শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৪০ পূর্বাহ্ন

বাংলাদেশের মেলা

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৩
নববর্ষ। বাঙালি জাতীয়তাবাদের অন্যতম বিশেষ এই দিনটিতে মানুষকে আজ ঘরবন্দি থাকতে হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে চলমান মহামারী কেটে উঠুক বিশ্ববাসী, মানুষের মাঝে ফিরে আসুক শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা। খুব দ্রুত স্বাভাবিকতা ফিরে আসুক, আর এজন্য সবাইকে এই মুহূর্তে ঘরে থেকেই বৈশাখ উদযাপন করতে হবে। তাও কিন্ত মন্দ হবে না, ঘরে বসে আপনজনের সাথে বৈশাখ উদযাপন হোক। শুধুমাত্র যে বিষয়টা এবার পালিত হচ্ছে না তা হলো বৈশাখী মেলা। ট্রাভেল বাংলাদেশের পাঠকদের সেই আক্ষেপ দূর করতে আজ ভার্চুয়ালি ঘুরিয়ে নিয়ে আসবো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈশাখী মেলা থেকে। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে একটা বিষয় আপনাকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। আর তা হলো বাংলাদেশের মেলা। এদেশে বছর বরণে মেলা হয়, উৎসব রাঙাতে মেলা হয়। মেলা হয় ঋতুর পালাবদল জানান দিতে, মেলা হয় বিভিন্ন দিবসকে স্মরণ করতে। একদিনে শেষ হওয়া মেলার অস্তিত্ব যেমন রয়েছে তেমনই আছে মাসব্যাপী চলা মেলাও। অনেকের কাছে মেলার সংজ্ঞা বর্তামানে বহুল প্রচলিত বাণিজ্য মেলায় আটকে গেলেও সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশে মেলা অঞ্চল এবং ইতিহাস ভেদে অনেক বেশি বৈচিত্র্যপূর্ণ। মেলার এতবেশি রকমফের বাংলাদেশের বাইরে আর কোথাও হয়ত আপনি খুঁজে পাবেন না।
বৈশাখী মেলা

বাংলা বছর বরণে আয়োজিত এই মেলা সার্বজনীন মেলা হিসেবেও পরিচিত। বিভিন্ন অঞ্চলে এই মেলার বিভিন্ন রকমের আয়োজন হয়। নানান স্থানীয় সংস্কৃতির চর্চা এই মেলার মহিমা প্রতিনিয়ত আরও সমৃদ্ধ করে। স্থানীয় কৃষিজাত দ্রব্য থেকে শুরু করে কুটিরশিল্প, হস্তশিল্পের প্রসার সহ বিভিন্ন সামাজিক উৎসবও রচিত হয় এই বৈশাখী মেলা ঘিরে। প্রতি বাংলা বছরের প্রথম দিন এবং ইংরেজি ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ, আর এই দিবসকে ঘিরে উদযাপিত হয় বাঙালির একান্ত নিজস্ব এই মেলা। অঞ্চলভেদে মেলার আয়ু একদিন থেকে শুরু করে সপ্তাহ কিংবা মাসব্যাপীও হয়ে থাকে।

লোক ও কারুশিল্প মেলার ইতিহাস

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের হাতে গড়া এক মেলা এটি। সোনারগাঁও লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন চত্বরে প্রতিবছর মাসব্যাপী চলে দেশের সবচেয়ে বড় কারুশিল্পের মেলা। সাধারণত এটি শুরু হয় জানুয়ারীর মাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শিল্পীরা নিজেদের তৈরি পণ্য নিয়ে হাজির হন এই মেলায়। আমাদের দেশের কুটির শিল্পের ঐতিহ্য ধারণে সোনারগাঁওয়ের এই লোক এ কারুশিল্প মেলা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখে চলেছে।

পোড়াদহ মেলা

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, পোড়াদহ মেলার বয়স প্রায় আড়াইশ বছর। ইছামতী নদীর তীরবর্তী গোলাবাড়ি এলাকায় মাস এলাকায় দুই দিন ব্যাপী এই মেলা চলে। মজার ব্যাপার হল, এই মেলাও হয় বাংলা মাসের সময় অনুযায়ী। প্রতি বছর মাঘ মাসের শেষ বুধবার আয়োজিত হয় এই মেলা। ইছামতী নদীর ধারে আয়োজিত এই মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ এতে প্রদর্শিত বিপুল প্রজাতির মাছ।

