বাংলাদেশে পয়লা অক্টোবর থেকে অধিকাংশ বিদেশী টিভি চ্যানেল প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যাবার পর এখনো সমস্যাটির সমাধান হয়নি।
সরকার বলছে, বিদেশী চ্যানেল বাংলাদেশে দেখাতে হলে তা বিদেশী বিজ্ঞাপনমুক্তভাবে দেখাতে হবে, কিন্তু স্থানীয় কেবল টিভি পরিবেশক ও অপারেটররা বলছেন, তাদের পক্ষে এটা করা প্রায় অসম্ভব।
বিবিসি ওয়ার্ল্ড, সিএনএন ও আলজাজিরার মত আন্তর্জাতিক সংবাদ চ্যানেল, বিভিন্ন স্পোর্টস চ্যানেল, এবং স্টার জলসা বা জি-বাংলার মত ভারতীয় বিনোদন চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের টিভি দর্শকদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।
তাই ১লা অক্টোবর থেকে এগুলো সম্প্রচার হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাবার পর সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দেয়।
সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ বলছেন, ক্লিন ফিড না থাকার ফলে কেবল চ্যানেলগুলোতে বিদেশী বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে আর জনপ্রিয়তার কারণে অনেক বাংলাদেশি বিজ্ঞাপনদাতা এগুলোতে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন।
সরকার বলছে, এর ফলে স্থানীয় চ্যানেলগুলো কয়েক হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এবং এ কারণেই বাংলাদেশে বিদেশী চ্যানেলগুলোর ক্লিন ফিড পাওয়া দরকার।
পয়লা অক্টোবরের পর প্রথম কয়েকদিন বাংলাদেশে কোন বিদেশী চ্যানেলই দেখা যায়নি। তবে পরে বাংলাদেশের তথ্য মন্ত্রণালয় নতুন এক বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায় যে ক্লিন ফিড আছে এমন কিছু চ্যানেলকে বাংলাদেশে প্রদর্শনের অনুমতি দেয়া হচ্ছে।
এর ফলে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সহ বেশ কিছু চ্যানেল বাংলাদেশের দর্শকরা আবার দেখতে পাচ্ছেন।
কিন্তু স্টার জলসার মত জনপ্রিয় ভারতীয় বিনোদন চ্যানেলগুলো এখনো বাংলাদেশে দেখা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে দর্শকদের কাছ থেকে জানা যাচ্ছে যে – সরকার যেসব চ্যানেলকে ‘ক্লিন ফিড দিচ্ছে’ বলে আবার প্রদর্শনের অনুমতি দিচ্ছে – তাতে আগের মতই বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে।
তাহলে ক্লিন ফিডটা কী এবং এ নিয়ে বিভ্রান্তিই বা তৈরি হয়েছে কেন? আরো একটা প্রশ্ন: প্রকৃত ক্লিন ফিড অর্থাৎ বিজ্ঞাপনমুক্ত বিদেশী টিভি চ্যানেল কীভাবে পাওয়া সম্ভব?
চুক্তি ছাড়া ক্লিন ফিড অসম্ভব?
এ নিয়ে কথা হয় যুক্তরাজ্যে সম্প্রচার বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শক কোয়েন্টিন হাওয়ার্ডের সাথে।
তিনি ব্যাখ্যা করেন, যে কোন আন্তর্জাতিক চ্যানেল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য উপগ্রহের মাধ্যমে তাদের অনুষ্ঠানগুলো সম্প্রচার করে ।
এগুলো হতে পারে ক্লিন ফিড – অর্থাৎ তাতে বিজ্ঞাপনের জন্য অনুষ্ঠানের মাঝে মাঝে আড়াই -তিন মিনিট সময় খালি রাখা হয়, অথবা সেখানে ওই চ্যানেলের নিজস্ব প্রচারমূলক বিজ্ঞাপন ( যা বিনামূল্যে) দেয়া থাকে।
