স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের মোহনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঢাকা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রাম। গ্রামগুলোর অপার সৌন্দর্য একইসঙ্গে নয়নাভিরাম ও বৈচিত্রময়। প্রত্যেকটি ঋতুর পরিবর্তনের সাথে তারা পাল্টে যায় নতুন রুপে, নতুন বৈশিষ্ট্যে। যদিও ক্রমাগত নগরায়নর ফলে গ্রামের সৌন্দর্য এখন হুমকির মুখে, গ্রামের নানা ঐতিহ্য, রুপ আর সৌন্দর্য আর দেখতেই পাওয়া যায় না। তবুও যা টিকে আছে তার কতটুকুই বা উপভোগ করি আমরা? গ্রামের মনোলোভা সৌন্দর্য অবগাহন করতে তাই তো পল্লীকবি জসিমউদ্দীন আকুল কন্ঠে ডেকেছিলেন ‘নিমন্ত্রণ’ কবিতায়-
সবুজের চাদরে মুড়ানো অপরুপ সৌন্দর্যের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের প্রাকৃতিক দৃশ্য শােভা সকলকে মুগ্ধ করে। বাংলাদেশের প্রকৃতির সৌন্দর্যের রূপ খুবই বিচিত্র। এদেশের হাওর-বিল, নদ-নদী, মাঠ-ঘাট, আকাশ, পাহাড়, অরণ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হই।
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির রূপ :
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলা নিকেতন । এদেশে রয়েছে উঁচুনিচু পাহাড়, সুনীল সাগর, অবারিত মাঠ, সুবিস্তৃত সুনীল আকাশ– যা এক অপূর্ব চিত্তহারী সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে । নদীবিধৌত সরস ভূমি বলেই হয়তাে এখানে অনায়াসে অসংখ্য বৃক্ষ জন্মে— যা সবুজের সমারােহ সৃষ্টি করে।
সরকারি হিসাবে বাংলাদেশের গ্রামের সংখ্যা প্রায় সত্তর হাজারের মতো। সবচেয়ে বড় গ্রাম সিলেটের হবিগঞ্জবানিয়াচ ও সবচেয়ে ছোট গ্রামতিলইন। তিলইন গ্রামের অবস্থান কুমিল্লার লালমাই উপজেলার বেলঘর ইউনিয়নে। সবচেয়ে ছোট এই গ্রামে লোকসংখ্যা মাত্র ৩৮ জন। অপরদিকে ১২০টি পাড়া ও ৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত সবচেয়ে বড় গ্রাম বানিয়াচংয়ে বাস করেন ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ। বলা হয়ে থাকে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গ্রাম ও ছোটগ্রামও বানিয়াচং ও তিলইন!
নদীপ্রধান দেশ হওয়ায় বাংলাদেশের অধিকাংশ গ্রামের সাথে নদীর নিবিড় সম্পর্ক। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকার সাথেও নদীর সম্পর্ক রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, সুরমা, করতোয়া, ব্রহ্মপুত্র সহ দুই শতাধিক নদী বয়ে গেছে অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলের বুক চিরে। নদী ছাড়াও রয়েছে হাজারো খাল, বিল, হাওড় ও বাওড়। প্রত্যেকটি গ্রামেই দেখা মেলে এমন জলাশয়ের। গ্রামগুলোর সৌন্দর্য ও বৈচিত্রের প্রধান অনুসঙ্গ এসব জলাশয়। বাংলাদেশের গ্রামগুলোর নামগুলো যেমন চমৎকার, মনে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে তেমনি সু্ন্দর অধিকাংশ হাওড়, বাওড়, বিলগুলোর নামও। যেমন হাকালুকি হাওড়, চলন বিল, বিল ডাকাতিয়া, তামাবিল, টাঙ্গুয়ার হাওড় ইত্যাদি।
অধিকাংশ গ্রামগুলোতে শুধুমাত্র প্রকৃতির আচরণের সাথে তাল মিলিয়ে চলে গ্রামের জীবনযাত্রা। রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, বর্ষা সবকিছুর সাথেই গ্রামের জীবনযাত্রার রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। ঋতু বদলের সাথে সাথে বদলায় গ্রামের রং, রুপ, লাবণ্য।
তাই তো শরতে দেখা যায় শুভ্র মেঘ, কাশফুল, ঝকঝকে নীলাকাশের অপূর্ব সংমিশ্রণ। নদীর তীরে তীরে শুভ্র কাশফুল, গাছে গাছে হাসনাহেনা কিংবা শিউলী, কামিনী, বেলী, বিলে-ঝিলে শাপলার সমারোহে একেকটি গ্রাম ঢেকে যায় এক আশ্চর্য রূপমাধুরীতে।
কখনো আনন্দের বার্তা নিয়ে নামে শরতের বৃষ্টি। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টি হৃদয় মনকে করে তোলে প্রফুল্ল। বৃষ্টি শেষে দিগন্তজুড়ে রংধনু মনের মাঝেও যেন আঁকিয়ে দেয় রং। নরম রোদের সকাল, রঙমাখানো সূর্যাস্ত, রাতের স্বচ্ছ আকাশে চাঁদ কিংবা লাখো নক্ষত্র শরতের সৌন্দর্যকে করে তোলে অপার্থিব। শরতের রুপে মুগ্ধ হয়ে নজরুল লিখেছেন,
সই পাতালো কি শরতে আজিকে স্নিগ্ধ আকাশ ধরনী?
