শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫০ অপরাহ্ন

বেশি বাংলাদেশীরা কেন সিডনির লাকেম্বায় বসবাস করেন

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৩

২০১৬ সালের সেনসাস রিপোর্ট অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাভাষীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫.৯ শতাংশ বসবাস করেন সিডনির লাকেম্বায়। ২০১১ সালের সেনসাসেও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাসের দিক দিয়ে লাকেম্বা শীর্ষ স্থানে ছিল। সিডনির লাকেম্বায় কেন বাংলাভাষীরা বেশি বসবাস করেন?

সিডনির লাকেম্বায় কেন বাংলাভাষীরা বেশি বসবাস করেন?

ভৌগোলিক অবস্থান:

ক্যান্টারবেরি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের, যে সিটি কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত লাকেম্বা, সেই কাউন্সিলের বাংলাদেশী কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, লাকেম্বা খুব মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে, এম-ফাইভের (মোটরওয়ের) কাছাকাছি। ‘আপনি যদি ড্রাইভ করেন, তাহলে সহজেই সিটিতে যেতে পারছেন। আপনি সহজে ট্রেনে করেও চলে যেতে পারছেন।’

ইলেক্ট্রিকাল-এয়ারকন্ডিশন কন্ডাক্টর মোহাম্মদ ইরফান খান লাকেম্বায় বসবাস করেন। ২০০৭ সালে তিনি অস্ট্রেলিয়ায় আসেন। তখন র‌্যান্ডউইকে থাকতেন। ২০১৪ সালে তিনি লাকেম্বায় বাড়ি কিনে বসবাস করা শুরু করেন।

বাংলাদেশীরা কেন লাকেম্বায় বসবাস করেন? এ প্রশ্নের  জবাবে তিনিও ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বলেন। তিনি নিজে লাকেম্বায় বাস করছেন, কারণ, তার পেশাগত কারণে বৃহত্তর সিডনি জুড়ে তাকে ছুটে বেড়াতে হয়। লাকেম্বার ভৌগোলিক অবস্থান এ রকমই যে, এটি মাঝামাঝি হয়, ফলে তিনি সহজেই যে-কোনো দিকে যেতে পারেন।
প্রথম দিকে, আমরা যখন এসেছিলাম, তখন হিলস ডেল এবং ইস্টলেকের দিকে বাঙালিরা বেশি ছিল। তারপর আবার আস্তে আস্তে ওয়েস্টের দিকে চলে গেছে বাঙালিরা।

সমাজকর্মী, অ্যাকাডেমিক, সাহিত্যিক এবং সংস্কৃতি-কর্মী ড. কাইউম পারভেজ ১৯৯২ সাল থেকে সিডনিতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, লাকেম্বা ও ওয়ালিপার্ক মাঝামাঝি স্থান। এখান থেকে সহজে সিটিতে ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাওয়া যায়।

“আমাদের ছাত্র-ছাত্রীরা যারা আসে, তারা প্রথমত, এখানে বাবার পয়সায়, বাবা-মায়ের সহায়তায় আসলেও, সেটা দিয়ে তো বেশি দিন টিকে থাকা যায় না। সে কারণে প্রত্যেককেই ছোটখাট কাজ খুঁজতে হয়। কাজ খুঁজতে গেলে, শহরের দিকেই কাজ বেশি। সে জন্যই লাকেম্বা ও ওয়ালিপার্ক একটা মাঝামাঝি জায়গা বলতে পারেন। এখান থেকে শহরে যাওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যাওয়া বা কলেজগুলোতে যাওয়া, এটা খুব কাছাকাছি হয়। কারণ, ট্রেন খুবই নিয়মিত পাওয়া যায় এবং হাতের নাগালে ট্রেন।”
বাসা ভাড়া কম:
কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, ‘আমি তো ২০০৪ এ এখানে (লাকেম্বায়) এসেছি। আসার পরে যেটা অনুভব করেছি, এখানে তত বেশি দোকান ছিল না, সেটা সত্য। কিন্তু আসলে, এখানে বাসা ভাড়াটা খুব কম ছিল।’
‘বাসা ভাড়াটা খুব কম, আমাদের বাংলাদেশীদের জন্য। আমরা স্টুডেন্ট হিসেবে এখানে এসেছি। তাই, আমাদের জন্য সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল।’
গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো
অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অফ স্টাটিস্টিক্স (এবিএস) এর তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের সেনসাস রিপোর্টে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫৪,৫৬৭ জন।
  • অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাভাষীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫.৯ শতাংশ বসবাস করেন সিডনির লাকেম্বায়।
  • ২০১১ সালের সেনসাস রিপোর্টে অস্ট্রেলিয়ায় মোট বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল ৩৫,৬৪৬ জন।

