মাটির বাড়িকে বলা হয় গরিবের এসি ঘর। অভাব বা সামর্থ্যহীনতা থেকে নয়, বরং গর্বের সঙ্গেই বাংলাদেশে একসময় প্রচুর ব্যবহার হতো মাটির ঘর। এই ঘরে থাকার বিষয়টি ছিল স্বাচ্ছন্দের। মাটির ঘর শীত ও গরম মৌসুমে আরামদায়ক। এ কারণে দরিদ্র মানুষের পাশাপাশি বিত্তবানরাও একসময় মাটির দ্বিতল বাড়ি তৈরি করতেন।
প্রতিটি বাড়ি মাটির। গত পাঁচ থেকে ছয় দশক আগেও বাংলাদেশ নানা অঞ্চলে এ দৃশ্য দেখা যেত।
ইট, বালি ও সিমেন্টের আধুনিকতায় মাটির ঘর এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে নিজেদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতেই মাটির ঘর-বাড়িকে আজও ভালোবাসে অনেকেই। এমন কিছু প্রমাণও আছে। সিরাজগঞ্জ জেলার দেশিগ্রাম এলাকায় ৫০টি পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে পাকা বাড়ি তৈরি করে দেয়ার কথা বলা হয়েছিল। টিনের ছাদ দেওয়া পাকা বাড়ি মঞ্জুর করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তখন একসঙ্গে আপত্তি জানালেন গ্রামের সবাই। কারণ তারা থাকতে চাইলেন মাটির ঘরেই।
বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার নিমাইদীঘি গ্রামে রয়েছে ৪৩ বছর আগে বানানো সাত কক্ষের তিনতলা একটি মাটির বাড়ি। আজও টিকে আছে বাড়িটি। এমন আরেকটি গল্প আছে নওগাঁর মহাদেবপুরের আলিপুর গ্রামে। ১৯৮৬ সালে এখানে মাটি দিয়ে তৈরি করা হয় ১০৮ কক্ষের একটি বাড়ি। এর ৯৬টি কক্ষ বড়, ১২টি ছোট কক্ষ। বাড়িটি তিন বিঘা জমির উপর নির্মিত। যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩০০ ফিট, প্রস্থ ১০০ ফিট। এ ছাড়াও ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের টাঙ্গাব ইউনিয়নের ১৩ গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে এখনও চোখে পড়ে গরম ও শীতে বসবাস উপযোগী সারি সারি হাজারো মাটির ঘর।
গরম ও শীতে বসবাস উপযোগী মাটির ঘর।
গ্রামবাসীদের দাবি, মাটির বাড়িতে বাস করার যে আরাম, তা পাকা বাড়িতে পাওয়া যায় না। গ্রীষ্মের তাপে যখন সব জায়গায় মানুষের নাভিঃশ্বাস ওঠে, তখন মাটির ঘরে বসবাসরত মানুষ আরামে দিন কাটায়। মাটির মধ্যে ফাঁকা দিয়ে বাতাস চলাচল করে। কখনোই খুব ঠান্ডা বা খুব গরমের মধ্যে পড়তে হয় না।
মাটির ঘর নির্মাণ কৌশলও অনন্য। মাটি, খড় ও পানি ভিজিয়ে কাদায় পরিণত করে ২০ থেকে ৩০ ইঞ্চি চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়। এ দেয়াল তৈরিতে বেশ সময় লাগে। কারণ একসঙ্গে বেশি উঁচু করে মাটির দেয়াল তৈরি করা যায় না। প্রতিবার এক থেকে দেড় ফুট উঁচু করে দেয়াল তৈরি করা হয়। কয়েকদিন পর শুকিয়ে গেলে আবার তার ওপর একই উচ্চতার দেয়াল তৈরি করা হয়। এভাবে নির্মিত হয় মাটির ঘর। স্বাভাবিকভাবে মাটির বাড়ি নির্মাণ করতে অনেক সময় লাগে।
দেশজুড়ে যারা আজও মাটির ঘরে বাস করছেন, তাদের কারোরই কি পাকা বাড়ি তৈরির মতো আর্থিক সঙ্গতি নেই? বিষয়টা একেবারেই তেমন নয়। বরং গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য আর ভালোবাসাময় টান থেকেই আজও তারা টিকিয়ে রেখেছে মাটির ঘর।
বাংলার ঐতিহ্য আর ভালোবাসাময় টান থেকেই আজও তারা টিকিয়ে রেখেছে মাটির ঘর।
বিজ্ঞান অগ্রসর হচ্ছে দ্রুত। ডিজিটাল আলোকবর্তিকা গ্রাম জনপদকেও প্রায় ছোঁয় ছোঁয়। উন্নয়নের রথে এগিয়ে চলেছে দেশ। দেশ এগিয়ে চলার এমন গতিকে স্বাগত জানায় বাঙালি। পাশাপাশি মানুষের প্রাপ্তি এবং হারানোর তালিকাও পরিবর্তন হচ্ছে সমানভাবে। আজ আর বাংলার সেই মাটির ঘরে একটু বিশ্রামের সুযোগ চাইলেও পাওয়া যায় না। পরিবর্তনশীল এই সময়ের বাস্তবতাকে স্বীকার করেও এ কথা দ্বিধাহীন বলা যায়, আমাদের ঐতিহ্যের অন্যতম নিদর্শন সবুজ শ্যামল ছায়া ঘেরা ‘মাটির ঘর’। মাটির ঘরের আবেদন এখনও এতটুকু ফুরিয়ে যায়নি। মাটির ঘর গ্রামের মানুষের কাছে এখনও যেন শান্তির নীড়।
প্রকৃতিকে তো টাকা দিয়ে কেনা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে রাখা। প্রকৃতির মধ্যে বসবাসের সেই চিরাচরিত প্রথাকেই আজও বাঁচিয়ে রেখেছে মাটির ঘর।
ডেইলি বাংলাদেশ