সুন্দরবন বিশ্বের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম ম্যানগ্রোভ বন। এটি ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। সুন্দরবন বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত। এটি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রামসার সাইট হিসেবে স্বীকৃত।
জানলে অবাক হবেন, ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ম্যানগ্রোভ গাছের মূলের বিশেষ কাঠামো আছে, যা তাদের লবণাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। এই মূলগুলোকে শ্বাসমূল বলা হয়। শ্বাসমূলগুলো পানির উপরে উঠে থাকে ও বাতাসের অক্সিজেন গ্রহণ করে।
সুন্দরবনকে ম্যানগ্রোভ বন বলার কারণ হলো, এটি একটি লবণাক্ত জলাভূমিতে অবস্থিত। ম্যানগ্রোভ হলো এমন গাছ যা লবণাক্ত পরিবেশে বেঁচে থাকতে পারে। সুন্দরবনে প্রায় ১০০ প্রজাতির ম্যানগ্রোভ গাছ আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সুন্দরী, গরান, গেওয়া, কেওড়া, হিড়হুল, পশুর, ধুন্দুল, তেঁতুল, বেত ইত্যাদি।
আজ বিশ্ব ম্যানগ্রোভ দিবস। প্রতিবছর ২৬ জুলাই বিশ্বজুড়ে পালিত হয় দিবসটি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যিই যে, ১৯৮০ সাল থেকে এ পর্যন্ত বিশ্বের ম্যানগ্রোভ বনের অর্ধেকই হারিয়ে গেছে। ম্যানগ্রোভ পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
অপার প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর সুন্দরবন যারা দেখেননি তারা ছুটিতে বেড়িয়ে যেতে পারেন এই সুন্দরী ম্যানগ্রোভ বন। বিশাল আয়তনের এই বনের দু’ধারে ঘন জঙ্গল। মাঝ থেকে বয়ে চলেছে আকাবাঁকা নদী-খাল।
একদম সুন্দরবনের কোণ ঘেঁষেই নৌকা নিয়ে ছুটে চলে যেতে পারবেন। পশুর নদীতে দাড়ানো দেখবেন সারি সারি মাদার ভ্যাসেল। এখানেই বড় বড় শিপ থেকে মাল খালাস হয় ছোট্ট জাহাজে। দু’পাশেই সুন্দরবন মাঝে পশুর নদীর রুপ গিলতে গিলতে পৌঁছাবেন হারবাড়িয়া।
হারবাড়িয়া সুন্দরবনের অন্যতম একটি পর্যটন স্থান। মোংলা থেকে দূরত্ব প্রায় ২০ কিলোমিটার। এখানকার মূল আকর্ষণ বনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কাঠের ট্রেইল। পুরো ট্রেইলটা ঘুরে আসতে ৩০ মিনিটের মতো সময় লাগে। এখানে একটি পদ্মপুকুর ও ওয়াচ টাওয়ার আছে।
ওয়াচ টাওয়ার থেকে থেকে পুরো হাড়বাড়িয়া দেখা যায়। বনের ভেতরের কাঠেরপুল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় যে কারোই শিহরণ জেগে উঠবে। সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের অধীন বনবিভাগের উদ্যোগে গড়ে তোলা হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। খুলনা থেকে ৭০ কিলোমিটার ও মংলা বন্দর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে এই কেন্দ্রে অবস্থান।
একদিনের ভ্রমণে যারা সুন্দরবন দেখতে চান তাদের জন্য আদর্শ জায়গা হাড়বাড়িয়া। সুন্দরবনের হাড়বাড়িয়া টহল ফাঁড়ির পাশেই ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র। এর সামনের খালটি কুমিরের অভয়ারণ্য। প্রায়ই লোনা পানির কুমির দেখা যায় এই খালের চরে। তবে কুমির দেখার ভালো সময় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। এই সময়ে রোদ পোহাতে কুমিরগুলো খালের চরে শুয়ে থাকে।