বাংলাদেশী পণ্যের দোকানপাট ও রেস্টুরেন্ট:

কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, “২০০৭-৮ সালের সময়টাতে অনেকগুলো দোকান হয় এখানে।”

তিনি বলেন, সিডনির বিভিন্ন সাবার্ব থেকে বাঙালিরা বাজার করতে লাকেম্বায় আসেন। রেস্টুরেন্টের জন্য আসেন লাকেম্বাতে।

সিডনির কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের ওয়েন্টওয়ার্থভিল ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুমন সাহা অস্ট্রেলিয়ায় এসেছিলেন আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী হিসেবে। যদিও তিনি লাকেম্বায় বসবাস করেন না, তথাপি লাকেম্বা ও এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বাংলাদেশীদের বহুল-সংখ্যায় বসবাসের কারণ উল্লেখ করে বলেন, যারা লাকেম্বায় বসবাস করেন না, তারাও বাজার-সদাই করার জন্য লাকেম্বায় ছুটে যান। বাংলাদেশের খাবারের জন্য।

Prayers at the Lakemba Mosque in 2019.
Members of the muslim community celebrate Eid al-Fitr, marking the end of the month-long fast of Ramadan with prayer at Lakemba Mosque in Sydney in 2019. Source: AAP

হালাল ফুড ও মসজিদ:

অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই বাংলাদেশী এবং মুসলমান। ২০১৬ সালের সেনসাস রিপোর্ট অনুসারে, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৭৮.২ শতাংশ ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং ১৬.৩ শতাংশ হিন্দু। আর, বাংলাভাষীদের ৩ শতাংশ কোনো ধর্মের অনুসারি নন বলে সেনসাসে উল্লেখ করেছেন।

লাকেম্বার ইরফান খান বলেন, ‘শুরুতে বাংলাদেশীরা লাকেম্বায় বাস করা শুরু করেন, কারণ, এখানে লেবানিজ মুসলমানরা থাকতো। তাই, হালাল খাবারের কারণে তারা এখানে আসেন। শুরুতে এসব বিষয়ে মানুষের শিখতে সময় লেগে যায়। পরবর্তীতে, এখানে বাংলাদেশীরা বেশি থাকায় নতুনরাও এখানে আসে, বাংলাদেশী খাবার, সমাজ ইত্যাদির কারণে।’

কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, ‘নম্বর টু হচ্ছে, হালাল ফুড। আপনি অন্যান্য সাবার্বে থাকলে মুসলিম অধ্যষিত এলাকাগুলোতে আসতেই হচ্ছে আপনার হালাল ফুডের জন্য।’

‘মসজিদ আছে এখানে। মুসলিম সেই টাচটা আছে, যেটা আমরা বাংলাদেশ ফিল করি, ঐটা আসলে আমরা এখানে পেয়েছি। পাওয়ার কারণেই এখানে আসলে বেশি লোক সমবেত হয়েছে।’

লাকেম্বায় বাংলাদেশীরা কি সাময়িকভাবে থাকেন?

কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন,

‘আর, আরেকটা বিষয় হচ্ছে, এটা অনেক বেশি বৈচিত্রপূর্ণ এলাকা। যখন (বাংলাদেশী) মানুষ অস্ট্রেলিয়াতে আসে, প্রথমে কিন্তু লাকেম্বা, ওয়ালি পার্ক, পাঞ্চবৌল থেকেই তাদের যাত্রা শুরু হয়। আপনি যত বাংলাদেশী দেখবেন, আপনি দেখবেন ৯৫ শতাংশ, আমি বলতে চাই, ৯৫ শতাংশ লোক কোনো না কোনো সময়ে, যখন আসছেন, প্রথমে শুরু করেছেন লাকেম্বা থেকে। এরপর, তারা বিভিন্ন এলাকাতে গেছেন।”

তিনি বলেন, তারা চলে যাওয়ার পরও লাকেম্বা খালি থাকে না, কারণ, নতুন নতুন লোক এখানে আসেন। তার মতে,

“যাদের দেশের প্রতি বেশি অ্যাটাচমেন্ট, তারা সুযোগ পেলেই এখানে চেষ্টা করছে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য।”
নতুন যারা আসে, তাদের জন্য লাকেম্বা খুবই একটি আকর্ষণীয় জায়গা বলে আমি মনে করি। কারণ, এখানে কাজেরও সুবিধা আছে, থাকা-খাওয়ার সুবিধা আছে, যাতায়াতের সুবিধা আছে এবং সবচে’ বড় কথা, কমিউনিটিতে নিজেদের সুখ-দুঃখ শেয়ার করার জন্য মানুষজনও আছে।

কখন থেকে বাংলাদেশীরা লাকেম্বায় বসবাস শুরু করেন?

অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ প্রেস অ্যান্ড মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি, সাংবাদিক, সমাজ-কর্মী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রহমত উল্লাহ অস্ট্রেলিয়ায় আসেন ১৯৮৮ সালে। লাকেম্বায় বাংলাদেশীদের বহুল সংখ্যায় বসবাস ও আনাগোনা সম্পর্কে তিনি বলেন,

“এটা তো সময়ের তাগিদে সবসময়েই হয়েছে। কিন্তু, প্রথম দিকে, আমরা যখন এসেছিলাম, তখন হিলস ডেল এবং ইস্টলেকের দিকে বাঙালিরা বেশি ছিল। তারপর আবার আস্তে আস্তে ওয়েস্টের দিকে চলে গেছে বাঙালিরা। তারপর যখন এটা মিন্টো, ক্যাম্বেলটাউনের দিকে অনেকে বাড়ি করে চলে গেছে, ওই দিকে। আর, লাকেম্বার দিকে একটা গ্রুপ চলে আসছে, মানে দোকান-পাট দিয়ে শুরু হয়েছে লাকেম্বার (বাংলাদেশীদের) বসতি। বাঙালি দোকান অনেক জায়গাতেই আছে, কিন্তু, লাকেম্বায় একটু বেশি দোকান শুরু হলো আর কি। আস্তে আস্তে, ২০০০ সালের পরে।”

সিডনির কাম্বারল্যান্ড কাউন্সিলের ওয়েন্টওয়ার্থভিল ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুমন সাহা বলেন,

“আমাদের আগে যারা অস্ট্রেলিয়াতে, সিডনিতে এসেছেন, তাদের একটা বড় অংশ নিউ জিল্যান্ড থেকে এসেছেন এবং আমাদের আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা যারা পড়াশোনা করার জন্য সিডনিতে এসেছে, তারাও যখন দেখছে যে, আমাদের কমিউনিটির একটা বেশি-সংখ্যক জনসংখ্যা বা কমিউনিটির লোকজন এই লাকেম্বা এবং ওয়ালী পার্কে, এই এলাকায় বসবাস করছে, তারা স্বাভাবিকভাবে মনে করছে যে, নিজেরা আমরা একসাথে থাকি। তাহলে আমরা হয়তো একে অপরকে প্রয়োজনে সাহায্য করতে পারবো।”

