বেশ অসাধারণ একটা খবর পেলাম বাংলাদেশের কানাডিয়ান দূতাবাসের ফেসবুক পেজ থেকে। দেশের বাইরে পড়ার সময় দেখতাম, প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য দেশ থেকে এক সেমিস্টারের জন্য স্কলারশিপ নিয়ে স্টুডেন্ট আসছে পড়ার জন্য। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তাঁরা ‘এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের স্টুডেন্ট’। আফসোস হতো যে বাংলাদেশের জন্য এমন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম যদি কানাডাও চালু করত।
এখন কানাডা সরকার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বছরে অনেকটা উপহারস্বরূপ যেন ‘এডুকানাডা স্টাডি ইন স্কলারশিপ’–এ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামটি চালু করল। বাংলাদেশের প্রতি তাদের এই বন্ধুসুলভ আচরণের জন্য সবার আগে কানাডা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ২০২১ সাল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশিদের এখন থেকে স্কলারশিপটি দেওয়া হবে।
স্কলারশিপটি কেমন
স্কলারশিপটি দেওয়া হয় কানাডা সরকারের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার আনুষ্ঠানিক সংস্থা ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ডিএফএটিডি) থেকে উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স অধ্যয়নরত ছাত্রছাত্রীদের জন্য, যেন তাঁরা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে ফুল ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট নিয়ে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়তে আসতে পারেন। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকেও এই বছর থেকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এশিয়া থেকে আছে মাত্র তিনটি দেশ—বাংলাদেশ, নেপাল, তাইওয়ান।
কারা আবেদন করতে পারবেন
বর্তমানে বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট কিংবা মাস্টার্সে পড়াশোনা করছেন, এমন যে কেউ আবেদন করতে পারবেন। বিশেষত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট যাঁরা পড়ছেন, এটা তাঁদের জন্য সত্যিই একটা বড় সুযোগ বলে আমি মনে করি। থিওরিটিক্যালি বাংলাদেশে পিএইচডি অধ্যয়নরত যে কেউ এখানে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু যেহেতু অধিকাংশ বাংলাদেশি আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্সে অধ্যয়নরত, তাই আমার নিবন্ধটি শুধু তাঁদের ওপর ফোকাস করে লেখা।
বৃত্তি কত দিনের
চার মাস বা এক সেমিস্টারের জন্য স্কলারশিপটি দেওয়া হবে। এই একটা সেমিস্টার আপনি কানাডায় এসে কোনো একটা নির্দিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্সওয়ার্ক বা রিসার্চ ওয়ার্ক ইত্যাদি সম্পন্ন করবেন। এর যাবতীয় খরচ কানাডা সরকার বহন করবে।
এ স্কলারশিপে কী কী সুবিধা
যাঁরা এই বৃত্তির জন্য মনোনীত হবেন, তাঁরা ১০ হাজার ২০০ কানাডিয়ান ডলার পাবেন ৪ মাসের জন্য। বাংলদেশি টাকায় সাড়ে ৬ লাখের বেশি (১ কানাডিয়ান ডলার সমান ৬৬ টাকা ৯৩ পয়সা)। পুরোটা ট্যাক্স ফ্রি! ছয় মাসের রিসার্চের জন্য যে মাস্টার্সের শিক্ষার্থীরা আসবেন, তাঁরা ১২ হাজার ৭০০ কানাডিয়ান ডলার পাবেন (প্রায় সাড়ে ৮ লাখ টাকা)। স্কলারশিপটির স্কিম অনুযায়ী শিক্ষার্থীর কোনো টিউশন ফি থাকবে না কানাডাতে এই এক সেমিস্টার পড়ার জন্য। তাই এই টাকা দিয়ে মূলত ভিসা ফি, আসা–যাওয়ার প্লেনের টিকিট, থাকার খরচ, হেলথ ইনস্যুরেন্সসহ আনুষঙ্গিক সব খরচ বহন করা হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে এক পয়সাও ব্যয় করতে হবে না। এ তো গেল ফিন্যান্সিয়াল সুবিধা। আর এখানে কানাডায় এসে ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কিং, প্রফেসরদের সঙ্গে রিসার্চ করার অভিজ্ঞতা, ক্লাস করার অভিজ্ঞতা তো থাকছেই।
