বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ০৪:২৫ অপরাহ্ন
Uncategorized

ব্লু ইকোনমিতে দক্ষ জনবল ও বিনিয়োগের অভাব

  • আপডেট সময় মঙ্গলবার, ৫ অক্টোবর, ২০২১

সমুদ্রভিত্তিক ব্লু ইকোনমির বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগানোর জন্য এখন অপেক্ষা পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের জন্য। একই সঙ্গে সমুদ্র অর্থনীতিকে কাজে লাগাতে যে বিপুল বিনিয়োগ দরকার, তারও যথাযথ সংস্থান হচ্ছে না। ফলে এখন পর্যন্ত ব্লু ইকোনমি সম্ভাবনার পর্যায়েই থেকে যাচ্ছে, সুফলের জায়গায় আসতে আরও সময় লাগবে।

তবে সমুদ্র অর্থনীতি থেকে সুনির্দিষ্টভাবে কী কী সুফল পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে গবেষণা চলছে। সমকালকে এ তথ্য জানিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট) অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশীদ আলম।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) মহাপরিচালক সাইদ মাহমুদ বেলাল হায়দার জানিয়েছেন, ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনার ক্ষেত্রগুলো খুঁজতে আটটি প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণার কার্যক্রম চলছে। মৎস্যসম্পদ আহরণ থেকে শুরু করে সমুদ্রগর্ভে খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ আহরণের সব বিষয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। আর সক্ষমতার অভাবে বিস্তৃত মহীসোপান থেকে এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে গবেষণা শুরুই করা যায়নি।

গবেষণায় বিলম্বিত যাত্রা :অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ১৯৬০ সালে ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ চালু হয়। এ অঞ্চলে বর্তমানে সমুদ্রসম্পদ বিষয়ক গবেষণায় দক্ষ জনবলের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ভারত। অন্যদিকে, বাংলাদেশে ২০১২ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তির এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ-সংক্রান্ত জাতিসংঘের সালিশি আদালতের রায়ের আগে বাংলাদেশে সমুদ্রসম্পদ গবেষণা নিয়ে কোনো উদ্যোগ ছিল না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশে একটি সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট স্থাপনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর সেই উদ্যোগ পরবর্তী ২১ বছরে আলোর মুখ দেখেনি। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আবারও সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট গঠনের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। পরে কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী ২০০০ সালে এই ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। তবে ২০০১ সালে আবারও সরকার পরিবর্তন হলে এ ইনস্টিটিউট স্থাপন প্রকল্প চাপা পড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে আবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে নতুন করে এই ইনস্টিটিউট স্থাপনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়। ইনস্টিটিউট স্থাপনের জন্য কক্সবাজারে ৪০ একর জায়গা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে ‘বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউট আইন’ পাস হয়। এরপর ২০১৭ সালে ইনস্টিটিউটের জন্য কর্মচারী বিধিমালা প্রণীত হলে ২৩ জন জনবল নিয়োগের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়।

২০১৪ সালে বাংলাদেশের পক্ষে জাতিসংঘের ঐতিহাসিক রায়ের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিট থেকে সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ওশানোগ্রাফি বা সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগ খোলার জন্য অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথমবারের মতো সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ খোলে। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়েও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের যাত্রা শুরু হয়। এর আগে জাতীয় সংসদে ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি আইন পাস হয়। এর ভিত্তিতে ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রশাসনিক কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে মিরপুরে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের জন্য ২০১৮ সালে সরকার জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলার বন্দর থানার অন্তর্গত হামিদচরে।

