শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৪ অপরাহ্ন
Uncategorized

ব্যাংকক ভ্রমণ; জাহাজে বসে রাতের খাবার

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৭ জুন, ২০২১

একটা সময়ে বাংলাদেশীদের বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলতে থাইল্যান্ড ভ্রমণকে বোঝাতো। উন্নত দেশগুলোতে বা ইউরোপ আমেরিকা, জাপান বা অস্ট্রেলিয়ায় নিউজিল্যান্ডে কালেভদ্রে দুই একজন সৌভাগ্যবানের যাওয়ার সৌভাগ্য হলেও সত্যিকারের বিদেশ ভ্রমণের শুরুটা বলতে গেলে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক দিয়েই হতো। সে সময় ভারত ভ্রমণকে ঠিক বিদেশ ভ্রমণের ক্যাটাগরীতে ধরা হতো বলে মনে হয় না। কারণ, ভারত ভ্রমণ মূলত কোলকাতা ও দার্জিলিং ভ্রমণের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো, আর ৯০ দশকের আগের কোলকাতার চেহারা বর্তমান ঢাকার চেয়ে অনেক মলিন ছিলো। ফলে অল্প পয়সায় বিদেশ ভ্রমণ এবং লাগেজ পার্টির প্রিয় জায়গা বলতে সেই ব্যাংকক শহর। পরবর্তীতে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতের বিভিন্ন জায়গা আমাদের বিদেশ ভ্রমণের বাকেট লিষ্টে চলে আসে। আর বর্তমানে পৃথিবীর এমন কোন জায়গা বোধহয় নাই, যেখানে বাংলাদেশীদের পদচারনা নেই।

ব্যাংকককে পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় শহরের মধ্যে একটা বলা হয়। World’s Most Visited Cities বা পৃথিবীর পর্যটন প্রিয় ১০টি শহরের উপরের দিকে সবসময় ব্যাংককের জায়গা হয়ে থাকে প্রতি বছর। কিন্তু আমার থ্যাইল্যান্ডে দুইবার যাওয়ার সৌভাগ্য হলেও আমার প্রিয় দেশের মধ্যে এখনও থাইল্যান্ডের জায়গা হয়নি। হতে পারে আমরা বাংলাদেশীরা ব্যাংকক বেড়াতে গেলে যে জায়গার হোটেলে উঠি, অর্থাৎ সুকুম্বি জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না। বড় বড় হোটেল ও উঁচু উঁচু বিল্ডিং থাকলেও সেই জায়গাটা ঢাকার বনানী গুলশানের তুলনায় নিতান্তই মলিন টাইপ। তবে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব ছোট পর্যায়ে তাই, তাই আমি ব্যাংকক সম্পর্কে একদমই বেশি কিছু জানিনা বলতেই পছন্দ করি। তবে আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে ব্যাংককের যে জিনিস দেখে আমার মন খুব খারাপ হয়েছে, সেটা হচ্ছে ওদের নদী। চা প্রায়া নদী। ছোট্ট একটা নদী। আমাদের বুড়িগঙ্গার চেয়ে অনেক ছোট একটা নদী। বুড়িগঙ্গা বুড়ি হলে, চা প্রায়া নিতান্তই কিশোরী। জানিনা, আমার বোঝার ভুল হতে পারে। তবে নদী যদি দেখতেই হয়, তবে সারা পৃথিবীর মানুষের উচিৎ বাংলাদেশে এসে নদী কত প্রকার ও কি কি, সেটা দেখুক। দুঃখের বিষয় নদী মাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোকে ফোকাস করে পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার কোন শক্তিশালী প্রচেষ্টা আমার চোখে পড়েনি। পর্যটন কর্পোরেশন নাকি পর্যটন ব্যুরো একটা চমৎকার ভিডিও তৈরী করেছিলো বছর দুয়েক আগে নদী ভিত্তিক পর্যটনকে কেন্দ্র করে। তবে ঐ পর্যন্তই দৌড়। বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো অবকাঠামো গড়ে তোলার কোন প্রচেষ্টা এখনও চোখে পড়ছেনা।

 