আবেদন কীভাবে করতে হবে
আবেদন নিজে নিজে সাবমিট করা যাবে না, করতে হবে বাংলদেশের নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে। নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টাল হেড বা ডিনকে গিয়ে বলতে হবে এই স্কলারশিপের কথা। তিনি নাম–পরিচয় উল্লেখ করে যাবতীয় ডকুমেন্টসহ অনলাইনে আবেদন জমা দেবেন কানাডায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে শিক্ষার্থীর আসতে চান এই স্কলারশিপের অধীনে, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনলাইনে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার জন্য ডিএফএটিডির অনলাইন পোর্টালে মোমেন্টাম অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে (https://bit.ly/2HCbLg1)। আবেদন অনলাইনে সাবমিট করলে সেটা পাওয়ার পরে কানাডার সেই বিশ্ববিদ্যালয় ডিএফএটিডি প্রার্থীর জন্য ফাইনাল আবেদন সাবমিট করবে। এই হলো ধাপগুলো।
কানাডার কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যাবে
ডেজিগনেটেড লার্নিং ইনস্টিটিউট (ডিএলআই) যুক্ত যেকোনো কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি। ডিএলআই বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা দেখার জন্য কানাডা সরকারের অফিশিয়াল www.canada.ca ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারতে হবে।
কী কী ডকুমেন্ট প্রয়োজন
নিচের ডকুমেন্টগুলো পিডিএফ বা ইমেইজ ফাইল আকারে অনলাইনে আপলোড করতে হবে। খেয়াল রাখা দরকার যে প্রতিটি ডকুমেন্টের সাইজ যেন পাঁচ মেগাবাইটের কম হয়। না হলে অনলাইনে আপলোড করতে পারবেন না। ডকুমেন্ট লিস্ট—
১. প্রুফ অব সিটিজেনশিপ: পাসপোর্ট/বার্থ সার্টিফিকেট হলেই হবে।
২. প্রুফ অব ফুলটাইম এনরোলমেন্ট: নিজ নিজ ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট থেকে এটা লেটারহেডে নিতে হবে।
৩. লেটার অব ইনটেন্ট: এখানে প্রার্থীকে লিখতে হবে, স্কলারশিপের মোটিভেশন লেটারের মতো করে।
৪. নেটার অব সাপোর্ট ফ্রম দ্য হোম ইনস্টিটিউশন: ডিপার্টমেন্টাল হেড বা ডিন প্রাতিষ্ঠানিক লেটার হেডে প্রার্থীর নামসহ উল্লেখ করবেন।
৫. লেটার অব ইনভাইটেশন ফ্রম দ্য কানাডিয়ান সুপারভাইজার: এটা শুধু যাঁরা মাস্টার্সে পড়ছেন এবং এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে কোনো কানাডিয়ান প্রফেসরের ল্যাবে রিসার্চ করতে আসতে চান, তাঁদের আপলোড করতে হবে। আন্ডারগ্র্যাজুয়েট যাঁরা কোর্সওয়ার্ক করতে আসতে চান, তাঁদের এটার দরকার নেই। কিন্তু আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট, যাঁরা রিসার্চ করতে আসতে চান, তাঁদের আবার লাগবে এটা। ওই কানাডার ইউনিভার্সিটির কোনো একজন সুপারভাইজার, যিনি কিনা প্রাতিষ্ঠানিক লেটারহেডে লিখবেন যে তিনি আপনাকে চার মাস মেন্টরশিপ করতে রাজি আছেন, এমন একটা প্রত্যয়নপত্র জমা দিতে হবে।
