মঙ্গলবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০২:৩২ অপরাহ্ন

বার্লিন একটা জীবন্ত স্বপ্নের নাম

  • আপডেট সময় বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩
Happy millennial friends from diverse cultures and races having fun posing in front of smartphone camera - Youth and friendship concept - Young multiracial people smiling - Main focus on center faces

দীর্ঘ সফরে ক্লান্তি থাকে, আবার কখনো থাকে তীব্র আকাঙ্খা। ক্লান্তিকে ভুলিয়ে দেয় তা। বার্লিন বোধহয় এগুলোকে ছাপিয়ে উঠে অন্য কোন কিছু। এ এক পুরোপুরি রোমাঞ্চের সফর। প্রায় বছরখানেক ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছি এই সফরটার জন্য। শহরটা যদি ফ্র্যাঙ্কফুর্ট কিংবা মিউনিখ হত আগ্রহ তাহলেও অবশ্যই থাকত, হাজার হোক দেশটা তো জার্মানি। আসলে সেই আইডিয়ার দেশে, কবি-চিন্তাবিদদের দেশের প্রতিটি প্রান্তে প্রতিটি যাত্রাই রোমাঞ্চের হতে বাধ্য। কিন্তু সেক্ষেত্রে আগ্রহ যে হত অনেক কম, সেটা পরিষ্কার বুঝি। বার্লিন তো আসলে একটা শহর শুধু নয়, বার্লিন একটা জীবন্ত স্বপ্নের নাম। এক আধুনিক রূপকথার গল্পের নাম বার্লিন। পক্ষীরাজ ঘোড়া, সোনার কাঠি, আর ঘুম ভাঙানোর গান। বার্লিন মানেই হিটলার, বার্লিন মানেই পৃথিবীর ইতিহাস নিয়ন্ত্রক একটা শক্তি। বার্লিন মানেই যুদ্ধে ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাওয়া একটা শহর, বার্লিন মানেই জোর করে দু’ভাগ করে দেওয়া একটা সত্বা। বার্লিন মানেই নিজেদের পুনরায় এক করতে পারার দার্ঢ্য। বার্লিন তাই এক ম্যাজিকেরই নাম। আর আমাদের জেনারেশনের কাছে হিটলার ইতিহাস হলেও সে বড় জীবন্ত ইতিহাস। আর দেওয়াল ভাঙা যে নিতান্তই বাস্তব, অন্ততঃ আমাদের কাছে।

ঊননব্বই-এর সেই পাঁচিল ভাঙার দিনে আমরা তো নিতান্তই সদ্য কলেজে ঢোকা তরুণ। রক্তে দোলা লাগানো এ ঘটনা আমাদেরকে যে বার্লিনের অনেক কাছাকাছি এনে দিয়েছে। চিন্তায়, মননে, হৃদয়ের স্পন্দনে। এরই ফলশ্রুতিতে দুই বাঙলার এক হবার সম্ভাবনা বা অসম্ভাবনা নিয়ে আমরা কলেজের ক্যান্টিনে কিংবা পাড়ার রকে বসে চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলেছি কত। আনন্দবাজারের পাতায় প্রকাশিত দীর্ঘ এক ভাবাবেগদীপ্ত প্রবন্ধে সে আবেগে সলতে পাকিয়েছেন সুনীল গাঙ্গুলি। আঘাতে জর্জরিত বার্লিনের সঙ্গে তাই আমাদের কোথায় যেন নাড়ীর টান। তখনো পর্যন্ত হিরোশিমা-নাগাসাকি ছাড়া আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন শহরের উপরে এতখানি ঝড় বয়ে যাবার কথা আমরা ত’ শুনিনি।

আসলে দু’বছর ধরে পরিকল্পনা করেছি বার্লিন যাবার। সফরটা এমনিতে বেশ মজারই বলতে হবে। সাতদিনের কনফারেন্স, তার মধ্যে মাত্র একদিন পনের মিনিট পেপার পড়ার, বক্তব্য রাখার কাজ। বাকী সময়টা কনফারেন্সে বসে বক্তৃতা শোনার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই ঘোরা যাবে বার্লিনের আনাচে-কানাচে। তার রাজপথ থেকে গলির গোলকধাঁধায়।

