ফুটফুটে গারোশিশু রাজ নকরেক এখন ‘মান্দি’ ভাষায় কথা বলতে পারে। নিজের মাতৃভাষায় আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের অধিকার বুঝে পেয়েছে। তিন বছর আগেও রাজ নকরেক মাতৃভাষা মান্দিতে কথা বলতে পারত না। নিজ মাতৃভাষার পরিবর্তে কচি মনে দাগ কাটে বাংলা। কারণ; মা লিপমা নকরেক এবং বাবা জেনাবর্ধন দালবতের কর্মসংস্থান ঢাকায় হওয়ায় রাজ নকরেককেও ভর্তি হতে হয়েছিল ঢাকায়। এখানে তার সব সহপাঠীই ছিল বাঙালি। তাই মান্দি ভাষাচর্চার সুযোগ ছিল না।
নিজ ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য রাজকে দুই বছর আগে নিজ গ্রাম টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার ধরাটি সাধু মরিয়ম মিশনারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তি করানো হয়। সেখানে রোমান হরফে গারো ভাষায় পড়ালেখার সুযোগ ঘটে। রাজ এখন স্বচ্ছন্দে নিজ ভাষায় জোড়বেজোড় সংখ্যার নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারে। এছাড়া হাসিমুখে রসালো ছড়া আওড়ানোসহ মিষ্টি কণ্ঠে পাখি, পাহাড় আর বহমান নদীর সুরেলা গান গেয়ে তাক লাগিয়ে দেয়।
বাংলাদেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মান্দি’র বাস
গারোরা নিজেদের ‘মান্দি’ বলে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। তাদের মতে, গারো নামটি অন্যদের চাপিয়ে দেওয়া। বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর, জামালপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, গাজীপুর এবং টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় গারো উপজাতির বসবাস। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭৬ হাজার ৮৪৬ জন গারো আদিবাসীদের বসবাস রয়েছে। তবে ভারতের মেঘালয়ে সবচেয়ে বেশি গারো বাস করেন। গারো বা মান্দিদের আদি ধর্ম ছিল সাংসারেক ধর্ম অর্থাত্ প্রকৃতি-পূজারি ছিলেন তারা, গাছপালা প্রকৃতিকে পূজাই ছিল তাদের প্রধান ধর্ম। উনিশ শতকের শেষে গারোদের মাঝে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাপটিস্ট মিশনারিগণ।
এসময় তারা খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে শুরু করেন। বর্তমানে বেশিরভাগই খ্রিষ্টান ধর্ম পালন করে থাকেন। এর ফলে তাদের সামাজিক নিয়মকানুন, আচার-অনুষ্ঠানে বেশ পরিবর্তন এসেছে। ভাষা ও আদি ধর্মচর্চার মতো গারোদের অন্যান্য সংস্কৃতিও অস্তিত্ব সংকটের মুখে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ, স্বকীয় গান-নাচ, বিয়ের রীতি এখন অনেকটাই পাল্টে গেছে। জীবন ও জীবিকার জন্য অস্তিত্বের লড়াইয়ে হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে আদি পেশা। তাদের নিজস্ব কোনো জাদুঘর না থাকায় নিজেদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সবার সামনে তুলে ধরার সুযোগই নেই।
ঘর ছাড়ছে মান্দি সম্প্রদায়