এই ফিড পেতে হলে তাদের ওই চ্যানেলের সাথে একটা পূর্ণাঙ্গ চুক্তি করতে হয় – যাতে বিজ্ঞাপন যোগ করার পর যে আয় হবে এবং যে কর দিতে হবে – এরকম সবকিছুরই উল্লেখ থাকে।
মি. হাওয়ার্ড বলছিলেন, “ধরুন বিবিসি ওয়ার্ল্ড বা সি এন এন এর মত একটি চ্যানেলের ক্লিন ফিড বাংলাদেশের পরিবেশক পেতে পারে যদি তারা মূল ব্রডকাস্টারের সাথে একটা চুক্তি করে। সেই ফিডে বিজ্ঞাপনের ব্রেকগুলোর ঠিক আগে একটা ইলেকট্রনিক ট্রিগার থাকে – যা দর্শকরা দেখতে পান না। এই সিগনাল পেলেই পরিবেশকের রিসিভার থেকে স্থানীয় বিজ্ঞাপন প্রচার হতে থাকে, ব্রেক শেষ হলেই মূল অনুষ্ঠান আবার শুরু হয়ে যায়।”
“বিবিসি ওয়ার্ল্ড বা সিএনএন যখন ভারতে দেখা যায়, বা কোন ইউরোপীয় বা আমেরিকান চ্যানেল যখন ব্রিটেনে দেখা যায় – ঠিক এভাবেই তাতে স্থানীয় বিজ্ঞাপন যোগ হয়।”
কিন্তু এ ধরনের কোন চুক্তি বিদেশী টিভি চ্যানেল এবং বাংলাদেশী পরিবেশকদের মধ্যে এখনো হয়নি। বাংলাদেশের পরিবেশক ও কেবল টিভি অপারেটররা মনে করে এভাবে ক্লিন ফিড নেয়া তাদের জন্য অতি ব্যয়বহুল এবং প্রায় অসম্ভব।
বাংলাদেশে ডিজিটাল কেবল টিভি সেবা দিয়ে থাকে জাদু ডিজিটাল এর প্রধান নির্বাহী কুণাল দেশমুখিয়া বলছিলেন, ব্রডকাস্টাররা যদি বাংলাদেশের জন্য একটা ক্লিন ফিড করে দেয় তাহলে তা পাওয়া সম্ভব।
“আমরা এ নিয়ে ব্রডকাস্টারদের সাথে কথা বলেছি যে এটা কীভাবে সম্ভব। তারা বলেছে বাংলাদেশের সাবস্ক্রিপশন রেভিনিউ এত কম যে তাদের জন্য স্যাটেলাইট, ব্যান্ডউইডথ, ফ্রিকোয়েন্সি ভাড়া নিয়ে এটা করা প্রায় অসম্ভব। স্টার বলেছে, তারা অন্য কোন উপায় এক্সপ্লোর করতে রাজি আছে, কিন্তু এটাতে সময় লাগবে।”
এ ব্যাপারে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর সাথে যোগাযোগ করেও তেমন কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে তাদের মনোভাব জানতে চ্যানেলগুলোর সাথে যারা কথা বলেছেন – তাদের একজন হলেন কলকাতায় ভারতীয় মিডিয়া বিশ্লেষক বাবজি সান্যাল।
তিনি বলছিলেন, ভারতীয় চ্যানেলগুলো বাংলাদেশকে ক্লিন ফিড দিতে কখনোই রাজি হবে না বলেই তার মনে হয়েছে।
“বিজ্ঞাপন ছাড়া ফিড দিতে কেউ রাজি নয়। কারণ টেলিকাস্টের খরচ বা অনুষ্ঠান প্রোডাকশনের যে খরচ – তা যদি না আসে অনুষ্ঠান তৈরি হবে কি করে? আমার সাথে দুটি চ্যানেলের কথা হয়েছে, তারা পরিষ্কার বলেছে, বাংলাদেশ থেকে আমাদের কোন রেভিনিউ আসে না, তাই ওখানে কেউ যদি তাদের চ্যানেল না-ও দেখে – তাহলেও তাদের কিছু আসে যায়না। কারণ তাদের ব্যবসা দাঁড়িয়ে আছে ভারতের জাতীয় ও আঞ্চলিক স্তরে দর্শকের সংখ্যার ওপর।”
কিছু ভারতীয় চ্যানেল আছে যারা বাংলাদেশের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করে, কিন্তু তার পরিমাণ এসব চ্যানেলের মোট বিজ্ঞাপনী আয়ের তুলনায় সামান্য – যে তা বন্ধ হয়ে গেলেও তাদের তেমন কোন ক্ষতি হবে না।
বাংলাদেশের কেবল অপারেটররা বলছেন, তারা কিছু ফ্রি চ্যানেল নিজেরা ডাউনলিংক করেন,আর পে-চ্যানেলগুলো পান পরিবেশকদের কাছ থেকে ।
