শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১০:৪৭ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

বৌদ্ধ মন্দিরের নগরী চিয়াং মাই

  • আপডেট সময় রবিবার, ১১ জুলাই, ২০২১

লানা রাজ্যের প্রাচীন রাজধানী এবং উত্তর তাইল্যান্ডের এক অন্যতম জনপদ চিয়াং মাই| যাওয়ার ইচ্ছেটা অনেকদিনের, কিন্তু ঠিক হয়ে উঠছিল না। অবশেষে সেই বৌদ্ধনগরীতে যাওয়া…

যেমন প্ল্যান করা ছিল তেমনই। চিয়াং মাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ক্যাব নিলাম হোটেলের উদ্দেশে| পরিষ্কার পরিছন্ন শান্ত শহর, রাস্তার মাঝখান দিয়ে খাল চলে গিয়েছে, দু’পাশে গাছগাছালির মাঝে সাজানো হোটেল, খাবারের দোকান, বাড়িঘর| দশ মিনিটেই হোটেল পৌঁছে গেলাম, নামেই হোটেল আসলে খানিকটা বাড়ির মতো| পৌঁছতেই তাঁরা হাসিমুখে আপ্যায়ন করলেন, আইসক্রিম দিলেন এবং প্রাতঃরাশ সেরে নিতে বললেন| দুটোর সময় চেক-ইন করার কথা, তবে তারা এক ঘণ্টার মধ্যেই ঘর পরিষ্কার করে খুলে দিলেন| একটা কথা জানানো আবশ্যক, এখানে চব্বিশ ঘণ্টা পানীয় জল, টাটকা ফল এবং চা কফি বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়| কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা শহরের পথে বেরিয়ে পড়লাম|

হোটেলের একদম কাছে (২০০ মিটার দূরত্বে) রাজা আনন্দ মহিদলের প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ মন্দির ওয়াট ফ্রাঁসিং (ওয়াট অর্থাৎ মন্দির)| তাইল্যান্ডের মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে বিশ্বাসী, তাই এখানে বিভিন্ন মন্দিরে বুদ্ধর ভিন্ন ভিন্ন রূপ দেখা যায়| এখানকার মন্দিরের কিছু বৈশিষ্ট্য বলে রাখা প্রাসঙ্গিক, অধিকাংশ মন্দির প্রাচীন, অসাধারণ কারুকার্য, চিত্রকলা দিয়ে সাজানো| বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে এক একটা মন্দির, অসম্ভব শান্ত, ভক্তরা নিস্তব্ধ প্রার্থনা করছেন বুদ্ধের চরণে| কিছু কিছু মন্দিরে সোনালি গম্বুজ তৈরি করা আছে, রঙিন ধাতু ও ক্রিস্টাল পাথরের এতো সুক্ষ্ম কাজ, যে একঝলক দেখলে মণি মানিক্য বলে ভ্রম হয়| ওয়াট ফ্রাঁসিং দেখে আমরা ওয়াট চেদি লুয়াং চলে এলাম| অনেকটা আমাদের দেশের কোনারক মন্দিরের মতো, আকাশছোঁয়া স্থাপত্য, চারদিকে বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি। তার থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে এসেছে| ওয়াট চেদি লুয়াংয়ের লাগোয়া ওয়াট ফানটাও, টিক কাঠের তৈরি অবিশাস্য সুন্দর এক মন্দির|

এরপর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শহরটাকে দেখতে লাগলাম, সবাই বলে ওল্ড সিটি| ওল্ড স্কোয়ারে থ্রি কিংস মনুমেন্ট দেখলাম, তারপর আরও দুটি মন্দির ওয়াট চিয়াংমান ও ওয়াট লোকমোলি দেখে সেদিনের মতো হোটেলে ফিরলাম| এখানে খাবারের প্রচুর জায়গা, রাস্তায় ভ্যানে যেরকম সসেজ, প্যানকেক, ডাম্পলিং, স্টিকি রাইস, চিকেন ফ্রাই, ফলমূলও বিক্রি হচ্ছে, আবার বিভিন্ন মূল্যের রেস্তোরাঁ আছে| এছাড়া সেভেন ইলেভেন স্টোর আছে, সেখানেও খুব কম দামে বিভিন্ন রকম খাবার পাওয়া যায়| পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়ে ব্রেকফাস্ট টেবলে এলাম| এখানে একটা বড় হলঘরে সকলের একসঙ্গে খাবার ব্যবস্থা| মার্সেলা হাসিমুখে এগিয়ে এসে জানতে চাইল, আমরা কী খেতে পছন্দ করি, সেইমতো বুফে ছাড়াও ও সবজি আর তর্তিল্লা দিয়ে রোল বানিয়ে খাওয়াল| আগের দিন হোটেলে কথা বলে রেড ট্রাক/সংযাথিউ ভাড়া করে রেখেছিলাম| রাস্তায় পড়ে চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে কিছুটা সময় কাটিয়ে শহর ছাড়িয়ে পাহাড়ি পথ ধরে ওয়াট উমং (সুড়ঙ্গ মন্দির নাম পরিচিত)| জঙ্গলে ঘেরা এক ছায়াময়, স্যাঁতস্যাঁতে, শেওলা ধরা ৭০০ বছরের প্রাচীন মন্দির চত্বর| মেংরাই সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত ওয়াট উমংয়ে বেশ কিছু সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছিল নির্বিঘ্নে সাধনা করার জন্য| শুরুতেই প্রচুর ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের পাথর মূর্তির ধ্বংসাবশেষ| সুড়ঙ্গ ধরে এগোলে প্রদীপ প্রজ্জলিত বুদ্ধ মূর্তি দেখা যায়, সেখান থেকে বেরোলে অশোক স্তম্ভের আকারে সুউচ্চ স্তম্ভ|