“আরেকটা বড় ব্যাপার, ২০১১ সাল ২০১২ সালের কথা। আমার এখনও মনে পড়ে, লাকেম্বাতে কিন্তু এত বাংলাদেশী দোকান, গ্রোসারি শপ বা রেস্টুরেন্ট ছিল না। ২০১৬-১৭ এর দিক থেকে কিন্তু আমাদের বাংলাদেশীরা বিজনেস, গ্রোসারি শপ হোক বা আপনার কাপড়েরর দোকান হোক, অথবা রেস্টুরেন্ট হোক, এগুলো কিন্তু আপনার এবং বুচার শপ, আপনার বেশি সংখ্যায় লাকেম্বাতে প্রতিষ্ঠিত হয়। যেহেতু আপনার, সহজলভ্য লাকেম্বাতে। আমরা বাঙালিরা খেতে পছন্দ করি, আমরা উইক-এন্ডে (সপ্তাহান্তে) মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করতে, বন্ধুদেরকে নিয়ে মেলামেশা করতে পছন্দ করি। স্বাভাবিকভাবেই, এই কমফোর্ট জোনটা কিন্তু আপনি কোথাও পাবেন না। তো, এই কমফোর্ট জোনটা আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটি লাকেম্বাতেই পেয়েছে। এই কারণে সার্বিকভাবে/স্বাভাবিকভাবে আমাদের কমিউনিটি এই লাকেম্বা এলাকায় বা এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস করা শুরু করেছে।”

বাংলাদেশীরা কেন লাকেম্বায় বেশি সংখ্যায় বসবাস করেন— এ প্রশ্নের জবাবে ক্যান্টারবেরি-ব্যাংকসটাউন সিটি কাউন্সিলের সাবেক কাউন্সিলর, লিবারাল পার্টির সদস্য, ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহে জামান টিটু বলেন,

“এটা যেহেতু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা, এখানে মসজিদ ছিল। পাশাপাশি, অনেকগুলো মুসল্লা (নামাজ সেন্টার) গড়ে উঠে যেখানে মানুষ নামাজ পড়া থেকে শুরু করে ইসলামী কার্যক্রমের সুবিধা অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি ছিল এবং যেহেতু সিটি থেকে কাছে, আর, বাসা ভাড়াও কিছুটা সস্তা ছিল। এ কারণে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা এখানে বসবাস শুরু করেন।”

কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, আপনি যখন লাকেম্বা রেলওয়ে প্যারেডে হাঁটেন, আপনি অনুভব করেন না যে, আপনি বাংলাদেশের বাইরে আছেন।
কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন, আপনি যখন লাকেম্বা রেলওয়ে প্যারেডে হাঁটেন, আপনি অনুভব করেন না যে, আপনি বাংলাদেশের বাইরে আছেন। 

শুরুটা কীভাবে হলো? এত স্থান থাকতে লাকেম্বায় কেন? মূলত কবে থেকে এখানে বাংলাদেশীরা বসবাস শুরু করলেন? এসব বিষয়ে মোহাম্মদ শাহে জামান টিটু বলেন,

“আমি লাকেম্বায় আসি ২০০৫ সালে। তখন থেকে আমি দেখতে পেলাম সেটা, সেটা হল বাংলাদেশীরা ক্রমান্বয়ে এখানে বসবাস করা শুরু করছেন। যেহেতু এখানে অ্যামেনিটি, স্টেশন, মসজিদ, বাংলাদেশীদের দোকানপাটের উত্থান, তখন মাত্র শুরু হচ্ছে। আর, এভাবেই বাংলাদেশীদের এখানে বসতি শুরু হয়। পরবর্তীতে যেটা দেখা যায়, যেহেতু অনেক বাংলাদেশী এখানে বসবাস শুরু করে, পাশাপাশি, খুব নিত্য প্রয়োজনীয় যে জিনিসপত্রগুলো, সেগুলোর জন্য আস্তে আস্তে দোকানপাটগুলোতে গড়ে উঠে। যেমন, এখানে বাংলাদেশী গ্রোসারি শপ ছিল সেটা হল ক্রয়োডন স্ট্রিটে এবং রেল প্যারেডের কর্নারে। সেটা রান করতো আমাদের হাসান সাহেব।”