এই ফিডে আগে থেকেই বিজ্ঞাপন যোগ করা থাকে এবং সেটিই তারা প্রচার করতে বাধ্য। এটিকে বিজ্ঞাপনমুক্ত করার কোন উপায় তাদের হাতে নেই।
কোয়েন্টিন হাওয়ার্ড বলছেন, স্যাটেলাইট টিভিতে নিজস্ব বিজ্ঞাপন যোগ করার প্রযুক্তি এখন ক্রমশঃ সস্তা হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তবু তার খরচ এখনো কম নয়। তা ছাড়া মূল ব্রডকাস্টারের সাথে চুক্তি, কারিগরী জ্ঞান, বিনিয়োগ – এগুলোর কোন বিকল্প নেই।
কুণাল দেশমুখিয়া বলছেন, তারা অন্য একটি উপায়ের কথা ভাবছেন – কিন্তু সেটিও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে।
তিনি বলছেন, “এজন্য বাংলাদেশে যে প্রায় ৫০০ কেবল অপারেটর আছে তাদের সবাইকে প্রযুক্তি পরিবর্তন করতে হবে। ব্রডকাস্টাররা তাদের বিশেষ ধরনের ডিকোডার দিতে পারে, যা কিউ টোন রিড করতে পারবে”।
মি. দেশমুখিয়া বলছেন, এর ফলে মূল সম্প্রচারে বিজ্ঞাপন শুরু হলেই তা একটা স্লেট দিয়ে তা ঢেকে দেয়া যাবে, একটা বার্তা থাকবে যে এই বিজ্ঞাপন বাংলাদেশ থেকে দেখা যাবে না। বিজ্ঞাপন শেষ হয়ে গেলেই আবার অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে।
তার কথায়, সারা বাংলাদেশের জন্য এরকম ২৫ হাজার বক্স লাগবে – যার দাম হবে ২০০ কোটি টাকার বেশি।
সমস্যা হচ্ছে – ঢাকা চট্টগ্রামের মত বড় শহরের অপারেটররা এ খরচ পোষাতে পারলেও গ্রাম বা ছোট শহরের অপারেটররা এই খরচ কুলাতে পারবে না।
তাহলে, এভাবে যদি ফিডকে বিজ্ঞাপনমুক্ত করাও যায়, তাহলেও তার খরচ অপারেটর-পরিবেশকরা কীভাবে পোষাবেন?
একটা উপায় হতে পারে এসব বিদেশী চ্যানেলে দেশী বিজ্ঞাপন প্রচার।
কিন্তু এ বিজ্ঞাপনের অর্থ লেনদেনের জন্য সেইসব বিদেশী চ্যানেলকে বাংলাদেশে কোম্পানি গঠন করতে হবে, অফিস খুলতে হবে। কারণ এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্থ ও কর সংক্রান্ত আইনের বাধ্যবাধকতা আছে।
বিদেশী চ্যানেলগুলো এ ঝামেলা করতে চাইবে কিনা – তা এখনো স্পষ্ট নয়। যদি তারা তা করেও – তাহলেও অন্য আরেকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যেহেতু এসব চ্যানেল বাংলাদেশী চ্যানেলগুলোর চাইতে বেশি জনপ্রিয় – তাই বিজ্ঞাপনদাতারা যদি তাদের দিকে ছুটতে থাকেন, তাহলে দেশী চ্যানেলগুলোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
ঠিক যে সমস্যাটি এড়ানোর জন্য তথ্যমন্ত্রী ক্লিন ফিড নিশ্চিত করার কথা বলছেন, সেই সমস্যাই তখন আবার নতুন চেহারা নিয়ে দেখা দেবে।
অন্য সম্ভাবনাটি হলো, বিজ্ঞাপন প্রচার করা না গেলে পরিবেশক ও অপারেটররা কেবল টিভি গ্রাহকদের কাছ থেকে আরো বেশি অর্থ চাইতে পারেন।
সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে কেবল টিভি দেখা অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের কেবল টিভি সম্প্রচারের বর্তমান কাঠামো সম্পর্কে যারা অবহিত তারা বলেন, এসব সমস্যা মোকাবিলার জন্য ডিজিটাল টিভি সম্প্রচারের বর্তমান যে নীতিমালা রয়েছে – তাকে যুগোপযোগী করতে হবে।
কারণ ২০০৬ সালের নীতিমালা ডিজিটাল যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত নয় বলে তারা মনে করেন।
বিবিসি বাংলা