রাস মেলার ইতিহাস

১৯২৩ সাল থেকে সুন্দরবনের দুবলার চরে আয়োজিত হয় পাঁচ দিন ব্যাপী রাসমেলা। প্রতিবছর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে আয়োজন হয় এই মেলার। দেশ বিদেশের অসংখ্য পর্যটক এবং হিন্দু পূণ্যার্থীদের পদচারণায় এসময় মুখরিত থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল।

লালন মেলা

বাংলাদেশের অন্যতম বড় আকর্ষণ এই লালন মেলা। বিশেষত যারা লালন ভক্ত কিংবা সাধু অথবা লোক সাহিত্য নিয়ে আগ্রহী তাদের কাছে এই মেলার তাৎপর্য একেবারেই আলাদা। প্রতি বছর এই মেলাকে কেন্দ্র করে দেশ বিদেশের বিপুল লোক সমাগম ঘটে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেউরিয়া গ্রামে। লালনের সমাধিস্থলে বছরে দু’বার হয় এই মেলা। সাঁইজির তিরোধান উপলক্ষ্যে এবং দোলপূর্ণিমায় তার সাধুসঙ্গ উপলক্ষ্যে আয়োজিত এই মেলা বাংলাদেশের সামগ্রিক ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য এক ধারক।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা অঞ্চলের এক ঐতিহ্যবাহী মেলা এই গুড়পুকুরের মেলা। প্রায় ৩০০ বছরের পুরাতন এই  আয়োজন  প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। মূলত হিন্দু ধর্মালম্বীদের পবিত্র মনসা পূজাকে কেন্দ্র করে এটি অনুষ্ঠিত হয়। মেলার ব্যাপ্তী থাকে একমাস।

রাস লীলার মেলার ইতিহাস

সিলেট অঞ্চলের উপজাতি সম্প্রদায় মনিপুরী সংস্কৃতির এক বড় অনুষঙ্গ রাস লীলার মেলা। মৌলভীবাজার জেলার দুই উপজেলা কমলগঞ্জ আর আদমপুরে কার্তিক অগ্রহায়ণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে উদযাপিত হয় মণিপুরী সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসবের। এই উপলক্ষ্যে আয়োজন করা হয় ৩ দিনের মেলার। দুবলার চলে অনুষ্ঠিত রাস মেলার সাথে সময় ও ধর্মীয় মতভেদের মিল থাকলেও রাস লীলার মেলা মণিপুরী সংস্কৃতির কারণে অন্য মাত্রা ধারণ করে।

সোনারগাঁওয়ে আয়োজিত আরেকটি ঐতিহ্য এই বৌ মেলা। ৪০০ বছরের পুরাতন এই বটগাছ কেন্দ্র করে চলে এই মেলার আয়োজন। প্রতিবছর বৈশাখের ২য় দিন হিন্দু নারীরা তাদের সংসারের শান্তি কামনায় এই গাছকে পূজা করেন। সেই উপলক্ষ্যেই আয়োজন করা হয় পাঁচ দিনের এই মেলার।

রথের মেলা

সাধারণত আষাঢ় মাসের শেষ সপ্তাহে সনাতন ধর্মের রথযাত্রা উপলক্ষ্যে এই মেলারা আয়োজন হয়। সারাদেশেই বিভিন্নভাবে এই মেলার আয়োজন করেন স্থানীয় সনাতন ধর্মালম্বীরা। তবে দেশের সবচেয়ে বড় রথমেলা হয় সাভারের ধামরাইতে। এছাড়া রাজশাহীর পুঠিয়ার রথের মেলা এবং কুষ্টিয়ার রথখোলার নাম উল্লেখ করা যায়। এসব মেলার বাইরেও প্রতিবছর দেশের নানাপ্রান্তে নানা কারণে মেলার আয়োজন বসে থাকে। যেমন, চট্টগ্রামে বাৎসরিক বলী খেলা উপলক্ষ্যে, বা যশোরে মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মবার্ষিকী কিংবা মংলার মিঠেখালীতে কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্মদিনে মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। স্থানীয় এসব মেলা বিশেষ অঞ্চলের বা ব্যক্তির সামাজিক এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, সেই সাথে দেশের সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।

জুবায়ের আহম্মেদ

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com