সমুদ্র অর্থনীতির সম্ভাবনা: বিদ্যমান বিভিন্ন গবেষণা থেকে দেখা যায়, সারাবিশ্বে সমুদ্রসম্পদের যে বিশালতা, তার মাত্র এক ভাগ এখন পর্যন্ত বিশ্ব ব্যবহার করতে পারছে।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় শুধু মৎস্যসম্পদ আহরণ থেকেই বছরে এক থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব। সামুদ্রিক মাছকে কেন্দ্র করে একটি শিল্পও গড়ে তোলা সম্ভব। বর্তমানে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বছরে প্রায় ৪৭৫ জাতের ৮০ লাখ টন মাছ ধরা হয়। গবেষণার মাধ্যমে ঠিকমতো মৎস্যসম্পদ আহরণ সম্ভব হলে এর পরিমাণ দেড় কোটি টন পর্যন্ত উন্নীত করা সম্ভব। এসব সামুদ্রিক মাছের তেল বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় খাদ্যপণ্য এবং জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহূত হয়। ফলে মাছ এবং মাছের একাধিক গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বে ভারী শিল্পে ব্যবহূত ম্যাগনেসিয়াম, কৃষিক্ষেত্রের সার তৈরিতে ব্যবহূত পটাশিয়াম, প্রতিদিনের খাবার লবণ সোডিয়াম ক্লোরাইড এবং ওষুধ তৈরিতে ব্যবহূত ব্রোমিনের প্রায় ৫০ শতাংশই আসে সমুদ্র থেকে। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা থেকেও এ ধরনের বিপুল সম্পদ আহরণ এবং তা রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। এ সম্পদ কাজে লাগিয়ে দেশে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠারও সুযোগ আছে।

বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় বিপুল পরিমাণ তেল-গ্যাসের মতো খনিজ সম্পদও পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া সমুদ্র দিয়ে চলাচল করা জাহাজ থেকেও বিপুল আয়ের সুযোগ রয়েছে। অ্যাডমিরাল খুরশীদ আলম বলেন, সমুদ্র থেকে বাংলাদেশের আয়ের সম্ভাবনা বিপুল। তবে সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের জন্য দরকার প্রণোদনা ও বিনিয়োগ। সমুদ্রসম্পদ অনুসন্ধানে প্রণোদনা নেই, আবার দেশের বড় উদ্যোক্তা এবং বিনিয়োগকারীরাও এত কঠিন ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহী হতে চান না। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য কার্যকর পরিকল্পনা দরকার, বিশেষ করে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানি বা আইওসি ছাড়া প্রকৃতপক্ষে সম্ভব নয়। তিনি বলেন, সমুদ্রসম্পদ সঠিকভাবে কাজে লাগানো হলে দেশের অর্থনীতিতে মোট আয়ের অর্ধেকের বেশি জোগান আসবে সমুদ্রসম্পদ থেকেই।

গবেষণা করছে বিওআরআই: বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) মহাপরিচালক সাইদ মাহমুদ বেলাল হায়দার জানান, ইনস্টিটিউটের সক্ষমতা অনুযায়ী গবেষণা পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমানে বিওআরআই আটটি প্রকল্পের মাধ্যমে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করছে জাতিসংঘের স্থিতিশীল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সামনে রেখে। এখন পর্যন্ত গবেষণায় খনিজ সম্পদসহ কয়েক ধরনের সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে। তবে গবেষণা একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর আগে তার ওপর ভিত্তি করে সম্পদ আহরণের কার্যক্রম নেওয়া সম্ভব নয়। তিনিও গবেষণা কার্যক্রমে পর্যাপ্ত দক্ষ জনবলের অভাবের কথা তুলে ধরে বলেন, দক্ষ জনবলের চাহিদা পূরণ হলে গবেষণা অনেক বেশি ত্বরান্বিত ও বিস্তৃত হবে।

তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত গবেষণা কার্যক্রম চলছে চট্টগ্রাম থেকে সেন্টমার্টিন পর্যন্ত। সক্ষমতার অভাবে পুরো মহীসোপান অঞ্চল এবং এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন পর্যন্ত গবেষণায় যাওয়া সম্ভব হয়নি। গভীর সমুদ্রে গবেষণার জন্য গবেষণা জাহাজ কিনতে একটি প্রকল্প প্রি-একনেক পর্যন্ত গেছে। সেটি একনেকে পাস হলে কেনার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এই জাহাজ এলে পুরো মহীসোপান অঞ্চলসহ এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন পর্যন্ত গবেষণা করা সম্ভব হবে। সে ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি সম্পদ আহরণের সুযোগ সৃষ্টি করাও সম্ভব হবে।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com