৬. সাইনড কপি অব মেমোরেন্ডাম অব আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ): আবেদনকারী প্রার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান বা ডিন কানাডার যে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী পড়তে আসতে চান, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেই তারা এমওইউ ফরম্যাট জানিয়ে দেবে। সেখানে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্টের ডিন বা হেডের স্বাক্ষর থাকবে আর বলা থাকবে যে বাংলদেশ থেকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আপনাকে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে কানাডায় পাঠানো হচ্ছে। কী উদ্দেশ্যে বা কী করবেন, সেখানে এসব লেখা থাকবে। আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলির উল্লেখ থাকতে হবে, যেমন কানাডায় থাকার সময় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুল টিউশন ফি মওকুফ করার বিষয়টির অবশ্যই উল্লেখ থাকবে। মোট কথা এমওইউ, এটা কানাডার ও আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়াসহ কিছু শর্তযুক্ত একটা চুক্তির মতো।
ভিসার জন্য কি ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হবে
এই স্কলারশিপ আপনার যাবতীয় খরচ বহন করবে। তাই কানাডার ভিসা আবেদনে আপনার কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স দেখাতে হবে না।
আইইএলটিএস লাগবে কি
কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজ নিজ ল্যাঙ্গুয়েজ রিকোয়ারমেন্ট আছে, যা ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ীও ভিন্ন ভিন্ন। তাই এ ব্যাপারে ডিএফএটিডি নিজ নিজ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে সাজেশন দিয়েছে। তবে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মিডিয়াম অব ইনস্ট্রাকশন প্রত্যয়নপত্র দেয়, যেখানে লেখা থাকবে যে আপনি ইংরেজিতে পড়াশোনা করেন, সেটা আপনার কানাডিয়ান ভার্সিটি গ্রহণ করে কি না। তবে এ ক্ষেত্রে স্ব স্ব কানাডিয়ান ভার্সিটির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেই এসব ব্যাপারে কনফার্ম হয়ে নেবেন আগেই, যেহেতু একেক ভার্সিটির পলিসি একেক রকম।
আবেদনের ডেডলাইন কবে
সাধারণত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত আবেদন করা যাবে। তবে এখানে বিষয় আছে। প্রতিটা কানাডিয়ান ভার্সিটির নিজস্ব ডেডলাইন থাকবে, যেটা মার্চের আগেও হতে পারে, তাই ভার্সিটিভেদে ডেডলাইন ভিন্ন হবে। এটা জানার জন্য সেই স্পেসিফিক ভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল স্কলারশিপ সেকশনে যোগযোগ করতে হবে।
স্কলারশিপ পেলে কবে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম শুরু হবে
যদি এই বছর (২০২১) আবেদন করে স্কলারশিপ পান, তাহলে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট যাঁরা শুধু কোর্সওয়ার্ক করতে আসবেন, তাঁরা অবশ্যই সেপ্টেম্বর ২০২১ অথবা জানুয়ারি ২০২২–তে কানাডায় উপস্থিত থাকবেন। আর যাঁরা কিনা রিসার্চ করার জন্য আসবেন (আন্ডারগ্র্যাজুয়েট ও মাস্টার্স উভয় ক্যাটাগরি), তাদের জুন ২০২১ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২–এর যেকোনো সময়েই কানাডায় অবশ্যই উপস্থিত থেকে রিসার্চ শুরু করতে হবে। স্কলারশিপের মেয়াদ (চার-ছয় মাস) শেষ হয়ে গেলে ক্যান্ডিডেটকে অবশ্যই নিজ নিজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে হবে।
এই এক্সচেঞ্জ স্কলারশিপটি আমাদের বাংলদেশের আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য সত্যিই অসাধারণ একটা সুযোগ। যাঁরা ইউবিসিতে আবেদন করতে চান, অবশ্যই করে ফেলুন।
লেখক: মো. নাজমুল হাসান তপু, ইলেকট্রিক্যাল ও কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে ফেলোশিপসহ পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ভ্যানকুভার, কানাডা