সৌদি আরবের মরু এলাকায় মানুষের বসতি শুরু হয়েছিল ১৫ থেকে ২০ হাজার বছর আগে থেকে, বরফ যুগ শেষ হওয়ার পরে। ইসলাম ধর্ম প্রচারের পর সেটি খিলাফতের প্রধান কেন্দ্র হয়েছিল।
কিন্তু খুব বেশিদিন সেটি স্থায়ী হয়নি। সিরিয়া বা ইরাক বা তুরস্ক থেকে সৌদি আরবকে শাসন করা হয়েছে।
বহু বছর পর তিন দফা চেষ্টার পর স্বাধীন একটি রাষ্ট্র হিসাবে তৈরি হয়েছিল আজকের সৌদি আরব।
এই এলাকাটি ছিল আলাদা আলাদা বেদুইন গোত্রের বিচরণ ক্ষেত্র। এসব গোষ্ঠী অনেকটা স্বাধীনভাবেই নিজেদের পরিচালনা করতো।
‘আ ব্রিফ হিস্টরি অব সৌদি অ্যারাবিয়া’ গ্রন্থে জেমস ওয়েনব্রান্ট লিখেছেন, খ্রিষ্টপূর্ব ৩২০০ শতকের দিকে বর্তমান বাহরাইন এবং আশপাশের উপকূলীয় এলাকায় দিলমুন নামের একটি সভ্যতা তৈরি হয়েছিল।
তাদের সাথে তখনকার আরেক শহর মেগান (বর্তমান ওমান), ব্যাবিলন এবং হিন্দুস নদী উপত্যকায় মেসোপটেমিয়ার মতো শহরের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্য হতো। মুক্তার জন্য দিলমুনের খ্যাতি ছিল প্রাচীন দুনিয়ায়।
ইয়েমেন তখন পরিচিত ছিল সাবা বা শেবা নামে। আর জর্ডানের নাম ছিল নাবাতায়েন নামে।
তবে আরব উপত্যকার লোকজন নিজেদের সবসময় জাজিরাতে আল-আরব বা আরবদের দ্বীপ বলে বর্ণনা করতেন।
কেন ‘আরব’ বলে তারা নিজেদের সম্বোধন করতেন, এর কারণ জানা যায় না। যদিও এদের বেশিরভাগ ছিলেন মরুভূমির যাযাবর। তাদের বলা হতো বেদুইন।
এই বেদুইনরা ইসলামপূর্ব সমাজে নানা গোষ্ঠী বা জাতিতে বিভক্ত ছিল। নিজেদের শাসন ও বিচার-আচার তারা নিজেরাই করতো।
খিষ্ট্রপূর্ব সময় থেকে শুরু করে দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সময়ে এসব বেশিরভাগ গোত্র রোমের শাসনে ছিল বলে উল্লেখ করেছেন জেমস ওয়েনব্রান্ট। যদিও পরবর্তীতে তারা আর সেই কর্তৃত্ব মেনে চলতে রাজি হয়নি।
তৃতীয় শতকের দিকে বেদুইনরা সংঘবদ্ধ হয়ে বড় ধরনের একটি আদিবাসী কনফেডারেশন তৈরি করে যা তাদের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
পাঁচশো শতকের দিকে তারা সিরিয়া, ফিলিস্তিন আর জেরুসালেমেও হামলা চালায়।
ইসলাম ধর্ম প্রচারের পর ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে মক্কা মুসলমানদের দখলে আসে। সেই সময় মদিনা থেকেই ইসলাম ধর্ম প্রচার এবং বিভিন্ন এলাকা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে।
ইসলামের নবী মুহাম্মদ যখন মারা যান, তখন প্রায় পুরো আরব এলাকা মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
ততদিনে আরবের বেদুইন গোত্রগুলো ইসলামের এক ছাতার তলে চলে এসেছে। নিজেদের মধ্যে মারামারি বাদ দিয়ে, বরং তারা একের পর এক অভিযানের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম ছড়িয়ে দেয়ার ব্রত নিয়েছে।
