অবহেলা আর অযতেœ প্রায় পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত লালমনিরহাট বিমানবন্দর। বন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব, উন্মোচন হবে যোগাযোগের এক নতুন দ্বার। পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের দৃশ্যপট। কবে বিমানবন্দর চালু হবে এই আশায় যুগ যুগ ধরে অপেক্ষায় ছিলেন তিন জেলার মানুষ। অবশেষে বিমানবাহিনীর প্রধান বিমানবন্দরটি পরিদর্শনের পর নতুন আশায় বুক বেঁধেছে লালমনিরহাটের মানুষ।
জানা গেছে, ১৯৩১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আমলে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ও হারাটি এলাকায় এক হাজার ১৬৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে বিমানবন্দর নির্মাণ শুরু হয়। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলযোগে বড় বড় পাথর, বোল্ডার ও অন্যান্য সামগ্রী এনে দ্রুতিগতিতে চলতে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রানওয়ে ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এ বিমানবন্দরই ছিল মিত্রবাহিনীর একমাত্র ভরসাস্থল। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন করে ব্যবহার না হওয়ায় জৌলুশ হারাতে থাকে দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বিমানবন্দর। তবে ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে বিমান সার্ভিস চালু হলেও তা বেশি দিন আলোর মুখ দেখেনি। বিমান চলাচলে লোকসান হওয়ায় তা বন্ধ করে দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত হয়।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে ৪ কিলোমিটার রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাংগার, ট্যাক্সিওয়ে এগুলো সবই এখন পরিত্যক্ত। ১৯৮৩ সালে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ এখানে কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করে। সরকারি মূল্যবান স্থাপনা জুড়ে মিলিটারি ফার্মের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার। সংরক্ষিত ভূমিতে চলছে কৃষিকাজ।
সূত্র মতে, লালমনিরহাটকে তখন বলা হতো ‘গেটওয়ে টু নর্থ-ইস্ট’ এবং ‘মাউথ অব আসাম’। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তখনকার বিশাল প্রদেশ বৃহত্তম আসামে প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল লালমনিরহাট। রেলপথে ‘লালমনিরহাট জংশন’ এবং বিমান পথে ‘লালমনিরহাট জাহাজ ঘাঁটি’। ভারত ভাগ না হলে লালমনিরহাট তার এই যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বের জন্য আপন মহিমায় হয়ে উঠত ‘দ্বিতীয় কলকাতা’। ২০১৯ সালে বিমানবাহিনীর তৎকালীন প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত লালমনিরহাট বিমানবন্দর পরিদর্শনে আসেন। ২০২১ সালে বিমানবাহিনীর প্রধান বিমানবন্দরটি পরিদর্শন করেন। এরপর বিমানবাহিনীর প্রকৌশলীদের সাথে নিয়ে পুরো বিমানবন্দর ঘুরে দেখেন এবং এর সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। এরপর সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিমানবন্দরে সভা করেন তিনি। এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটি প্রথম দিকে বিমান কারখানা হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কারখানা করার পর যাত্রী পরিবহনের জন্য চালু হবে ফ্লাইট।
অপর দিকে লালমনিরহাট বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ করা হয়েছে। দেশে এই প্রথম একটি অ্যাভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে এয়ারক্র্যাফট নির্মাণ, মেরামত, স্যাটেলাইট নির্মাণ, উৎক্ষেপণ, মহাকাশ গবেষণা প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণার মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বিমানবন্দরটি চালু হলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের সব শ্রেণীর মানুষ অনায়াসে কম খরচে বাংলাদেশে আসতে পারবেন। বাংলাদেশীরাও ভারত, নেপাল ও ভুটানে অল্প খরচে গিয়ে সব কাজ করতে পারবে। এ ছাড়াও বিমানবন্দর চালু হলে, উত্তরাঞ্চলের কোটি মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা নিতে ওই তিনটি দেশে যেতে পারবেন। ওই তিন দেশের হাজারো শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী বাংলাদেশে এসে তাদের কাজ সম্পাদন করতে পারবে। সেই সাথে লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর, কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিমানবন্দরটি ব্যবহার হলে ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘিত হবে এ ইস্যুতে এটি বন্ধ রয়েছে। একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এ সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব বলেই জেলাবাসী প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায়।
লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি শেখ আব্দুল হামিদ বাবু বলেন, বৃহত্তম এই বিমানবন্দরটি চালুর উদ্যোগ নিলে ঘুরে যাবে অর্থনীতির চাকা। বিমানবন্দর চালু হলে রংপুর অঞ্চলের অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে কয়েকটি দেশের সাথে শিক্ষা চিকিৎসার ব্যাপক প্রসার ঘটবে। বিমানবন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে। সুযোগ তৈরি হবে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে পরিচিত সাত রাজ্যসহ আশপাশের আরো কয়েকটি রাজ্য, নেপাল এবং ভুটানের সাথে বাংলাদেশের উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ তৈরির একটা অন্যতম মাধ্যম হতে পারে লালমনিরহাট বিমানবন্দর।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক মোহম্মদ উল্ল্যাহ্ বলেন, জমি অধিগ্রহণসহ এ বিমানবন্দরটি নিয়ে সরকারের বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে বিমান মেরামত ও কারখানা তৈরিসহ বিমান চলাচলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে, যা দ্রুত বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।