দীর্ঘ বিমানযাত্রার শেষে ফ্র্যাঙ্কফুর্ট এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম সন্ধ্যাবেলায়। ইমিগ্রেশন যে এত সহজে হয়, কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা নেই, শুধু পাসপোর্ট দেখে একটা ছাপ মেরে দেওয়া, এর আগে কোনদিন সে অভিজ্ঞতা হয়নি। জার্মানি – এক স্বপ্নের দেশ – হিটলার – বিটোফেন – আইনষ্টাইন – বেরোলাম লাগেজ ঠেলতে ঠেলতে। এই ফ্র্যাঙ্কফুর্ট থেকেই প্লেন ধরে বার্লিন যাব, কাল খুব সকালে। রাতেই বোর্ডিং পাস নিয়ে, লাগেজ চেক-ইন করে, সিকিউরিটি অতিক্রম করে ঢুকে গেলাম ভিতরে। নিশ্চিন্তে। রাতটা গড়িয়ে নেবার পক্ষে জায়গাটা চমৎকার না হলেও নিরাপদ তো বটেই। প্রায় শ’খানেক ইউরোর হোটেল খরচ বাঁচল। চেয়ারগুলোর বিন্যাস এমনই যে খানতিনেক চেয়ার নিয়ে যে টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ব তার অবশ্য কোন উপায় নেই। ওরই মধ্যে কষ্টে-সৃষ্টে দু’টো করে চেয়ার নিয়ে আধেক ঘুমে রাত্তির কাটল।

পরদিন সকালে বার্লিনের প্লেনে বসে একটা অতি প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিলাম, পার্শ্ববর্তী জার্মান যাত্রীর কাছ থেকে ‘নো বিফ, নো পোর্ক, নো হ্যাম’-এর জার্মান অনুবাদ করিয়ে নিলাম। পরবর্তী সাতদিনের জন্য এটা হবে আমার এক অবশ্য প্রয়োজনীয় কাগজ, খেতে গিয়ে দু’বেলা যা প্রয়োজন হতে পারে দোকানে এবং রেষ্টুরেন্টে। অবশ্য পরে বুঝেছি টুরিষ্টনন্দিত প্রধান শহরগুলোর মতই প্রয়োজনটা এখানেও অতটা সাঙ্ঘাতিক নয়। যদিও কখনো সখনো যে কাগজটা লাগেনি তাও নয়।

বার্লিন। এ এক দেওয়ালের গল্প। নাকি গল্পটা দেওয়াল ভাঙার। দেখলাম বেশ। শহরটার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছিল সেই দেওয়াল। গুঁড়িয়ে দিয়েছে জার্মানরা। প্রমাণ করেছে যে একটা দেওয়াল কখনো দু’ভাগ করতে পারে না এক অভিন্ন সত্বাকে। যেখান দিয়ে দেওয়াল গিয়েছিল, সে পথ জুড়ে দাগ দেওয়া আছে গোটা শহরের রাস্তায়। জার্মানরা ভুলতে চায় না দেওয়াল ভাঙার সে মহোত্তম ইতিহাস। আর এক জায়গায় রাখা আছে খানিকটা দেওয়ালের অংশ। অবিকৃত ভাবে। স্মৃতি আর পর্যটনকে উসকানি দেবার জন্যই। এ আবেগের অংশীদার হতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছি আবেগের ঢেউয়ে। দেওয়ালের পাশেই রয়েছে নাৎসী জার্মানি আর কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ছবি নিয়ে এক প্রদর্শনী। গায়ে কাঁটা দেবার মতই। হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম এই আমরা ছিলাম সাবেক পূর্ব জার্মানিতে, এই পশ্চিমে, পরক্ষণেই আবার পূবে। এই সেই চেক পয়েন্ট চার্লি, আমেরিকান সৈন্য ঘাঁটি, এ সবই তো এই সেদিনকার ইতিহাস।

জার্মানরা কি একটু রুক্ষ প্রকৃতির হয়? জার্মান ভাষায় শব্দগুলো দেখি বেশ বড় বড়। এত বড় বড় শব্দ জন্ম থেকে উচ্চারণ করতে করতে একটু কাটখোট্টা আর রুক্ষ না হওয়াটাই বোধহয় আশ্চর্যের।

বাঙালি তো রয়েছে সর্বত্রই। বার্লিনেও স্থানীয় বাঙালির দেখা মিলেছে বার কয়েক। বার্লিন ইউনিভার্সিটির কাছে, পনেরই আগষ্ট ভারতীয় দূতাবাসে পতাকা উত্তোলন দেখে ফেরা সেই দুই স্থানীয় বাঙালি। কিংবা বাসে এক সহযাত্রী যিনি বার্লিনে দোভাষীর কাজ করছেন আমার জন্মেরও আগে থেকে। ওরা কেউই আমাদের মত কলকাতার গন্ধ গায়ে মাখা সদ্য আগত বাঙালি নয়।