লাকেম্বায় বাংলাদেশীদের দোকান-পাট শুরু হয় মূলত ২০০০ সালের আগে থেকে, ১৯৯০ এর দশকে। মোহাম্মদ শাহে জামান টিটু বলেন,

“(২০০০ সালের আগে) সেখানে প্রথম দোকান আরম্ভ করে আমাদের আমীর ভাই এবং বাসার খান ভাইরা, বাংলাবাজার নামে। যেটা এখন বর্তমানে খুশবু রেস্টরেন্ট।”

“তারপরে আপনার, রেলওয়ে প্যারেডের ঐ পাশে ফারুক হান্নান ভাই নামে একজন কোয়ান্টাসের ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। উনি এখানে শুরু করেন, রেলওয়ে প্যারেডের পাশে, যেটা এখন মদীনা গ্রোসারি। তারপর, বেলমোরে যে ছিলেন শাহালম খান। সেটা আমি পরে ‘বাংলাদেশ প্যালেস’ কিনে নিই। ২০০৫ সালে তিনি বাংলাদেশ প্যালেস প্রতিষ্ঠিত।”

লাকেম্বা-বেলমোর চেম্বার অফ কমার্সের সেক্রেটারি মোহাম্মদ শাহে জামান টিটুর মতে, লাকেম্বায় ৭৫ শতাংশেরও বেশি ব্যবসার মালিক হলো বাংলাদেশীরা।

“বর্তমানে, লাকেম্বা-বেলমোর চেম্বার অফ কমার্সের এরিয়ার মধ্যে, … আমি লাকেম্বা-বেলমোর চেম্বার অফ কমার্সের সেক্রেটারি। এখানে প্রায় ২৭৬ টার উপরে বিজনেস আছে, এই এরিয়ার মধ্যে। তার মধ্যে মেজরিটি, ৭৫ শতাংশেরও বেশি ব্যবসায় মালিক বাংলাদেশীরা।”

“বাংলাদেশীদের এখানে অ্যাকাউন্টিং ফার্ম, রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি, সব ধরনের যে বিজনেসগুলো আছে, বাংলাদেশীরা এখন বেশিরভাগগুলোর মালিক।”

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মিলনমেলা লাকেম্বা

কাউন্সিলর সুমন সাহা বলেন,

“আমি নিজে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হিসেবে অস্ট্রেলিয়াতে আসি। একটা সময়ে আমি অবার্নে ছিলাম। আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে আমারই পরিচিত এক দিদি ও জামাইবাবু, উনার নাম অরবিন্দ সাহা, উনারা লাকেম্বাতে ছিলেন। এবং আমরা আমার প্রতিবেশী মুনিরুল আলম ভাই করে একজন, উনারা আমরা একসঙ্গে অবার্নে থাকতাম। পরে উনিও কিন্তু, এই যেহেতু লাকেম্বাতে সবকিছু, বাঙালি সবকিছু পাওয়া যায়, সহজলভ্য, এবং ওখানে আমাদের একটা বড় কমিউনিটি থাকে। এ কারণে উনিও পরবর্তীতে লাকেম্বাতে মুভ করেন।”

“আমার নিজের, আমি দেখেছি যে, লাকেম্বাতে আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটি, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, সবাই একসাথে মিলেমিশে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বসবাস করে। আমি দেখেছি যে, ঈদ, ঈদের সময়ে যেমন একে অন্যের বাসায় গেছে সৌহার্দ্য বিনিময় করতে, ঠিক পূজার সময়েও আমি দেখেছি ঠিক সেই দেশের মতো যে, সবাই আমরা পার্বনের সময়ে এক, আমরা সবাই সবার আত্মীয়, সবাই একসাথেই সবকিছু শেয়ার করি। ঐ জিনিসটা মানুষ আসলে ফিল করতে পেরেছে যে, আমরা দেশ থেকে বহু দূরে, কিন্তু, যখন কোনো পার্বন হয়, ঈদ, পূজা, তখন আবার আমরা সবাই একসাথে চেষ্টা করে সেই বাংলাদেশের মতো সেই আমেজটা এখানেও ফিরিয়ে আনতে।”