প্রসঙ্গ থেকে কিছুটা দুরে চলে গেলাম বোধহয়। যেটা বলছিলাম, ব্যাংককে গেলে ওদের ছোট্ট নদী চা প্রায়াকে ঘিরে ওদের কর্ম চাঞ্চল্য, উদ্দীপনা অথবা ব্যবসায়িক পরিমন্ডল দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়। যে কাজ করা উচিৎ ছিলো আমাদের। সেটা করছে ব্যাংককবাসী। চা প্রায়া নদীকে কেন্দ্র করে প্রচুর রিভার ক্রুজ পরিচালিত হয়। এছাড়াও নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে অনেক পর্যটন কেন্দ্র, হোটেল আর রেস্তোরা। রাতের বেলা নদী পাড়ের স্থাপনাগুলো আলোক সজ্জায় সেজে উঠে। রিভার ক্রুজে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য নদী পাড়ের ব্যাংকক যেন নতুন রূপ ধারন করে।

বিগত ২০১৫-১৬ সালে ৩ মাসের ব্যবধানে দু’বার ব্যাংককে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমার। দু’বারই চা প্রায়া নদীতে ডাইনিং ক্রুজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আগে থেকেই আমি ঠিক করে রেখেছিলাম ডাইনিং ক্রুজের ব্যাপারটা। ফলে দুবার ই মিস করিনি। প্রথমবার ব্যাংকক গিয়েছিলাম ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে। আমাদের সাথে ২০-২৫ জনের বিশাল দল। অফিসিয়াল ট্যুর। ব্যাংককের ১১ নম্বর (সয় ইলেভেন) সুকুম্বি এলাকার এম্বাসেডর হোটেলে উঠেছিলাম। ব্যাংককের এম্বাসেডর হোটেল বাংলাদেশের পর্যটকদের চারন ভুমি বলা যায়। আসে পাশের বিভিন্ন হোটেলেও বাংলাদেশীদের অবস্থান করতে দেখা যায়। খুব কাছেই বামরুনগ্রাড হসপিটাল, যেখানে প্রচুর বাংলাদেশীর আগমণ হয় চিকিৎসা সেবা আর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য। এই এলাকায় তাই অনেক বাংলাদেশী মানুষ অবস্থান করে। বাংলাদেশী পর্যটকদের আধিক্যের কারনে এখানে বেশকিছু বাংলাদেশি দোকান ও খাবার হোটেল (রেস্তোরা) গড়ে উঠেছে। বাংগালীদের দোকান গুলো মজার। দোকান গুলোতে মোবাইলের সিম, জামা কাপড় থেকে শুরু করে ডলার কেনা বেচা, প্লেনের টিকিট সহ অনেক কিছুই পাওয়া যায়। তবে এসব দোকানের সবার সাইড ব্যবসা হচ্ছে ট্যুর প্যাকেজের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করা। আরেকটা মজার ব্যাপার না বললেই না, এখানে অনেক ভারতীয় দোকানদার বাংলায় সাইনবোর্ড দিয়ে বাংলাদেশিদের আকর্ষন করার চেষ্টা করে। তবে কথা বলার পর তার জাতীয়তার ধরন বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয়না।