দিল্লীতে যেমন ইন্ডিয়া গেট, মুম্বাইতে যেমন গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া, কলকাতার প্রতীক যেমন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, বার্লিনের তেমনই ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট। এর পিছন দিয়েই ছিল সেই দেওয়াল। গেট পড়েছিল সাবেক পূর্ব বার্লিনে। বার্লিনের গল্পে কথায় কথায় সেই দেওয়াল ঘুরে ফিরে আসবেই। আসলে এতো ‘এক যে ছিল শেয়াল, তার বাপ দিয়েছিল দেয়াল’-এর দেশ। ছবি তোলার পক্ষে বেশ ভাল। পাশেই ইউনিসেফের আয়োজনে এক রঙদার প্রদর্শণী চলছে, বাডি বিয়ার শো, শতাধিক ভাল্লুকের মডেল দিয়ে গোল করে ঘিরে রেখেছে একটা মাঠকে। এক একটা ভাল্লুক এক এক দেশের শিল্পীর দ্বারা চিত্রিত, সেই দেশের সংস্কৃতির প্রতিভূ। ভারতীয় ভাল্লুকের গায়ে বাঁশি হাতে কৃষ্ণের ছবি, শিল্পীর এক বাঙালি নাম। জায়গাটা দুর্দান্ত। এখানে আমার ছোট্ট ছেলেটাকে খুবই মিস করছি, ও দারুণ উপভোগ করত এই পরিবেশকে।

কন্টিনেন্টাল ইউরোপ তার ট্রাডিশনাল সত্বা নিয়ে উপস্থিত বার্লিনে। শহরের এখানে ওখানে ইতি উতি মার্বেলের মূর্তি, পুরনো ঘরানার স্থাপত্য।

এই সেই রাইখস্ট্যাখ। জার্মান পার্লামেন্ট। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভাবছি, খুব বেশি দিন নয়, মাত্র ষাট বছর আগে এই সিঁড়ি দিয়েই দর্পিত পদক্ষেপে উঠতেন অ্যাডলফ হিটলার। আশ্চর্যজনক ভাবেই আজ হিটলার জার্মানিতে, অন্ততঃ বার্লিনে নিরুচ্চারিত এক নাম। কিংবা হয়তো বা আশ্চর্য হবার কিছু নেই, এটাই বোধহয় স্বাভাবিক। ইতিহাস স্বভাবতঃই নির্লিপ্ত, নিরাসক্ত। নিতান্তই বিজয়ীর দাস। পরাজিত চিরকালই অপাংক্তেয়। রাইখস্ট্যাখের সামনে রয়েছে অনেকগুলি প্রস্তরখন্ড, মাটিতে প্রোথিত। একেকটার উপরে এক-একজন জার্মান চ্যান্সেলারের নাম আর তাদের কার্যকালের সাল তারিখ লেখা। দেখতে গিয়েই হোঁচট খেলাম, এগুলো রয়েছে নিতান্তই এলোমেলোভাবে, র‍্যান্ডম অর্ডারে। আমরাও এক-একটা করে সব কটা নাম দেখলাম। অবশ্যই আমরা খুঁজে ফিরছিলাম একটা বিশেষ নাম। না, নেই, এরা হিটলারকে নির্বাসন দিয়াছে। কিন্তু ইতিহাসের পাতা থেকে কি নির্বাসন দেওয়া যায়, এত সহজেই?

স্প্রা নদীতে নৌকা ভ্রমণ খারাপ লাগল না। দু-তীরে ভাসছে রূপকথার অচিনপুর, সোনার কাঠির ছোঁয়ায় জেগে থাকা শহরখানা। তবে নদীটা বিশেষ চওড়া নয়। আর এক ঘন্টার নদী ভ্রমণের দক্ষিণা যদি আট ইউরো হয়, সেটা এক বিশেষ এক্সপেন্সিভ অভিজ্ঞতা। তবে দুধারের স্বপ্নের মাঝে ভাসবার দাম হিসেবে ভাবলে বোধহয় বেশি কিছু নয়।

রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হল হিটলারের বাঙ্কার খোঁজা। প্রত্যাশিতভাবেই এরা সে ইতিহাসকে ডিসপ্লে করেনি। একটা ঘেরা জায়গায় জার্মান ভাষায় কিছু লেখা দেখে আর ম্যাপ মিলিয়ে আমরা ভাবছিলাম সেটাই হিটলারের বাঙ্কার কিনা। বিশেষত ওর মধ্যে ‘ফুয়েরার’ ধরণের একটা শব্দ ছিল। পথচারী এক জার্মান মহিলার কাছে জানলাম ওটা জার্মান ভাষায় ‘বিওয়ার অব ফায়ার’। কোন সাম্প্রতিক গাইড বুক বা ম্যাপে নেই বাঙ্কারের জায়গাটার উল্লেখ। অবশেষে পুরনো একটা ম্যাপ খুঁজে আমরা বের করলাম জায়গাটা। কাছেই রয়েছে হিটলারের অফিস বিল্ডিংটা। আমরা আসলে এক ইতিহাসকে খুঁজে ফিরছি। সে ইতিহাস হয়তো গৌরবের নয়, কিন্তু রোমাঞ্চের ত’ বটেই।

গোটা শহরে অনেক মূর্তি, অনেক স্ট্যাচু। কাইজার উইলহেলম আর কাইজার ফ্রেডরিখের স্ট্যাচু। ফ্রেডরিখ আর উইলহেলম এই দুই নাম এদের রাজাদের মধ্যে ঘুরে ফিরে এসেছে। কোন এক ভিকট্রি স্তম্ভের কাছে বিসমার্কের স্ট্যাচুও খুঁজে পাওয়া গেল। কিন্তু না, প্রত্যাশিতভাবেই হিটলার নেই এই বার্লিন শহরে।

বিশাল বার্লিন টিভি টাওয়ার, শহরের যে কোন প্রান্ত থেকেই চোখে আটকে পড়ে। না দেখতে চাইলেও দেখতে হবে। টাওয়ারের উপরে চড়ে শহরটাকে দেখবার দক্ষিণা সাত ইউরো। গাইড বুক বলছে টাওয়ারে উঠবার পজিটিভ দিক হচ্ছে সেই সময়টাতে অন্ততঃ এই কুৎসিত টাওয়ারটাকে দেখতে হবে না। সামনের মাঠে দুই ভদ্রলোকের স্ট্যাচু। এটা পূর্ব বার্লিন। ভদ্রলোক দুজনের নাম কার্ল মার্ক্স আর ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। পিছনে তামাটে রঙের যে বিরাট বাড়িটা রয়েছে সেটা নাকি সাবেক পূর্ব বার্লিনের কমিউনিষ্ট হেডকোয়ার্টার ছিল। ওটার ছবি তুলে রাখা খুবই জরুরী, কারণ খুব শীগগীরই ওটা হয়ে যাবে ইতিহাস। বাড়িটার কনস্ট্রাকশনের মধ্যে নাকি অ্যাসবেস্টস পাওয়া গেছে যেটা এনভায়রনমেন্টের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। তাই বাড়িটা শীগগীরই ভেঙে ফেলা হবে।

কিছু সুভেনির তো কিনতেই হবে। কিন্তু ইউরো খরচ করে খুব বেশি কিছু কিনতে কেউই খুব একটা আগ্রহী নয়। রাশিয়ান ধাঁচে পাঁচটা পুতুলের ছড়াছড়ি বার্লিনের রাস্তায় রাস্তায়। কারণটা সহজবোধ্য। একটা পুতুলের পেটের মধ্যে আরেকটা পুতুল। ওটাই একটা করে কিনে ফেললাম। বছরখানেক বাদে বেনারসে গিয়ে ওরকমটাই আবার কিনেছিলাম। টাকার হিসেবে এর দাম এক ইউরোর থেকেও কম। আসলে স্বপ্ন বোধহয় সবসময়েই চড়া দামে বিক্রি হয়। বার্লিনে আমার সঙ্গীরা আরো বিভিন্ন রকমের সুভেনিরের সন্ধানে অনেকটা সময় আর ইউরো খরচ করে ফেলল।