ওয়াট উমং থেকে বেরিয়ে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য দই সুথেপ| চিয়াং মাই শহর থেকে ১৫ কিমি দূরত্বে পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত, পুরাণ মতে বলা হয় সন্ন্যাসী সুমনাথেরা স্বপ্নাদেশ পেয়ে গৌতম বুদ্ধের কাঁধের হাড় খুঁজে পান| সেই হাড় পরবর্তী কালে দুভাগে বিভক্ত হয়ে যায়, এক ভাগ রাজা নু-নোয়ান একটি সাদা হাতির পিঠে চাপিয়ে সেটাকে জঙ্গলে ছেড়ে দেন| পাহাড়ের মাথায় গিয়ে হাতিটি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে উচ্চনাদ করে দেহত্যাগ করে, ঠিক এই জায়গায় পরে তৈরি হয় দই সুথেপ| প্রসঙ্গত তাইল্যান্ডকে সাদা হাতির দেশ আখ্যান দেওয়া হয়| মনে করা হয় মন্দিরের পবিত্র কাপড়ে নাম লিখলে আজীবন সেটা খোদাই হয়ে থাকবে| অসাধারণ শিল্পকার্য, অলংকরণ, অঙ্কনচিত্র এবং সর্বোপরি শান্তি ও শৃঙ্খলা বিরাজ করে এখানে| অবশ্যই উল্লেখ্য যে, এখান থেকে চিয়াং মাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পাখির চোখে দেখা যায়| মন্দিরের প্রবেশদ্বারে ৩০৯টি সিঁড়ি আছে, এছাড়া কেবল কারের ব্যবস্থাও আছে| ঘুরে আসতে পারেন চার কিমি দূরে মহারাজাদের শীতকালীন রাজকীয় বাসভবন ফুপিং প্যালেস| হাতে সময় নিয়ে চিয়াং মাই যান, ১০০ কিমি দূরে অবস্থিত দই ইন্থনন ন্যাশনাল পার্ক| পাহাড়ি গ্রাম, তাদের বৈশিষ্ট্যসূচক শিল্প, আচার-অনুষ্ঠান ও সমাজনীতি জানা যায়| জঙ্গলের মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক ঝরনা আছে, একটা দিন এখানে উপভোগ করলে মন্দ হয় না| সন্ধেবেলায় ঘুরতে গেলাম শহরের আরেকদিকে ওয়াট শ্রী সুফান (সিলভার টেম্পল নাম পরিচিত)| ঢুকতেই বিরাট এক গণেশের মূর্তি, দেখে বেশ ভাল লাগল| মন্দিরটি দেখে মনে হয় পুরোটাই রুপোর তৈরি, সন্ধে সাতটা নাগাদ এখানে আলো জ্বালানো হয়| রংবেরঙের আলো রুপালি মন্দিরের গায়ে ছিটকে পড়ে অসাধারণ শোভা তৈরি করে| বলে রাখা দরকার এই মন্দিরের গর্ভগৃহে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ| তাইল্যান্ডের যেকোনও মন্দিরে হাটু ও কাঁধ ঢাকা পোশাক পড়ে প্রবেশ করতে হয়| না পরে গেলে কিন্তু কারওরই ঢোকা হবে না!

হাতে সময় না থাকাতে আমাদের পরেরদিন ফুকেট যাওয়ার বিমান ধরতে হল| এই যাত্রায় আক্ষেপ রয়ে গিয়েছে চিয়াং রাই না ঘুরতে পারার| বছর কয়েক আগে কলকাতা দেশপ্রিয় পার্ক দুর্গা পুজোয় প্যান্ডেলে তাইল্যান্ডের এক অভূতপূর্ব মন্দির তৈরি করা হয়েছিল, এটি চিয়াং রায়ে অবস্থিত সাদা মন্দির/হোয়াইট টেম্পল| চিয়াং মাই থেকে গাড়িতে চিয়াং রাই যেতে ঘণ্টা তিনেক সময় লাগে। সময় নিয়ে গেলে ওখানকার বিখ্যাত জায়গাগুলো, যেমন ব্লু টেম্পল, হোয়াইট টেম্পল ও ব্ল্যাক হাউজ় ঘুরে না এলে পরে আফশোস থেকে যাবে কিন্তু!

কীভাবে যাবেন :

কলকাতা থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে বিমানে চিয়াং মাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর যাওয়া যায়| এছাড়াও ব্যাঙ্কক থেকে বাস অথবা ট্রেনে চিয়াং মাই পৌঁছনো যায়|

কোথায় থাকবেন :

অনলাইন যেকোনও ওয়েবসাইট থেকে বিভিন্ন মানের হোটেল বা রিসর্ট আছে, পছন্দমতো বুক করে নেবেন|

কখন যাবেন :

চিয়াং মাই পাহাড়ি অঞ্চল হলেও দিনের বেলা ভাল গরম থাকে, অক্টোবর থেকে মার্চ অবধি সুন্দর আবহাওয়া থাকে| সঙ্গে ভাল সানব্লক, রোদচশমা অবশ্যই নেবেন|

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com