নীলিমা বাহিয়া সওগাত নিয়া নামিছে মেঘের তরনী!
হেমন্তে আবার গ্রাম পাল্টে যায় অন্যরকম আবহে। নির্মল প্রকৃতি আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠে পাকা ধানের উপর সূর্যের কিরণে চারপাশে বিচরণ করে সোনালী আভা। কালের বিবর্তনে দিগন্তজোড়া মাঠ হারিয়ে গেলেও গ্রামের পথে প্রান্তরে হেমন্তের সৌন্দর্যে ভাটা পড়েনি আজও। পাতাঝরার এ ঋতুতে ফোটে কামিনী, অপরাজিতা, গন্ধরাজ, মল্লিকা সহ নানা রকম ফুল। নবান্ন উৎসবের সাথে পিঠা পায়েস আর নদী-নালা, খাল-বিলের হাঁটুপানিতে দেখা যায় মাছ ধরার উৎসব। মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালী রুপ সৃষ্টি করে হৃদয় ভোলানো আবহের।
শীতে হেমন্তের সাজ খুলে ফেলে গ্রামগুলো ঢেকে যায় কুয়াশার চাঁদরে। সেই কুয়াশা ভেদ করে সকালের সোনালী রোদ যখন গ্রামগুলোতে উঁকি দেয়, তখন দেখা মেলে ভিন্নরকম এক সৌন্দর্যের পশরা। মাঠ জুড়ে হলুদ সরিষাফুল, বিভিন্ন রকম শাক-সবজির বিপুল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সমারোহ শীতের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে বহুগুণ। পল্লীকবির ভ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’
তবে গ্রামের রুপ সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে বর্ষায়। চারদিকে থৈ থৈ পানিতে গ্রামগুলো যেন ভেসে থাকে। সে এক অপরুপ দৃশ্য। রিমঝিম বৃষ্টি আর মেঘ বাদলের লুকোচুরিতে প্রাণ ফিরে পায় প্রকৃতি। ডালে ডালে ফোটে দৃষ্টিনন্দন কদম। বৃষ্টি ও বন্যায় ঝকঝকে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য আছে কার?
তবে সবুজের সমারোহ বাংলাদেশের প্রত্যেকটি গ্রামেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ছবির মতন গ্রামগুলো সৃষ্টিকর্তা যেন এঁকেছেন আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে। সব গ্রামেই চালতা, বেলী, নয়নতারা, কলমি, কামিনী, অপরাজিতা, কাঠালচাঁপা, দোলনচাঁপা, শিমুল, ঝুমকো জবা, শাপলা, জারুল, ঘাসফুল সহ হাজারো প্রকৃতির ফুল গ্রামগুলোর আনাচে-কানাচে, ঝোপে-ঝাড়ে শোভাবর্ধন করে আপন মহিমায়। মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ঘুরে বেড়ায় শালিক, ময়না, টিয়া, ডাহুক, মাছরাঙ্গা, বক, বউ কথা কও, তিতির, চখাচখি, কাঠঠোকড়া, মোহনচূড়া, মাছরাঙা, পাপিয়া, ফিঙে, তোতা সহ হাজারের কাছাকাছি প্রজাতির পাখি। আম, জাম, কাঠাল, লিচু, জাম, করমচা, নারিকেল, সুপারি তাল সহ অসংখ্য প্রজাতির গাছ আর লতাপাতার নিবিড় ঘনিষ্ঠতা গ্রামগুলোর মোহনীয়তাকে পরিপূর্ণতা দিয়েছে। দেশের যেকোনো গ্রামে বাঁশঝাড় কিংবা বটের ছায়ায় বসে পাখির কিচির-মিচিরের সাথে একটি লগ্ন আপনার হৃদয়কে হাজার বছর বাঁচার জন্য আগ্রহী করে তোলার জন্য যথেষ্ট।
বাংলাদেশের গ্রামগুলো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে ঢাকা থাকলেও বাংলাদেশে গ্রাম পর্যটনের কোনো কার্যকর ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়নি এখনো। যার ফলে দৃষ্টির আড়ালেই থেকে যাচ্ছে গ্রামের নৈসর্গিক সৌন্দর্য আর জীবন বৈচিত্র। নগরায়নের প্রভাবে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য। হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য। তারপরেও সকল প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে টিকে থাকা গ্রামীণ সৌন্দর্যকে আমরা চাইলেই উপভোগ করতে পারি। নিশ্চিন্তে হারিয়ে যেতে পারি প্রকৃতির কোলে। গ্রামগুলো বেঁচে থাকুক তার আপন মহিমায়। অতুলনীয় সৌন্দর্য, বৈচিত্র আর ঐতিহ্যগুলোও টিকে থাকুক প্রজন্মের অহংকার হয়ে।