পরবর্তী একশো বছরের মধ্যে স্পেন থেকে ভারতসহ নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ইসলাম।
কিন্তু সেই সঙ্গে ইসলামিক সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু বা রাজধানী আরব এলাকা থেকে সরে গিয়ে প্রথমে দামেস্ক, পরবর্তীতে বাগদাদে চলে যায়।
সেই সময় আরব উপদ্বীপটি হিজাজ এবং নজদ- এই দুই অংশে বিভক্ত ছিল বলা যেতে পারে।
পশ্চিম উপকূল ধরে যে এলাকাটি ছিল সেটা ছিল হিজাজ, যার মধ্যে মক্কা, মদিনা, জেদ্দা ইত্যাদি শহর রয়েছে। বিভিন্ন সময় উমায়িদ, আব্বাসিদ, মিশরীয় এবং পরবর্তীতে অটোমানরা এখানে শাসন বিস্তার করেছে।
কিন্তু মরুভূমি ও পাহাড়সহ অন্য অংশটি নজদ নামে পরিচিত ছিল, সেখানে ছিল যাযাবর এবং যুদ্ধপ্রিয় বেদুইনদের চলাচল।
এখানে রয়েছে রিয়াদের মতো শহর, আর সে এলাকা কখনোই কোন বিদেশি শক্তির শাসন বা অধীনে আসেনি। তারা বরাবরই নিজেদের স্বাধীন মনে করে আসছে।
উসমানি শাসক সুলতান প্রথম সেলিম ১৫৫৭ সালে সিরিয়া এবং মিশরের ক্ষমতায় থাকা মামলুকদের পরাজিত করার পর হিজাজের নিয়ন্ত্রণ পায় তুর্কিরা।
ইসলামের নতুন খেলাফতে পরিণত হয় কনস্টান্টিনোপল। মক্কার রক্ষক হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেন সুলতান সেলিম।
পরবর্তীতে লোহিত সাগর ধরে আরও আরব এলাকায় তুর্কি সাম্রাজ্য বিস্তার করেন সুলতান সুলাইমান। তা সত্ত্বেও সেই সময়ে আরব এলাকার বড় একটি এলাকা স্বাধীন হিসাবেই থেকে যায়।
সৌদি আরবে প্রথম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন মুহাম্মদ বিন সউদ ১৭৪৪ সালে। সেই সময় আরবের ধর্মীয় নেতা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের সহায়তায় রিয়াদের কাছাকাছি দিরিয়া নামের একটি এলাকায় বসবাসকারী গোষ্ঠীর প্রধান ছিলেন তিনি।
উসমানি রাজত্ব থেকে আলাদা হয়ে দিরিয়া আমিরাত নামের একটি রাজত্ব তৈরি করেছিলেন, যা ছিল ইতিহাসের প্রথম সৌদি রাষ্ট্র। যদিও সেই রাষ্ট্র ছিল অনেকটা নগর রাষ্ট্রের মতো।
‘আ ব্রিফ হিস্টরি অব সৌদি অ্যারাবিয়া’ গ্রন্থে জেমস ওয়েনব্রান্ট লিখেছেন, মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাবের দরকার ছিল, তার মতবাদ প্রচারের জন্য সামরিক সমর্থন। আর মুহাম্মদ বিন সউদের দরকার ছিল তার স্বাধীন আরব রাষ্ট্র গঠনের জন্য ধর্মীয় সমর্থন।
তারা দুজন মিলে নজদকে একতাবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন।
মুহাম্মদ ইবনে সউদের উত্তরাধিকারী আবদুল আল-আজিজ পরবর্তীতে অটোমানদের পরাজিত করে ইরাকের কারবালাসহ কিছু অংশ দখল করে নেন।
সেই সময় বিবাহসূত্রে নজদ এবং হেজাজের মধ্যে ঐক্য তৈরি করা হয়।
এরপর ১৮০৩ সালে গুপ্তঘাতকের হামলায় তিনি নিহত হলে তার ছেলে সউদ বিন আবদুল আজিজ মক্কা এবং মদিনাও দখল করে নিয়েছিলেন। কিন্তু তুর্কিদের অব্যাহত হামলায় পরবর্তীতে সে রাষ্ট্র আর টিকে থাকতে পারেনি।
