রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে অভিজ্ঞ পাইলট সংকট চরমে। কিন্তু সেই সংকট পূরণ না করে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই নিয়োগেও নানা অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে পদের সংখ্যা উল্লেখ না করা, কোটা পদ্ধতি বাতিল হওয়ার পর তড়িঘড়ি করে ভাইভার জন্য চিঠি পাঠানোসহ নানা অনিয়ম ও ঘাপলা ধরা পড়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশ বিমানের একজন পাইলটের ছেলেকে নিয়োগের সুবিধা দিতেই এমন তড়িঘড়ি করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে চাচ্ছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ।
এসব বিষয়ে কথা বলতে বিমানের সবশেষ নিয়োগ পাওয়া এমডি জাহিদুর রহমান ভূঁইয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাকে পাওয়া যায়নি। খুদে বার্তা পাঠালেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। এমনকি এমডি জাহিদুর রহমান কোথায় আছেন, সেটাও বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউ।
বিমান সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ এপ্রিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। সেই বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাডেট পাইলটের যোগ্যতা হিসেবে এইচএসসি পাসসহ অন্যান্য শর্তের কথা উল্লেখ থাকলেও কতজন পাইলট নেওয়া হবে তার উল্লেখ ছিল না। পদের জায়গায় লেখা ছিল অনির্ধারিত। অথচ বিমানের অন্যান্য সময়ে পাইলট নিয়োগে পদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়। এখানে কেন উল্লেখ করা হলো না সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এ বিষয়ে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন ও প্লানিং বিভাগের পরিচালক ক্যাপ্টেন সিদ্দিকুর রহমান ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘আমরা ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাচ্ছি, নিয়োগ দিতে চাচ্ছি। দরকার তো অনেক। এখন পর্যন্ত বোর্ড থেকে ৪৮ জনের অ্যাপ্রুভাল আছে।’
পদের সংখ্যা উল্লেখ না করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘আমরা যতজন পারব ততজন নিয়োগ দেব। আমাদের পাইলট দরকার আছে।’
বিমানের এই পরিচালক ৪৮ জনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে দাবি করলেও জানা গেছে, এর বাইরে তারা আরও ৩৪ জনকে নিয়োগ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। যাকে তারা স্ট্যান্ডবাই বলছেন। আর সেটি হলে ৪৮ থেকে বেড়ে তা ৭০ থেকে ৭২ জন হবে।
স্ট্যান্ডবাই হিসেবেও যাদের নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়ার কথা শোনা যাচ্ছে তারা বেশির ভাগই বিভিন্ন পাইলটের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজন। মূলত নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অবৈধ পদ অবলম্বন করতেই পদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি বলে জানিয়েছে সূত্র।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের এক কর্মকর্তা ঢাকা মেইলকে বলেন, ‘মূলত বিমানের প্ল্যানিং ও শিডিউল অফিসার ইশতিয়াক হোসেনের ছেলেকে নিয়োগ দিতে কর্তৃপক্ষ এমন তড়িঘড়ি করছে। এছাড়া কোটা পদ্ধতি বিলুপ্ত হওয়ার কারণে বেকায়দায় পড়েছে তারা। তড়িঘড়ি করে আগামী ১৪ আগস্টের মধ্যে প্রার্থীদের পরীক্ষার বিষয়টি শেষ করতে বলা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত চিঠিও পাঠানো হয়েছে।’
সংশ্লিষ্টতা বলছেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স অভিজ্ঞ পাইলটের অভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ডলার খরচ করে বিদেশি পাইলট এনে বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। একজন পাইলটকে প্রায় ২০ হাজার ডলার বেতন এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাকে দেশে রাখতে হয়। অথচ একজন দেশি পাইলটের ক্ষেত্রে তার অর্ধেক টাকাও খরচ হয় না। স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে অভিজ্ঞ পাইলট তৈরি হয়নি। যারা হয়েছেন তারা বর্তমানে বেশির ভাগ অবসরে গেছেন। এই ঘাটতি পূরণের জন্য তেমন কোনো জোরালো উদ্যোগও নেই।
পাইলট সংকটের কারণে বিমানের সংখ্যা ও রুট বাড়ানো যাচ্ছে না। গত কয়েক বছর ধরে অভিজ্ঞ পাইলট নিয়োগের দাবি উঠলেও অজানা কারণে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগের প্রতি মনোযোগী হয়েছেন বিমানের কর্মকর্তা ব্যক্তিরা। এই প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঘাপলা রয়েছে। এ সম্পর্কে ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
অভিজ্ঞ পাইলট নিয়োগ না দিয়ে ক্যাডেট পাইলট কেন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এত তড়িঘড়ি করে- এমন প্রশ্নে বিমানের ফ্লাইট অপারেশন ও প্লানিং বিভাগের পরিচালক ক্যাপ্টেন সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ বয়স সীমা দিয়েছি ৪০ বছর। এর মাঝে অনেক অভিজ্ঞ আবেদন করবেন।’
তার দাবি, বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো থেকে যেসব পাইলট আসতে চান সেখান থেকে আসার আগে সেই প্রতিষ্ঠানকে চুক্তি মতে অনেক টাকা পয়সা দিয়ে আসতে হয়। ফলে অনেকে আসতে চান না। এ কারণে বয়স ৪০ এবং পদের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি যাদের অভিজ্ঞতা বেশি তাদের এই নিয়োগে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় পাইলটরা যে ৩০ শতাংশ কোটা পান তাদের সন্তানদের নিয়োগে সেটা বিলুপ্ত না করে স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য কেন ডাকা হলো- এমন প্রশ্নে তিনি দাবি করেন, যেহেতু কোটা বাতিল হয়েছে ফলে এ নিয়োগে কোনো কোটা থাকবে না।
এই কর্মকর্তা বলেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় কোটার তো প্রশ্নই আসে না। আর আগে কোটা থাকলেও যোগ্যদের ছাড়া কাউকে নেওয়া হয়নি।
এই নিয়োগে বিমানের প্লানিং ও শিডিউল অফিসার ইশতিয়াক হোসেনের সন্তানকে নিয়োগের জন্য তড়িঘড়ি করা হচ্ছে, বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তার উত্তর ছিল- ‘কোনো পাইলটের সন্তান যদি যোগ্য হয় তাহলে কি আমরা তাকে নেব না!’