শহরের উপান্তে অলিম্পিক স্টেডিয়াম, একবার যেতেই হবে। স্টেডিয়ামের ভিতরে রেনোভেশনের কাজ হচ্ছে, তাই ভিতরে যাওয়া গেল না। পিছনের অলিম্পিক টাওয়ারে উঠে স্টেডিয়ামের ভিতরটা দেখলাম। নেহাতই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। এই সেই স্টেডিয়াম, ১৯৩৬-এর অলিম্পিকের উদ্বোধন করেছিলেন সেদিনের জার্মানির দন্ডমুন্ডের কর্তা স্বয়ং হিটলার। ওই ট্রাকে দৌড়েছিলেন জেসি ওয়েন্স। এক স্বপ্নের নায়ক। এটা তারই কীর্তিভূমি। বার্লিন অলিম্পিকে তাকে প্রথমে নাকি দৌড়াতেই দিতে চাননি হিটলার। ইতিহাসের কি নির্লিপ্তি, আজ অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তাটার নাম জেসি ওয়েন্স অ্যালি, আর হিটলারের নামে একটা গলিও খুঁজে পাওয়া যাবে না গোটা বার্লিন নগরীতে।

ইহুদীদের মন্দির, সিনাগগ, পৃথিবীর সর্বত্রই আছে, আছে কলকাতাতেও। কিন্তু বার্লিনে এসে একটা সিনাগগে ঢুকবার, দেখবার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম হতে পারে। বার্লিনের বিখ্যাত সিনাগগের ভিতরে ঢুকে দেখলাম এয়ারপোর্টের মতই সিকিউরিটি। জানা গেল মহাযুদ্ধ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এটা। প্রত্যাশিতভাবেই। গড়ে উঠেছে নতুন করে। অবশ্য এরই মধ্যে কাছাকাছি একটা পোষ্ট অফিসকে যে আমরা সিনাগগ বলে ভুল করেছিলাম সে বৃত্তান্ত যত কম বলা যায় ততই স্বস্তির।

মহাযুদ্ধে বিধ্বস্ত হয়েছে বার্লিন নগরী। বহু পুরনো বাড়ির, চার্চের গায়ে গোলাগুলির দাগ সাক্ষ্য দিচ্ছে জীবন্ত এক ইতিহাসের। যুদ্ধকে বার্লিন ভুলবে না কোনদিন। তাই বোধহয় মৃত সন্তান কোলে মায়ের স্ট্যাচু গড়ে রেখেছে শহরের প্রাণস্থলে।

কাছাকাছি পটসডামে ঘুরে এসেছি এর মধ্যে একদিন। সা সুঁসি প্যালেসটা দারুণ সুন্দর। ছবি তুলে ফেললাম একটা রিকশার। বার্লিনের শার্লটনবার্গ প্যালেসটাও আভিজাত্যে দুর্দান্ত। পার্মাগন মিউজিয়ামটা অসাধারণ। ইশতার গেটের গল্প ত’ শুনে এসেছি সেই ছেলেবেলা থেকে। কিন্তু এসব তো রয়েছে যে কোন বড় শহরেই কিছু না কিছু। বার্লিন মানে তো তার প্যালেস আর মিউজিয়াম হতে পারে না। বার্লিনের সত্বা তার জীবন্ত ইতিহাসের মধ্যেই হাতরে ফেরে। তার স্বপ্নের মধ্যে ঘুরপাক খায়।

বার্লিনের বাস, ট্রাম, ট্রেন, টিউব, পরিবহনের নেটওয়ার্ক মিলে আর এক অভিজ্ঞতা। মাটির নীচে টিউবের জাল ছড়ানো। কিন্তু এমন ভাল পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ত’ ইউরোপের অন্যান্য শহরেও আছে। লন্ডনের পাবলিক ট্রান্সপোর্টেশন দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কিন্তু বার্লিনে যেটা দেখে আমি চমৎকৃত হয়েছি তা এর এক সম্পূর্ণ অন্য দিক। বাসে-ট্রামে টিকিট কেউ দেখছে না, টিউবে ঢুকতে গেলে ম্যাগনেটিক গেট নেই, নেই কোন টিকিট পরীক্ষা। আমার এক সপ্তাহের যথেচ্ছ বার্লিন ভ্রমণে মাত্র একবারই মোবাইল চেকার দেখেছি। কন্টিনেন্টাল ইউরোপের এটা বোধহয় একটা পার্থক্যের জায়গা, অন্ততঃ তখনো পর্যন্ত।

