয়ার বাসিন্দা এম এ হাসান বলেন, বাংলাদেশ ও বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে কটাক্ষ করে দেওয়া বক্তব্য ও নানা স্লোগান নিন্দনীয়। দ্রুত এসবের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
ভারত মায়াকান্না না করলে বাংলাদেশের হিন্দুরা ভালো থাকবে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিজন কান্তি সরকার। বৃহস্পতিবার (৫ ডিসেম্বর) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবে সংগঠনটির সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন তিনি।
বিজন কান্তি সরকার বলেন, ভারত বরাবরের মতো দেশটি হিন্দুদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। আওয়ামী লীগের পতনে ভারতীয় একটি গোষ্ঠীর খারাপ লেগেছে। তাই তারা বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। আওয়ামী লীগের আমলে কোটি কোটি টাকা পাচার করে ভারতে রাখা হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে খাটো করা হচ্ছে।
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে বয়কটের ডাক দিয়েছে কলকাতার মধ্যমগ্রামের হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ। আগামী ২৮ ডিসেম্বর দেশটির পশ্চিমবঙ্গের মধ্যগ্রাম সুভাষ ময়দানে শুরু হবে ১৯তম পরিবেশ সচেতনতার মেলা। সেখানে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশ করবেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় এই রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী। তবে অনুষ্ঠানের একটি পোস্টার নিয়ে ইতিমধ্যেই নেটদুনিয়ায় বিতর্ক চলছে। বন্যাকে অনুষ্ঠান করতে দিতে নারাজ সেখানকার হিন্দুত্ববাদীদের একাংশ।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রতিদিন’র জানায়, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে অনুষ্ঠান করতে দিতে নারাজ মধ্যমগ্রামের নাগরিক সমাজের একাংশ। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে তারা পৌরসভার কাছে আবেদনও করেছেন যাতে বন্যাকে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া না হয়।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) বিক্ষোভ হয়েছে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনসহ বেশ কয়েকটি দলের নেতা–কর্মী ও সমর্থকেরা এই বিক্ষোভ করেন। এর আগে হিন্দু সংঘর্ষ সমিতিসহ কয়েকটি সংগঠনের সমর্থকেরা গ সোমবার ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ঢুকে হামলা চালিয়েছিলেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করেন।
কলকাতায় উপ হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পোড়ানোর ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেই সঙ্গে ভারতে সব কূটনৈতিক মিশন ও কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বানও জানানো হয়েছে। শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে এই অবস্থানে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য তুলে ধরা হয়। এতে লেখা হয়, যদিও পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে মনে হচ্ছে, তবে সেখানে ডেপুটি হাই কমিশনের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী অনিরাপত্তায় ভুগছেন।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব কোনো ধরনের হুমকির মধ্যে নেই বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী । বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর পূর্বাচল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স মাল্টিপারপাস ট্রেনিং গ্রাউন্ডে ‘আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস ২০২৪’ উপলক্ষে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স আয়োজিত অনুষ্ঠান উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে তিনি এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে হয় ভুল করে বাংলাদেশের নাম বলে ফেলেছেন। আমার তো মনে হয় উনার দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা প্রয়োজন। কেননা আপনারা দেখেছেন সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর কীভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে।’
আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর রামপালসহ অন্যান্য চুক্তি বাতিল করার দাবি জানানো হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের প্রতি ভারতের অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি সৎ এবং মর্যাদাশীল প্রতিবেশী হিসেবে আচরণ করার আহ্বানও জানান।
এদিকে ভারতের পর্যটন ও চিকিৎসা ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। পর্যটন ও চিকিৎসার মাধ্যমে ভারতের ডলার আয়ের অন্যতম উৎস বাংলাদেশ। দিন যত গড়াচ্ছে দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস ততই বাড়ছে। সবশেষ আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও পতাকা পোড়ানোর ঘটনা এবং কিছু ভারতীয় নেতার বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্যে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বড় অংকের ডিসকাউন্ট দিয়েও কলকাতার হোটেলে বোর্ডার মিলছে না। কলকাতার নিউমার্কেটকেন্দ্রিক দোকানপাটও বাংলাদেশি ক্রেতাশূন্য। মানি এক্সচেঞ্জের প্রতিষ্ঠানগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার ভিসা-সংক্রান্ত জটিলতায় হাসপাতালগুলোও বাংলাদেশি রোগী পাচ্ছে না। এ অবস্থায় বুধবার (৪ ডিসেম্বর) মার্কিন ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রা রুপির মান সর্বকালের তলানিতে পৌঁছেছে। ডলারের বিপরীতে রুপির দর এই প্রথম ৮৪ দশমিক ৭৫-এ নেমে এসেছে।
বাংলাদেশের এওট্রেক ট্যুরিজমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল আলম নয়ন গণমাধ্যমকে বলেছেন, দেশের মোট ট্যুরিজমের অর্ধেক কয়েক মাসে কমে গেছে। ভারতে আগে যেখানে প্রতিদিন গড়ে সাতটি ফ্লাইট যেত, সেখানে এখন সপ্তাহে দুটি ফ্লাইট যাচ্ছে। ভারতে চিকিৎসা ও বেড়াতে যাওয়া মানুষের একটি অংশ এখন থাইল্যান্ডে যাচ্ছে। তবে সেই সংখ্যা ৩০ শতাংশও হবে না।
সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে আসা একাধিক বাংলাদেশি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে কলকাতার নিউমার্কেটসহ আশপাশের দোকানপাটে বাংলাদেশিদের ভিড় লেগেই থাকত। ঘুরতে যাওয়া থেকে শুরু করে বিয়ের কেনাকাটাতে সামর্থ্যবানরা কলকাতাকে বেছে নিতেন। কিন্তু চলতি সপ্তাহে কলকাতার মার্কেটে বাংলাদেশি ক্রেতাদের ভিড় দেখা যায়নি। হোটেলগুলোতে বোর্ডার কম। বলা যায়, বাংলাদেশকেন্দ্রিক ভারতের চিকিৎসা ও পর্যটন শিল্পে বড় ধরণের ধস নেমেছে।
কলকাতার বিভিন্ন হোটেলের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, ডিসকাউন্টের ধুম পড়েছে। এই পর্যটন মৌসুমে যেখানে হোটেলের একটি রুম জোগাড়ে ঘাম ঝরে যেত, সেখানে হোটেলগুলো বিপুল ডিসকাউন্টের অফার দিচ্ছে। গতকাল কলকাতার অভিজাত হোটেল হোটেল ও’পার্কে ৭৫ শতাংশ ডিসকাউন্টের ঘোষণা দেওয়া হয়। অধিকাংশ হোটেলেই ৩০-৭৫ শতাংশ পর্যন্ত ডিসকাউন্ট ঘোষনা