বিশ্বের সবচেয়ে ছোট মুসলিম দেশ মালদ্বীপ। দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপপুঞ্জটি ভারত মহাসাগরের মধ্যে অবস্থিত এ দেশটি। ১১৯২টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত ছোট্ট এ দ্বীপদেশ। যার মধ্যে ২০০টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। মূলত এটি একটি পর্যটন প্রধান দেশ, তবে এর ইসলামিক ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
মালদ্বীপের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ (২০২৪ সালের হিসেবে)। রাজধানী মালে, যা সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ, একই সাথে দেশের প্রধান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মালদ্বীপের মোট আয়তন প্রায় ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। যদিও মালদ্বীপের ভূমি ছোট, এর আশেপাশের সমুদ্র অঞ্চল ব্যাপক। মালদ্বীপের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ তার সাদা বালির সৈকত এবং প্রবাল প্রাচীর যা বিশ্বের সেরা পর্যটন গন্তব্যগুলির মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিত।
মালদ্বীপ একটি মুসলিম দেশ। এখানে ইসলামই প্রধান ধর্ম। এই দ্বীপরাষ্ট্রে প্রায় ৪,০০০টিরও বেশি মসজিদ আছে। সবচেয়ে বড় এবং বিখ্যাত মসজিদ হলো ‘ইসলামিক সেন্টার মসজিদ’, যা মালেতে অবস্থিত। এর আরেকটি নাম ‘গ্র্যান্ড ফ্রাইডে মসজিদ’। এটি শুধু মালদ্বীপ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদগুলির মধ্যে একটি। এখানে জুমার নামাজে একসাথে ৫,০০০ জন মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারে।
মালদ্বীপে অসংখ্য মাদ্রাসা রয়েছে যেখানে শিশুদের কোরআন এবং ইসলামিক শিক্ষা দেয়া হয়। ইসলামিক সেন্টার ছাড়াও এখানে ইসলামিক শিক্ষা ও গবেষণার বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মাধ্যমে ছাত্ররা উচ্চতর ইসলামিক শিক্ষার সুযোগ পায়। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি ইসলামিক সংস্কৃতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে।
মালদ্বীপের প্রধান খাবার মাছ, বিশেষ করে টুনা মাছ, যা তাদের খাদ্য সংস্কৃতির একটি বড় অংশ। এখানে মাছের বিভিন্ন প্রকার রান্না প্রচলিত, যেমন মাছ ভাজি, মাছের তরকারি, এবং বিশেষ করে ‘গারুধিয়া’, যা একটি জনপ্রিয় টুনা স্যুপ। রুটি (রোশি) এবং ভাতও সাধারণ খাবার। মালদ্বীপে নারকেলও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান যা অনেক খাবারে ব্যবহার করা হয়। তাদের প্রিয় খাদ্যবস্তুতে মশলা ও সুগন্ধি ব্যবহার হয়, যা তাদের সাংস্কৃতিক খাদ্য ঐতিহ্যকে বহন করে।
মালদ্বীপের সাহিত্য ও সংস্কৃতি মূলত ইসলামিক ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত। মালদ্বীপের প্রাচীন গ্রন্থাবলি এবং কবিতা আরবি ভাষায় লেখা হয়েছে। দেশটির স্থানীয় ভাষা ধিবেহি হলেও আরবি ভাষার প্রচলন ইসলামিক শিক্ষার মাধ্যমে এসেছে। দেশটির সাহিত্য সংস্কৃতিতে প্রচুর পরিমাণে ধর্মীয় কবিতা, গল্প এবং প্রবাদ স্থান পেয়েছে, যা মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত।
মালদ্বীপের সংস্কৃতি বর্ণিল এবং গভীরভাবে সমুদ্রের সাথে জড়িত। এখানকার গান এবং নৃত্যে সমুদ্রের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। বোডু বেরু নামে একটি ঐতিহ্যবাহী মালদ্বীপী ড্রাম বাজানোর প্রথা আছে, যা উৎসব এবং বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রচলিত। এর সঙ্গীত এবং নৃত্য ইসলামিক নৈতিকতা মেনে চলে এবং আধ্যাত্মিক উৎসবগুলিতে বিশেষভাবে পালন করা হয়।
মালদ্বীপের সবচেয়ে বিখ্যাত বিষয় হল তার পর্যটন শিল্প। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এই ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জে আসেন তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বিশেষ করে এর প্রবাল দ্বীপ এবং মনোমুগ্ধকর সমুদ্র সৈকত পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। এছাড়াও মালদ্বীপে তৈরি প্রাকৃতিক রত্ন এবং হস্তশিল্প বিশ্ববাজারে বিখ্যাত।
ইসলামিক সেন্টার মসজিদ মালদ্বীপের রাজধানী মালে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। এটি একটি বিশাল আকারের এবং অত্যন্ত আকর্ষণীয় মসজিদ। ১৯৮৪ সালে উদ্বোধিত এই মসজিদটির সোনালি গম্বুজ এবং সাদা মার্বেলের দেয়াল দূর থেকে নজর কাড়ে। মসজিদটির অভ্যন্তরে ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বেশ কয়েকটি কারুকাজ খচিত রয়েছে। এ মসজিদটি শুধু নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয় না, বরং এটি একটি ইসলামিক গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করে।
মালদ্বীপের বর্তমান প্রধান মুফতি হচ্ছেন শেইখ মুহাম্মাদ রশিদ। তিনি দেশের ইসলামিক আইন ও ফতওয়া প্রদানের দায়িত্ব পালন করেন। শেইখ রশিদ ইসলামিক আইন, আরবি ভাষা এবং ধর্মীয় গবেষণায় বিশেষজ্ঞ। তিনি মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তার নেতৃত্বে দেশের ইসলামিক ঐতিহ্য সমুন্নত রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের সংস্কারমূলক কাজ করা হয়েছে। শেইখ রশিদ দেশের মাদ্রাসাগুলিতে ইসলামিক শিক্ষার উন্নয়ন এবং সমাজের বিভিন্ন ধর্মীয় সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।
মালদ্বীপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং ইসলামিক ঐতিহ্যের এক অনন্য মিশ্রণ। তার ক্ষুদ্র পরিসরে থাকা সত্ত্বেও এটি বিশ্বের পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য। এছাড়াও এটি মুসলিম বিশ্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দ্বীপ রাষ্ট্র।
Like this:
Like Loading...