এবার রিভার ক্রুজ বা ডাইনিং ক্রুজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত চলা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সবাইকে ওয়াকিবহাল করি। যেহেতু ব্যাংকক পর্যটন নগরী। নগরের সব জায়গায় সবচেয়ে বড় ব্যবসা ট্যুরিজম বা পর্যটন। দোকানে দোকানে, রাস্তা ঘাটে, বড় বড় হোটেলে বিক্রি হচ্ছে নানা প্রকার ভ্রমন প্যাকেজ। ভ্রমণ প্যাকেজের মধ্যে ২-৩ ঘন্টার ডাইনিং ক্রুজের নাম খুব সহজেই পাওয়া যায়। ডাইনিং ক্রুজের প্যাকেজগুলোতে অনেক জাহাজ। তবে আমরা যেহেতু বাংলাদেশ থেকে এসেছি তাই ভারতীয় ও বাংলাদেশী খাবার এবং গান বাজনা যে জাহাজে পাওয়া যায় সেটার প্যাকেজ টিকেট কাটা হলো। জাহাজের নাম চা প্রায়া প্রিন্স (Chao Phraya Princess Dinner Cruise) ) দাম নিলো ১ হাজার ৫০ থাই বাথ (থাইল্যান্ডি মুদ্রা) । এই টাকার ভিতরেই সব পাওয়া যাবে। জাহাজ ছাড়বে সন্ধা ৭টায়। হোটেলে প্যাকেজের গাড়ি থাকবে সন্ধা সাড়ে পাঁচটা কি ছয়টায়, সময়টা ভুলে গেছি। যেখান থেকে জাহাজ ছাড়ে সেই জায়গাটির নাম রিভার সিটি। বিশাল হুলুস্থুল ব্যাপার। রিভার সিটি আদতে একটা শপিং সেন্টার। সাথে জাহাজ ঘাট এবং বেশ কিছু রেস্তোরা।