তিনি আরও বলেন,

“সেই আমেজে এখানে উৎসব করতে। সেই জিনিসটা আমিও লাকেম্বাতে গেছি। আমার আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি, বন্ধু-বান্ধবের বাড়ি। সেই জিনিসটা আমি সবসময় ফিল করেছি।”
দেশের বাইরে দেশ

লাকেম্বায় বাংলাদেশী আমেজ সম্পর্কে ড. কাইউম পারভেজ বলেন,

“এ সমস্ত দিক মিলিয়ে, নতুন যারা আসে, তাদের জন্য লাকেম্বা খুবই একটি আকর্ষণীয় জায়গা বলে আমি মনে করি। কারণ, এখানে কাজেরও সুবিধা আছে, থাকা-খাওয়ার সুবিধা আছে, যাতায়াতের সুবিধা আছে এবং সবচে’ বড় কথা, কমিউনিটিতে নিজেদের সুখ-দুঃখ শেয়ার করার জন্য মানুষজনও আছে। ফলে, হোমসিক থাকলেও এখানে অতোটা মনে হয় না। ফলে, সবদিক দিয়ে, এটা থাকার জন্য একটা সম্পূর্ণ অনুকূল পরিবেশ।”

লাকেম্বায় বাংলাদেশীদের বাড়ি করা ও বাংলাদেশী আমেজ সম্পর্কে কাউন্সিলর মোহাম্মদ নাজমুল হুদা বলেন,

“লাকেম্বায় বাঙালীদের বাড়ি অবশ্যই আছে। যারা ঐ কমফোর্টটা এখানে পেয়ে গেছে যে, বাংলাদেশী যে একটা কালচার আছে, আমরা এই কালচারে থাকতে চাই। এখানে দোকান আছে। আপনি যখন লাকেম্বা রেলওয়ে প্যারেডে হাঁটেন, আপনি অনুভব করেন না যে, আপনি বাংলাদেশের বাইরে আছেন।”

ক্যাম্বেলটাউন ও মিন্টো এলাকা কি লাকেম্বাকে ছাড়িয়ে যাবে?

লাকেম্বাকে ছাপিয়ে ক্যাম্বেলটাউন, মিন্টো— এসব এলাকায় বাংলাদেশীদের ঘনবসতি বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। এ সম্পর্কে সাবেক কাউন্সিলর মোহাম্মদ শাহে জামান টিটু বলেন,

“লাকেম্বা এরিয়াটি এখন বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি আমি ইদানিং যে খেয়ালটা করছি, সেটা হলো, ইঙ্গলবার্ন, মিন্টো, ক্যাম্বেলটাউন এরিয়াটা এখন বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকায় পরিণত হচ্ছে, যেখানে এই লাকেম্বার চেয়েও বিশাল জনগোষ্ঠী দ্বিগুণের চেয়ে বেশি জনগোষ্ঠী এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে।”

তিনি বলেন, বাংলাদেশী আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের স্থায়ী অভিবাসন হয়ে গেলে তখন তারা লাকেম্বা ছেড়ে অন্যান্য স্থানে চলে যায়।

“এখান থেকে যখন তারা পি-আর, সিটিজেন হয়ে যায়, তারা তখন মুভ করে ঐ এলাকাগুলোতে এবং নতুন যেহেতু, প্রায় ২৭/২৮ হাজার ঐ পাশে ওয়েস্টার্ন সাবার্বে হচ্ছে, তো ঐখানে সবাই মুভ করছে। সেই অনুযায়ী আমার মনে হয়, লাকেম্বা এরিয়ার চেয়েও এখন বড় ঘনবসতি বাংলাদেশীদের এরিয়ার পরিণত হচ্ছে ক্যাম্বেলটাউন, মিন্টো, ইঙ্গলবার্ন, ক্যামডেন, গ্লেনফিল্ড, এই এরিয়াগুলো।