হাড়বাড়িয়ায় সুন্দরনের বিরল মায়া হরিণেরও দেখা মেলে। এখানকার ছোট ছোট খালগুলোতে আছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছরাঙাসহ নানান জাতের পাখি। হাড়বাড়িয়ার খালে পৃথিবীর বিপন্ন মাস্ক ফিনফুট বা কালোমুখ প্যারা পাখিও দেখা যায়।
হাড়বাড়িয়ার জায়গাটিতে বাঘের আনাগোনা বেশি। প্রায়ই বাঘের পায়ের তাজা ছাপ দেখা যায় এখানে। এছাড়াও চিত্রা হরিণ ও অন্যান্য বন্য প্রাণীও দেখা মিলবে এখানে। হাড়বাড়িয়া ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্রটি বাঘের অভয়ারণ্য। তাই কাঠের তৈরি হাঁটা পথের বাইরে জঙ্গলে প্রবেশ নিষেধ। জঙ্গলে প্রবেশের আগে বন কার্যালয় থেকে অস্ত্রধারী বনরক্ষী নিয়ে নিতে হবে।
মনে রাখবেন জঙ্গলে ধূমপান একদমই নিষেধ। এছাড়া যে কোনো রকম ময়লা, উচ্ছিষ্ট, চিপস, বিস্কুট, চকোলেট ইত্যাদির প্যাকেট ভুল করেও জঙ্গলে ফেলবেন না। সুন্দরবনে ঘুরতে যাওয়ার আগে যে জিনিসগুলো ভুলে গেলে একদম চলবে না তা হলো সুন্দরবনের পানি লবণাক্ত। তাই ঘুরতে বের হওয়ার আগে অবশ্যই পানির বোতল সঙ্গে রাখুন।
বনে প্রবেশের সময় সবাই একসঙ্গে থাকুন ও গাইডের কথা মেনে চলুন। ভ্রমণ প্যাকেজের খরচ কমাতে চাইলে বিশেষ ছুটির দিনে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা বাদ দিন। কিছু স্থানে টেলিটক নেটওয়ার্ক ছাড়া সব জায়গাতেই মোবাইল নেটওয়ার্কের সমস্যা দেখা দেয়। আর শীতে ভ্রমণ করতে গেলে অবশ্যই শীতের পোশাক সঙ্গে নিন।
পশুর নদী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের খুলনা ও বাগেরহাট জেলার একটি নদী। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৪২ কিলোমিটার, প্রস্থ ২৬০ থেকে ২.৫ কিলোমিটার। এই নদী মূলত জোয়ার ভাটার পানি বহন করে। এটি সুন্দরবন এর কাছে শিবসা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এটি বঙ্গোপসাগরের কাছে কুঙ্গা নদী নামে পরিচিত। বাংলাদেশে গভীরতম নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য এটি।
এই পশুর নদী পার হয়েই অপর প্রান্তের করমজল আমাদের পরবর্তী গন্তব্য। এ যাত্রায় বনের পাশ দিয়ে ছুটতে ছুটতে যদি খেয়াল করেন তবে দেখা পাবেন হরিণ, বানর, কুমিরসহ নানান বন্য প্রাণী ও পাখীর। প্রায় ২ ঘণ্টার পথ হারবাড়িয়া থেকে করমজল।
মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে সামান্য দূরে পশুর নদীর তীরে ৩০ হেক্টর জমির ওপর বন বিভাগের আকর্ষণীয় এক পর্যটনস্থল করমজল যা সুন্দরবনে অবস্থিত। করমজলকে বন বিভাগ সুন্দরবনের মডেল হিসেবে গড়ে তুলেছে। প্রতিদিন শত শত পর্যটক এখানে আসেন।
একদিনে সুন্দরবন ভ্রমণ ও সুন্দরবন সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা নেওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান করমজল। সেখানকার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে হরিণ, কুমির, বানর, কাঠের ট্রেইল, টাওয়ার, নৌকা চালনা, জেলেদের মাছ ধরার দৃশ্য। দেশে প্রাকৃতিকভাবে কুমির প্রজননের একমাত্র কেন্দ্র এখানে অবস্থিত।