পরে ১৮১৮ সালে দিরিয়া আবার তুর্কিদের দখলে চলে যায়। সাত মাসের অবরোধ শেষে মিশরীয় সামরিক কমান্ডার ইব্রাহিম পাশার কাছে আত্মসমর্পণ করেন আবদুল্লাহ ইবনে সউদ।
যাকে পরবর্তীতে কনস্টান্টিনোপলে শিরশ্ছেদ করা হয়।
পরের দফা সৌদি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন তুর্কি ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে সউদ। তিনি ছিলেন দিরিয়া আমিরাতের শেষ শাসক আবদুল্লাহর একজন কাজিন বা জ্ঞাতিভাই।
যখন প্রথম রাষ্ট্রের পতন হয়, তখন তিনি মরু অঞ্চলে পালিয়ে গিয়ে আল সউদ পরিবারের আরও অনেক সদস্যের সঙ্গে একটি গোত্রে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
‘আ ব্রিফ হিস্টরি অব সৌদি অ্যারাবিয়া’ বইয়ে মাদাবি আল রাশেদ লিখেছেন, ১৮২৩ সালে তুর্কি এবং মিশরীয়দের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ শুরু করেন এবং আবার রিয়াদ ও দিরিয়া দখল করে নেন।
রিয়াদকে রাজধানী করে নজদ আমিরাত নামে দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্র ঘোষণা করেন।
কিন্তু বেশিদিন তিনিও টিকে থাকতে পারেননি। তার একজন জ্ঞাতি ভাইয়ের হাতে ১৮৩৪ সালে তিনি নিহত হন। এরপর ১৮৯১ সালে দ্বিতীয় সৌদি রাষ্ট্রেরও পতন ঘটে।
তখনকার শেষ সৌদি শাসক আব্দুল রহমান বিন ফয়সাল তার ছেলে আবদুল আজিজকে নিয়ে মুররা নামের একটি বেদুইন গোত্রে আশ্রয় নেন, বলে লিখেছেন মাদাবি আল রাশেদ।
আবদুল আজিজ বিন আব্দুল রহমান বিন ফয়সাল আল সউদ, যিনি ইবনে সউদ নামেই বেশি পরিচিত, তিনি ১৯০২ সালে রিয়াদ দখলের পর তৃতীয় দফার সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন যদিও তখনো সেটি আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পায়নি।
ইতিহাসবিদ জেমস ওয়েনব্রান্ট লিখেছেন, যখন ইবনে সউদ রিয়াদ দখলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিলেন, তখন তার সঙ্গে ছিল মাত্র ৪০ জনের একটি দল।
কিন্তু রিয়াদে যাবার পথে অনেক বেদুইন গোষ্ঠী তার সঙ্গে যোগ দেয়।
তখনো মক্কা, মদিনাসহ সৌদি আরবের বেশিরভাগ এলাকা অটোমানদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।
সেই সময় হেজাজ এলাকা ছিল শরিফ হুসেইন নামের একজন শাসকের নিয়ন্ত্রণে, আর নজদ ছিল ইবনে সউদের দখলে। কিন্তু নজদে রাশিদিদের বিরুদ্ধে তাকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হচ্ছিল।