মধুপুর গড়াঞ্চল ও সীমান্তবর্তী এলাকায় গারো সম্প্রদায়সহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বসবাস অনেক বেশি। বনাঞ্চল উজাড়ের সাথে সাথে তাদের জীবন-জীবিকা, আয়রোজগার, সংস্কৃতি সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অরণ্যের জীবনযাপন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় সর্বত্রই দারিদ্র্য বিরাজ করছে। একসময় অভাবের তাড়নায় বসতভিটা বিক্রি করে স্থানান্তরিত হলেও এখন কাজের সন্ধানে অরণ্য আর সীমান্তবর্তী ভিটা ছেড়ে শহরে পাড়ি দিচ্ছে মান্দি সম্প্রদায়ের হাজারো গারো নারী-পুরুষ। আচিকমিচিক সোসাইটির পরিচালক সুলেখা ম্রংয়ের মতে, দারিদ্রের কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাবা-মায়ের মুখে অন্ন তুলে দিতে গারো মেয়েরা স্কুল ছেড়ে, গ্রাম ছেড়ে শহরমুখী হন। মেয়েরা পার্লারে বিউটিশিয়ানের কাজ করেন—তুলির আঁচড়ে সৌন্দর্য ও লাবণ্য ফুটিয়ে তোলেন।
‘মাতৃতান্ত্রিক’ এখন কাগজে-কলমে
মেঘালয়ের গারোরা এখনো মাতৃতান্ত্রিক পরিবারে বিশ্বাসী। এ সম্প্রদায়ের পরিবারের কর্তা নারীরাই। তবে বাংলাদেশে গারো নারীরা প্রায়ই ক্ষমতাহীন। মাতৃতান্ত্রিকতা এখন মুখে বা বইপত্রে থাকলেও বাস্তবে তাদের সমাজ ও পরিবারে মাতৃতান্ত্রিকতার চর্চা দেখা যায় না। পৃথিবীতে সিঙ্গেল মাদার ধারণাকে অতি আধুনিক মনে করা হলেও, গারোরা কোনোদিন কোনো শিশুকেই অবৈধ বলে মনে করেনি। ঢাকায় একটি পার্লারে কাজ করেন জিহুদা ম্রং। তিনি জানান, পরিবারের সিদ্ধান্ত, ক্ষমতায়ন, সমাজের সালিশ ও বিচারব্যবস্থা, সম্পত্তির মালিকানা কিংবা অন্যান্য ক্ষেত্রে পুরুষের সিদ্ধান্তই এখন মুখ্য। পরিবার ও সমাজে নারী-পুুরুষ উভয়ের মতামত থাকলেও পুরুষের মতামতই চূড়ান্তরূপে গণ্য হয়।
বিয়ের আজব রীতি কমেছে
মান্দি সম্প্রদায়ের কোনো নারী যদি বিধবা হন, তাহলে তার আবার বিয়ে দেওয়া হয়। তবে সেই নারীর কোনো কন্যা সন্তান থাকলেই এক আজব নিয়মের মুখোমুখি হতে হয়। ওই নারীর কন্যা যদি নাবালিকা থাকে, তাহলে সে তার সত্ বাবাকে ‘বাবা’ বলেই ডাকতে শুরু করে। কন্যার বয়স বাড়লে অর্থাত্ বিবাহযোগ্য হলে তার সঙ্গে সৎ বাবার বিয়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে ওই কন্যা ‘বাবা’ ডাকের পরিবর্তে তাকে ‘বর’ বলে ডাকতে শুরু করেন। মায়ের বিবাহের সময়ে কন্যা যদি নাবালিকা না হন, তাহলে মায়ের বিয়ের পর পরই তার সঙ্গেও সৎ বাবার বিয়ে হয়ে যায়। বর্তমানে এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যেখানে এই সম্প্রদায়ের বেশ কিছু নারী এই রীতির বিরোধিতা করেছেন এবং এভাবে সৎ বাবাকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে রাজি হননি। কিন্তু তার মধ্যেও কিছু কিছু এলাকায় এখনো চালু আছে এই রীতি।
উত্সবের নাম ‘ওয়ানগালা’
মান্দি বা গারোদের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ উত্সব ওয়ানগালা। সাধারণত বর্ষার শেষে ও শীতের আগে, নতুন ফসল তোলার পর এ উত্সবের আয়োজন করা হয়। নকমা (গ্রাম প্রধান) সভা ডেকে উত্সবের দিন ঠিক করেন। এর আগে তাদের নতুন খাদ্যশস্য খাওয়া নিষেধ। দিনটি উদ্যাপন উপলক্ষে গারো সম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা বিচিত্র পোশাকে ও পাখির পালক মাথায় দিয়ে লম্বা ডিম্বাকৃতি ঢোলের তালে তালে নাচে। এটি গারোদের বছরের প্রধান বিনোদনের দিন। সমস্ত গারো পাহাড় মন্ত্র ও ঢোলের শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। এসময় মহিষের শিঙে বানানো একধরনের বিশেষ আদিম বাঁশির সুর সবাইকে বিমোহিত করে।