পরিসংখ্যানের আলোয়

অস্ট্রেলিয়ান ব্যুরো অফ স্টাটিস্টিক্স
) এর তথ্য অনুসারে, ২০১৬ সালের সেনসাস রিপোর্টে দেখা যায়, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫৪,৫৬৭ জন। এর মধ্যে ইসলাম ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ৭৮.২ শতাংশ এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বীর সংখ্যা ১৬.৩ শতাংশ।

প্রসঙ্গত, অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার ২৪.৬ শতাংশই হচ্ছে ওয়েস্টার্ন ক্যাথোলিক। তবে, “নো রিলিজিয়ন” বা ধর্মহীন ব্যক্তির সংখ্যা, পরিসংখ্যান অনুসারে, তার চেয়েও বেশি (৩২.৬ শতাংশ)। বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর ৩ শতাংশ কোনো ধর্মের অনুসারি নন বলে জানিয়েছেন।

২০১১ সালের সেনসাস রিপোর্টে অস্ট্রেলিয়ায় মোট বাংলাভাষীর সংখ্যা ছিল ৩৫,৬৪৬ জন। আর ২০১৬ সালের সেনসাসে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৫৪,৫৬৭ এ পৌঁছে।

২০১৬ সালের সেনসাস অনুসারে, ৬১.৭ শতাংশ বাংলাভাষী খুব ভাল ইংরেজি জানেন (ভেরি ওয়েল)। আর, ১.৪ শতাংশ বাংলাভাষী ইংরেজি একেবারেই জানেন না।

২০১৬ সালের সেনসাস অনুসারে, শতকরা ৯৮.৯ ভাগ বাংলাভাষীর বাবা-মা অস্ট্রেলিয়ার বাইরে জন্মগ্রহণ করেছেন।

অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম-নেওয়া বাংলাভাষীর সংখ্যা ১৭.৩ শতাংশ। আর, বাংলাদেশে জন্ম-নেওয়া বাংলাভাষীর সংখ্যা ৬৯.৯ শতাংশ।

শতকরা ৬৩.২ ভাগ বাংলাভাষী অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। আর, অস্ট্রেলিয়ান নাগরিক নন এ রকম বাংলাভাষীর সংখ্যা ৩৫.৩ শতাংশ।

অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী বাংলাভাষীদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫.৯ শতাংশ বসবাস করেন সিডনির লাকেম্বায়।

এই সাবার্বের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১৮.৭ ভাগই বাংলাভাষী (৩,১৮২ জন)।

২০১১ সালের সেনসাসেও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাসের দিক দিয়ে লাকেম্বা শীর্ষ স্থানে ছিল।

তখন লাকেম্বায় ২,৪৮৩ জন বাংলাভাষী বাস করতেন, যা সেই সাবার্বের মোট জনসংখ্যার ৬.২ শতাংশ ছিল এবং অস্ট্রেলিয়ার মোট বাংলাভাষীর ৭ শতাংশ ছিল।

আর, ২০১৬ সালের সেনসাস অনুসারে, সিডনির ওয়ালী পার্কে বসবাস করেন ৩.২ শতাংশ বাংলাভাষী।

এই সাবার্বের মোট জনসংখ্যার ৪.৩ শতাংশ বাংলাভাষী (১,৭৪৫ জন)।

২০১১ সালের সেনসাসেও বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর বসবাসের দিক দিয়ে ওয়ালী পার্ক দ্বিতীয় স্থানে ছিল।

তখন ওয়ালী পার্কে ১,১৩০ জন বাংলাভাষী বাস করতেন, যা সেই সাবার্বের মোট জনসংখ্যার ২.৮ শতাংশ ছিল এবং অস্ট্রেলিয়ার মোট বাংলাভাষীর ৩.২ শতাংশ ছিল।
Source: SBS Bangla

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com