সে সময় ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স, রাশিয়াসহ একাধিক বিদেশি শক্তি ওই এলাকায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর শরিফ হুসেইন ব্রিটিশদের সঙ্গে যোগ দেন। অটোমানদের বিরুদ্ধে সে সময় লড়াইয়ে আরবদের সহায়তা করে ব্রিটিশ বাহিনী। তারা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহও করতে শুরু করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানরা পরাজিত হলে সৌদি আরবের নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। তবে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর একটি গোপন যুক্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন এলাকা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল ব্রিটেন এবং ফ্রান্স।
সে সময় আরব এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শরিফ হুসেইন এবং ইবনে সউদের মধ্যে যুদ্ধ দেখা দেয়।
‘আ হিস্টোরি অব সৌদি অ্যারাবিয়া’ বইয়ে মাদাবি আল রাশেদ লিখছেন, প্রথমে রাশিদিদের পরাজিত করে পুরো নজদের দখল নিয়ে নেন ইবনে সউদ।
এরপর হজ যাত্রীদের ওপর হামলার অভিযোগ তুলে ১৯২৪ সালে হেজাজে সামরিক অভিযান শুরু করেন ইবনে সউদ।
ততদিনে শরিফ হুসেইনের সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ সহায়তা না পেয়ে আকাবায় পালিয়ে যান শরিফ হুসেইন। ফলে পুরো হেজাজ এবং নজদের নিয়ন্ত্রণ আসে ইবনে সউদের হাতে।
মক্কা মদিনা ও জেদ্দার নিয়ন্ত্রণ পাওয়ার পর ১৯২৬ সালে আবদুল আজিজ বিন সউদ নিজেকে হেজাজের বাদশাহ বলে ঘোষণা করেন। তার আগে থেকেই তিনি ছিলেন নজদের সুলতান।
পরের বছরের জানুয়ারিতেই তিনি নজদ এবং হেজাজ মিলিয়ে ‘কিংডম অব নজদ অ্যান্ড হেজাজ’ ঘোষণা করেন। ব্রিটিশদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে স্বীকৃতিও আদায় করেন।
যদিও সেসময় তিনি নিজের পদবি ইমাম হিসাবেই বলতেন। যদিও দাপ্তরিক সব কাজকর্মে তাকে বাদশাহ হিসাবেই বর্ণনা করা হতো।
এরপর তিনি আরবদের চিরাচরিত জীবনযাপনের ধরনেও পরিবর্তন আনার নির্দেশ দেন।
বেদুইনের একে অপরের সঙ্গে লড়াই, হামলা এবং লুটপাট নিষিদ্ধ করে দেন ইবনে সউদ।
এরপর ১৯৩২ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর একটি বাদশাহি ডিক্রি জারি করে হেজাজ এবং সউদকে এক দেশ হিসাবে ঘোষণা করেন ইবনে সউদ।
আর ২৩শে সেপ্টেম্বর তিনি রাজকীয় আদেশ জারি করেন যে, এখন থেকে আরব অঞ্চল ‘আল মামলাকাতুল অ্যারাবিয়া আস-সাউদিয়া’ বা রাজকীয় সৌদি আরব নামে পরিচিত হবে।
তবে তখনো সৌদি আরবের বেশিরভাগ বাসিন্দা বেদুইন জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। তাদের আর্থিক সঙ্গতিও খুব ভালো ছিল না।
কিন্তু তেলের সন্ধান পাওয়ার পর থেকেই ওই অঞ্চলের সে চিত্র বদলে যায়। ১৯২২ সাল থেকেই সৌদি আরবে তেলের অনুসন্ধান শুরু হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন নাগরিক চার্লস ক্রেনের সহায়তায় কার্ল এস উইটশেল ১৯৩২ সালে সৌদি আরবে এসে তেলের সন্ধানে একটি জরিপ শুরু করেন।
এরপর ১৯৩৫ সাল থেকে ড্রিলিং শুরু হয় আর ১৯৩৮ সালে প্রথম তেলের উৎপাদন শুরু হয়।
এরপর থেকেই পুরো সৌদি আরবের চেহারা বদলে যেতে শুরু করে।
বিবিসি বাংলা