নদীপথে খুলনা থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার ও মংলা থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে এ পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। একটি ইকো ট্যুরিজম কেন্দ্র ছাড়াও এখানে আছে হরিণ ও কুমির প্রজনন ও লালন পালন কেন্দ্র। মংলা থেকে ইঞ্জিন নৌকায় চড়লে করমজলের জেটিতে পৌঁছানো যাবে এক থেকে দেড় ঘণ্টায়।
পর্যটন কেন্দ্রটির শুরুতেই বিশাল আকৃতির মানচিত্র সুন্দরবন সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেবে। মানচিত্রকে পেছনে ফেলে সামনে হেঁটে গেলেই হরিণ প্রজননকেন্দ্র। খাঁচায় ঘেরা খোলা জায়গায় দেখবেন বিচরণ করছে চিত্রা হরিণ।
নিজ হাতে খাওয়াতেও পারবেন হরিণকে। একটু সামনেই হাতের ডানে ডলফিন নিয়ে গ্যালারি। একটু হাঁটলেই পাবেন কুমির প্রজনন কেন্দ্র। সামনেই ছোট ছোট অনেকগুলো চৌবাচ্চা। কোনোটিতে ডিম ফুটে বের হওয়া কুমির ছানা, কোনোটিতে মাঝারি আকৃতির আবার কোনোটিতে আরও একটু বড় বয়সের লোনা পানির কুমিরের বাচ্চা।
একেবারে দক্ষিণ পাশের দেওয়ালঘেরা বড় পুকুরে আছে রোমিও, জুলিয়েট আর পিলপিল। জেলেদের জালে ধরা পড়া এই তিন লোনা পানির কুমিরকে ২০০২ সালে সুন্দরবনের করমজলে আনা হয়। রোমিও-জুলিয়েটের বয়স এখন ২৩। এই জুটি প্রজননক্ষম হয় ২০০৫ সালে।
বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো কৃত্রিম উপায়ে কুমির উৎপাদনে মূল অবদান তাদেরই। জুলিয়েট আকারে রোমিওর চেয়ে সামান্য ছোট। লোনা পানির এই প্রজাতির কুমির ৮০-১০০ বছর বাঁচে। জুলিয়েট এ পর্যন্ত ডিম দিয়েছে মোট ৪৮২টি। সেখান থেকে ২৮৪টি বাচ্চা ফুটিয়েছেন বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের কর্মীরা।
করমজল বন্য প্রাণী প্রজনন ও সংরক্ষণ কেন্দ্রের আরেক নারী সদস্য পিলপিল। এখন পর্যন্ত সে ডিম দিয়েছে ৪৪টি, যা থেকে বাচ্চা ফুটেছে ৩৩টি। এর পাশ দিয়েই মূলত দক্ষিণে চলে গেছে আঁকাবাঁকা কাঠের ট্রেইল।
পথের নাম মাঙ্কি ট্রেইল। এই নামের স্বার্থকতা খুঁজে পাওয়া যায় ট্রেইলে পা ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরো ট্রেইল জুড়েই দেখা মিলবে সুন্দরবনের অন্যতম বাসিন্দা রেসাস বানরের। পথের দু’ধারে ঘন জঙ্গল। এ বনে বাইন গাছের সংখ্যা বেশি। এই ট্রেইলের মাঝামাঝি জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে একটি পর্যবেক্ষণ বুরুজ।
এর চূড়ায় উঠলে করমজলের চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়। পর্যবেক্ষণ বুরুজ পেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই কাঠের পথ কিছু দূর যাওয়ার পরে হাতের ডানের শাঁখা পথ গিয়ে থেমেছে পশুর নদীর তীরে। শেষ মাথায় নদীর তীরে বেঞ্চ পাতা ছাউনি। মূল কাঠের ট্রেইল আরো প্রায় আধা কিলোমিটার এখান থেকে।
রাজধানীর সায়েদাবাদ ও গাবতলী থেকে বাগেরহাট ও মংলার বাস ছাড়ে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায়। বাসে যেতে হবে মোংলা পর্যন্ত। মোংলা বন্দর থেকে আট কিলোমিটার দূরেই করমজল। মোংলা থেকে নদী পথে করমজল যেতে হয়। সেখানে পর্যটকবাহী বাহারি রঙে সাজানো জলযান পেয়ে যাবেন। তাতে চড়েই দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঢুঁ মারুন।