এই সেই হামবোল্ট ইউনিভার্সিটি। ওই তো ঐ দেওয়ালে লেখা, ম্যাক্স প্লাঙ্ক এখানে বসেই নাকি রূপ দিয়েছিলেন তার কোয়ান্টাম থিয়োরির, যা জন্ম দিয়েছে বহু নোবেল লরিয়েটের। সেনসেশনাল। বার্লিন শৈলীর শহর। কলকাতার অ্যাকাডেমি-রবীন্দ্রসদনের অঙ্গনে ভিড় করা বহু তরুণের, বহু নাট্টশিল্পীর তীর্থক্ষেত্র হতে পারে এই বাড়ীটা। ওখানে এক সময় থাকতেন ব্রেখট নামে এক ভদ্রলোক।

কেবাপ নামে একটা টার্কিশ খাবার আমাদের খুব আকর্ষণ করছে। অনেকটা আমাদের কাবাবের খুব কাছাকাছি। এরই মধ্যে ‘আলাদীন’ নামের ছোট্ট খাবারের দোকানে খেতে বসে দু’গ্লাস জল চেয়ে তিন ইউরো দাম দিতে হল। আমাদের এক সিনিয়র সঙ্গীর মতে দোকানটার নাম হওয়া উচিত ছিল ‘চালিশ চোর’।

শেষ দিন। ইজিপ্সিয়ান মিউজিয়ামে ঢুকবার ইচ্ছে যে হচ্ছিল না তা নয়। ওখানেই রয়েছে রাণী নেফারতিতির মাথা। অরিজিনাল। কিন্তু না। বাদ দিলাম এটা। অন্য এক আকর্ষণে। শহরটাকে আর একটু বুঝতে হবে। বুঝতে হবে সাবেক পূর্ব-পশ্চিমের পার্থক্য। অবশ্যই এ পার্থক্য গত দশ-বারো বছরে ঘুচেছে অনেকটাই। কিন্তু আজ যাওবা আছে, দশ বছর বাদে তাও তো হারিয়ে যাবে। এরই মধ্যে একদিন ট্রামে করে পূর্ব বার্লিনের ভিতরে ঘুরে এসেছি খানিকটা। এ ট্রাম অনেকটাই অন্যরকম আমাদের কলকাতার থেকে, এ অনেক বড়, দ্রুতগতির। ট্রাম ছিল কেবল পূর্ব বার্লিনেই। আজ শেষ দিন, কেবলমাত্র বাসে করে বার্লিন ঘোরা। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে একবার পূবের গভীরে, একবার কেন্দ্র থেকে পশ্চিমের দূরতর পারে, আর একবার উত্তরে। শহরটাকে, তার বাড়ি-ঘর, গাছ-পালা, দোকান-পশার, এক কথায় তার সমৃদ্ধির ডিস্ট্রিবিউশনের ছবিটাকে ধরে নিয়ে এলাম মনের গভীরে।

পরদিন সকালেই বিদায় বার্লিন। না, বাড়ি নয়। বাড়ি যাবার পথে সুন্দরী ব্যাঙ্কক নগরী আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে তার দুর্দান্ত রূপ-সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে।

ইতিমধ্যে সূর্যকে অন্ততঃ দশবার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী। সম্প্রতি গিয়েছিলাম পোল্যান্ডের এক ছোট্ট শহরে, জার্মান সীমারেখা থেকে ৪০/৪৫ কিলোমিটার ভিতরে। ফেরার পথে বার্লিন পর্যন্ত এলাম ট্রেনে, বার্লিন স্টেশন থেকে বাসে করে বার্লিন এয়ারপোর্ট, আধ ঘন্টার পথ। বাসে বসে বাইরেটা দেখতে দেখতে এক আশ্চর্য অনুভব। কি আশ্চর্য, বার্লিন সম্পর্কে সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতিটা আর উপলব্ধি করছি না তো। এখানে একদিন থাকবার পরিকল্পনা করলেই তো বেশ দেখা যেত এই দশ বছরে পূব-পশ্চিমের বিভেদ আরও কতটা ঘুচল। খুবই সহজ ছিল সেটা। কই, তার তাগিদ তো অনুভব করিনি একবারও, না আসার আগে, না এখন। এক দশক আগে চষে ফেলেছিলাম এই শহরটাকে, এক সপ্তাহের মধ্যে। ইতিমধ্যে বার্লিনের ম্যাজিক হয়ত’ ফিকে হয়েছে অনেকটাই। বার্লিন ক্রমশঃ আর পাঁচটা জার্মান বা ইউরোপীয় শহরের মতই হয়ে উঠেছে একথাও হয়তো ঠিক। কিন্তু দশ বছরে আমার মন কি বুড়িয়েছে আরও অনেক অনেক বেশি?

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com