আমরা সন্ধা সাড়ে ছয়টার মধ্যে রিভার সিটিতে পৌছে যাই ডাইনিং ক্রুজের প্যাকেজের ঠিক করা গাড়িতে। গাড়্রি ড্রাইভারই মুলত গাইডের কাজ করে। রিভার সিটির পার্কিয়ে গাড়ি পার্ক করে আমাদের মার্কেটের এক তালায় নিয়ে আসে সে। আমাদের সাথে বিভিন্ন দেশের আরও অনেক পর্যটক ছিলো। পরবর্তীতে দেখা গিয়েছিলো যে বেশিরভাগ পর্যটকই বাংলাদেশ আর ভারত থেকে গিয়েছে। উপমহাদেশের মানুষ মুলত বুুকিংয়ের সময় চা প্রায়া প্রিন্স জাহাজের টিকেট কাটে। দল বেধে অপেক্ষার অবসান ঘটলো থাই ঐতিহৃবাহী পোষাকে সজ্জিত দুই তরুনীর আবির্ভাবে। চা প্রায়া প্রিন্সের যাত্রীদের বিশেষ রঙের ষ্টিকার আর ফুলের ব্যাজ পরিয়ে দিলো তরুনী দুই জন। তারপর আবার ড্রাইভার কাম ট্যুর গাইডের পিছে পিছে মার্কেটের পিছন দরজা দিয়ে বেড় হয়ে নদীর পাড়ে। রিভার সিটির বিল্ডিংটা বেশ সুন্দর। নদীর পাড়ে শত শত মানুষ। একের পর এক আলোক মালা সজ্জিত জাহাজ ভিড়ছে ঘাটে আর ঐসব জাহাজের যাত্রীরা তাদের ষ্টিকার আর ফুল দেখিয়ে ঢুকে যাচ্ছিলো জাহাজের ভিতরে। নদী পাড়ে যেন উৎসব চলছে। নদীর যত দুর পর্যন্ত চোখ যায়, শুধু বিলাশ বহুল হোটেল, আলোক মালায় সজ্জিত প্যাগোডা বা পুরাতন ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা দেখা যাচ্ছিলো, যেগুলো অতি যত্নসহকারে আলো দিয়ে ঝলমলে করে রাখা হয়েছে। পুরো ব্যাপারটিতেই একটা জাতীয় পরিকল্পনার ছাপ পাওয়া যায়। ছোট একটা নদীকে কাজে লাগিয়ে হাজার হাজার ট্যুরিষ্টকে আনন্দ বিতরন করে যাচ্ছে ব্যাংকক নগর। বিপরীতে তারা আয় করছে কোটি কোটি বৈদেশিক মুদ্রা। হাসিমুখে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে যাচ্ছে নানা দেশের নানা জাতের মানুষ। রিভার সিটির নদী পাড়ে ব্যাপক ভীড়ের মধ্যেই ঘুরাঘুরি করে ছবি তুলে আর কফি খেতে খেতে আমাদের চা প্রায়া প্রিন্স জাহাজের আগমন হলো। পুরোটাই আলো দিয়ে ঘেরা জাহাজ। জাহাজ ঘাটে ভেরার পরে জাহাজের ক্রুরা গানের তালে তালে খুব সুন্দর করে যাত্রীদের স্বাগত জানিয়ে নাচ প্রদর্শন করে। যেটা খুবই আকর্ষনীয় মনে হয়েছে। জাহাজের ক্রুদের আগমনী গান শেষ হলে গেট খুলে দেয়া হয়। আমাদের বসার জায়গা আপার ডেট বা উপরের ডেকে ছিলো। টিকেটের রঙ দেখে আমাদের উপরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দেয়া হয়। জাহাজের উপরে উঠতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। একদম মাঝখানে ওভাল আকারে বুফ্যে খাবারের ব্যবস্থা। পুরো ডেকে ৮ টা চেয়ারের মাঝে একটা করে বড় টেবিল, এমন ভাবে অনেক টেবিল দেয়া ছিলো। আমরা একটা টেবিল দখল করে বসে পড়লাম। বসতে না বসতেই বেয়ারা এসে সবার জন্য সুস্বাদু পানীয়, বাদাম আর চিপস্ দিয়ে যায়। বাদাম চিপস্ খেতে খেতেই দেখি ভারতীয় যাত্রীরা সব ডিনারের প্লেট নিয়ে ব্যুফে খাবার নেয়া শুরু করে দিয়েছে। আমরাও লাইনে দাড়িয়ে খাবার নিয়ে নেই। বেশির ভাগই ভারতীয় খাবার। বিরানী কাবাব পেটপুরে খেতে খেতে নদী পারের অদ্ভুত সুন্দর আলোকমালা দেখতে ভালোই লাগে। ব্যাংককের বিখ্যাত স্থাপনাগুলোর অনেকগুলোই চা প্রায়া নদীর পাশে অবস্থিত। বিখ্যাত গ্রান্ড প্যালেসকে দিনের বেলার চেয়েও অনেক সুন্দর দেখতে লাগলো। ডাইনিং ক্রুজের বড় বড় জাহাজ ছাড়াও ছোট ছোট টিক বোট বা সেগুন কাঠের নৌকাতেও সুন্দর করে আলো সাজিয়েও রিভার ক্রুজ পরিচালনা করা হয়। মাত্র দুই ঘন্টার নদী ভ্রমণ কিন্তু আনন্দের কোন ঘাটতি রাখে নাই জাহাজ কতৃপক্ষ। প্রথম থেকেই একজন ডিজে জাহাজের ডেকে বিভিন্ন রকম কথা বার্তা বলে হিন্দি গান বাজিয়ে চলছিলো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে দু’একজন অতি উৎসাহি তরুন নাচানাচি শুরু করলো। আমরা ডেকের কিনারে দাড়িয়ে ছবি তুলতে তুলতে হালকা কৌতুকময় দৃষ্টিতে অতি উৎসাহি তরুনদের দেখতে না দেখতেই দেখি ফিডব্যাকের মেলায় যাইরে গানটা বাজছে। বিদেশে বসে নিজের দেশের গানে বাংগালীর রক্তে বান ডাকলো বোধহয়। এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাংলাদেশীরা দৌড় দিয়ে এসে নাচা শুরু করলো ডিজের সামনে। শুরু হলো ভারত বাংলাদেশ নৃত্য প্রতিযোগীতা। তাতে ভারতীয়দের আধিক্য ছিলো বলাই বাহুল্য, কিন্তু আমাদের বাংলাদেশীরা সংখ্যায় কম হলেও হইচইয়ে কম যায়নি।

ব্যাংককের ডাইনিং ক্রুজের অভিজ্ঞতা আসলেই বেশ মজার। ছোট এই ভ্রমণে বেশ অনেক কিছুই পাওয়া যায়। নদী পাড়ের অসাধারন দৃশ্য। টাইটানিকের পোজ দেয়া ছবি ইত্যাদি টুকরা টুকরা ছবি হৃদয়ের মনিকোঠায় সযত্নে রেখে দেয়ার মতো স্মৃতি হয়েই থাকবে।

লেখক: আনিসুল কবীর

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

Like Us On Facebook

Facebook Pagelike Widget
© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com