পারো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টকে বিবেচনা করা হয় উড়োজাহাজ ওঠানামার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে সবচেয়ে কঠিন জায়গাগুলোর একটি হিসেবে। ১৮ হাজার ফুট উচ্চতার দুটি পর্বতের মধ্যে একটি ছোট রানওয়েতে উড়োজাহাজ নামানোর জন্য প্রযুক্তিগত জ্ঞানের পাশাপাশি ইস্পাত-দৃঢ় স্নায়ু থাকাটাও জরুরি।
অসাধারণ সব প্রাকৃতিক দৃশ্যে মোহাচ্ছন্ন হওয়া পর্যটকদের ভুটান ভ্রমণে নতুন মাত্রা যোগ করে এই বিমানবন্দর এবং এখানকার চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি। হিমালয় পর্বতমালার বিস্তৃত অংশ নিয়ে গড়ে ওঠা বজ্র ড্রাগনের দেশ নামে পরিচিত ভুটানের আট লাখ মানুষের বাস।
ভুটানের রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা দ্রুক এয়ারে ২৫ বছর ধরে কাজ করা ক্যাপ্টেন চিমি দর্জি বলেন, ‘পারো, কঠিন কিন্তু বিপজ্জনক নয়। এটি পাইলটের দক্ষতা প্রমাণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় তা সত্যি, তবে এটি বিপজ্জনক নয়। কারণ, এটি বিপজ্জনক হলে আমি উড়তে পারতাম না।’
ভৌগোলিক বিভিন্ন বিষয় পারোসহ প্রায় গোটা ভুটানকে দারুণ চিত্তাকর্ষক করে তুলেছে। আর একই কারণে পারো বিমানবন্দরে অবতরণ কিংবা পারো থেকে ওঠা—দুটিই দারুণ দক্ষতার একটি কাজে পরিণত করেছে।
এসব তথ্য জানা যায় মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে।
পারো একটি সি ক্যাটাগরির বিমানবন্দর। অর্থাৎ এখান থেকে ওড়া কিংবা অবতরণের জন্য বৈমানিকের বিশেষ প্রশিক্ষণ থাকতে হবে।
বৈমানিককে অবশ্যই রাডার ছাড়াই অবতরণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। দর্জি যেমন বলেছেন, বিমানবন্দরের চারপাশের ভূপ্রকৃতি সম্পর্কে জানা পাইলটদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এক ইঞ্চির একটি ভগ্নাংশ পরিমাণ এদিক-সেদিকে আপনি কারও বাড়ির ওপরে অবতরণ করতে পারেন।
চীন এবং ভারতের মধ্যে অবস্থিত ভুটানের ৯৭ শতাংশের বেশি এলাকাজুড়েই পর্বত। রাজধানী থিম্পু সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার ৭১০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। পারোর উচ্চতা একটু কম, সেটা সাত হাজার ৩৮২ ফুট।
‘উঁচু জায়গাগুলোতে বাতাস পাতলা। কাজেই বাতাস কেটে দ্রুত উড়তে হয়। আপনার প্রকৃত গতি একই হবে, কিন্তু এ গতি স্থলের বিপরীতে অনেক দ্রুত হবে।’ ব্যাখ্যা করেন দর্জি। উড়োজাহাজ চালানোর পাশাপাশি যিনি দ্রুক এয়ারের পাইলট এবং কেবিন ক্রুদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
এই অক্টোবরে নিউ দিল্লি, ব্যাংকক, কাঠমান্ডু, ঢাকা যেখান থেকেই আপনি পারোর দিকে উড়োজাহাজে চড়তে চান আপনাকে খুব সম্ভব দ্রুত ঘুম থেকে উঠতে হবে ফ্লাইটের জন্য।
কারণ এয়ারপোর্টের কর্মকর্তারা প্রবল বাতাসের কারণে নিরাপত্তা নিশ্চিতে উড়োজাহাজগুলো দুপুরের আগে অবতরণ করাতেই পছন্দ করেন। উড্ডয়নের সময় অবশ্য বাতাসের বিষয়টি ঝামেলা তৈরি করে না। তাই ভুটান ভ্রমণর শেষ রাতটিতে চমৎকার একটি ঘুম দিয়ে দুপুরের পরের ফ্লাইট ধরতে পারেন। আর যে মৌসুমেই হোক না কেন পারোতে রাত্রিকালীন কোনো ফ্লাইট নেই।
বর্ষা মৌসুম, যা সাধারণত জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিবেচনা করা হয়, তখন পরিস্থিতি একটু আলাদা হয়। বছরের ওই সময় বজ্রঝড় হওয়া অস্বাভাবিক নয়, সঙ্গে শিলাসহ থাকলে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়ে। কখনো কখনো গলফ বলের আকারের শিলাও পড়ে।
দর্জি জানান, পাইলটদের কীভাবে উড়তে হবে তার পাশাপাশি কখন উড়া যাবে না তা বুঝতে পারার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পারোর অসুবিধাগুলোর মধ্যে আরেকটি, দর্জি যেটাকে ‘প্রতিবন্ধকতা’ বলে উল্লেখ করেছেন, সেটি বিমানবন্দরকে ঘিরে থাকা পাহাড়ি ভূখণ্ড। পারোর রানওয়ে কেবল সাত হাজার ৪৩১ ফুট লম্বা। আর একে দুপাশ থেকে পাহারা দিচ্ছে উঁচু দুটি পর্বত। কাজেই বৈমানিকেরা রানওয়ে দেখতে পান কেবল অবতরণের আগেই।
ভুটানে অনেক কিছু পরিবর্তিত হচ্ছে। বিমান শিল্প তাদের মধ্যে একটি। ভারতীয় সীমান্তের কাছে দক্ষিণ ভুটানের গেলেফুকে একটি আদর্শ শহর হিসেবে গড়ে তোলার জায়গা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
যদিও ইতিমধ্যেই একটি ছোট বিমানবন্দর আছে গেলফুতে, এর নতুন অবস্থা এখানে একটি উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ নিয়ে আসতে পারে। গেলফু এবং পারোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হলো ভূখণ্ডে। গেলফু তুলনামূলক সমতল এবং দীর্ঘ রানওয়ে তৈরি করার জন্য যথেষ্ট জায়গা রয়েছে এখানে। তাই বিশেষ প্রশিক্ষণ ছাড়াও বৈমানিকেরা এখানে ওঠানামা করতে পারবেন এবং বড় আকারের উড়োজাহাজও সেখানে নামানো যাবে।
ভুটানের উড়োজাহাজ শিল্প খুব পুরোনো নয়। ১৯৮১ সালে আত্মপ্রকাশ ঘটে দ্রুক এয়ারের। ভুটানে লাইসেন্সধারী কেবল কয়েক ডজন পাইলট থাকলেও শুধু বিদেশ থেকে নিয়োগ নয়, স্থানীয়ভাবে আরও তরুণ পাইলট নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের আগ্রহ রয়েছে ভুটানের। রাষ্ট্রীয় বিমানসংস্থা দ্রুক এয়ার পাইলট প্রশিক্ষণের বেশির ভাগ দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে।
‘আমি নিজেকে.পুরোনোনো প্রজন্ম এবং নতুনদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন মনে করি।’ বলেন ৪৩ বছর বয়স্ক চিমি দর্জি। তাঁর বিশ্বাস ভুটানে এখন যে লাইসেন্সধারী ৫০ জন বৈমানিক আছেন আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সংখ্যাটি অনায়াসে দ্বিগুণ করা সম্ভব হবে।