দেশে কর্মসংস্থানের সংকট এবং একটি উন্নত জীবনের আশায় প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন লাখ লাখ বাংলাদেশি। ধর্মীয় মিল এবং স্বজনদের আধিক্যের কারণে এখনো বাংলাদেশিদের পছন্দের শীর্ষে আছে মধ্যপ্রাচ্য। যার কারণে গ্রামের নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অসহায় মানুষদের সরলতার সুযোগ নিয়ে ফ্রি ভিসা নামের একধরনের ভিসার উদ্ভাবন করেছে দালালেরা।
বস্তুত ফ্রি ভিসা নামের কোনো ভিসার অস্তিত্ব নাই। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের ভিসা প্রক্রিয়া এক এবং প্রত্যেকটি দেশে একই প্রক্রিয়াতে কর্মী নিয়োগ দিয়ে থাকে। এসব দেশগুলোতে ফ্যামিলি ভিসা, ভিজিট ভিসা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারিং ভিসা, খাদ্দামা (নারী গৃহকর্মী) ভিসা, তাব্বাক (পুরুষ গৃহকর্মী) ভিসা, ড্রাইভিং ভিসা, কোম্পানির ভিসাসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির ভিসা দিয়ে থাকে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে নির্দিষ্ট কাজের চুক্তিতে ভিসা ইস্যু হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় বাংলাদেশি দালালদের প্ররোচনায় নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনের তুলনার অধিক ভিসা ইস্যু করেন। পরবর্তীতে দালালদের সঙ্গে একটি মৌখিক চুক্তিতে নিয়োগকর্তা তাদের হাতে ভিসা তুলে দেন। তারপর দালালেরা দেশের গ্রামীণ জনপদের দরিদ্র মানুষকে নানা রকম আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের কাছে সেসব ভিসা চড়া দামে বিক্রি করেন।
এসব ভিসা নিয়ে বিদেশ যাওয়া প্রবাসীর কাজের দায়িত্ব নিয়োগকর্তা নেন না। নিজের কাজ নিজেকে সন্ধান করতে হয়। কাজের জন্য সকাল-সন্ধ্যা ঘুরতে হয় রাস্তায় রাস্তায়। বাংলাদেশি শ্রমিকেরা অধিকাংশ অদক্ষ হয়ে থাকেন এবং সঙ্গে ভাষাগত সমস্যা থাকে নতুনদের। তাই তাদের জন্য একটি কাজ জোগাড় করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কাজের ক্ষেত্রেও থাকে সীমাবদ্ধতা, সব কাজে কথিত ফ্রি ভিসার শ্রমিকদের নিয়োগ দেয় না প্রতিষ্ঠানগুলো। বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে কোনো রকমে কাজ একটি জোগাড় করতে পারলেও থাকতে হয় ভয়ের মধ্যে।
যেহেতু নির্দিষ্ট কোম্পানি ছাড়া বাইরে কাজের অনুমতি নেই, তাই কাজ করা অবস্থাতে পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও গুনতে হবে বিশাল অঙ্কের জরিমানা এবং জরিমানা প্রদানে অপারগ হলে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ ছাড়াও কথিত ফ্রি ভিসায় কাজ করতে হলে কফিলকে (নিয়োগ কর্তা) কফালত (প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা) দিতে হয়। অনেক সময় কাজ না থাকার কারণে কফিলকে কফালত দিতে পারেন না প্রবাসীরা, এ ক্ষেত্রে আকামা (ওয়ার্ক পারমিট) শেষে সেটি নবায়ন করতে বড় ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েন তাঁরা। বিশেষত এ কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি অবৈধ প্রবাসী শ্রমিকদের সংখ্যা বেড়েই চলছে।
প্রথমত, দালালদের নানা রকম প্ররোচনা ও আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখানো এবং ভিসাপ্রত্যাশীকে নানা রকম অবাস্তব নিয়ম কানুন বলা। দ্বিতীয়ত, প্রবাসে থাকা অনেক আত্মীয়স্বজনরা তাদের দেশে থাকা স্বজনদের যে কোনো মূল্যে প্রবাসে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
ধার-দেনা করে, জমি-জমা বন্ধক রেখে, উচ্চ সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এমনকি অনেকেই নিজের সর্বস্ব বিক্রি করেও প্রবাসী হচ্ছেন। প্রবাসে আসার পর যখন দেখেন, কাজের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না, কোনো একটা কাজ জোগাড় করতে পারলেও কম বেতন, তখন অনেকেই চরম অর্থ কষ্টে ভোগেন এমনকি অনেকের থাকার জায়গাটুকু কপালে জোটে না। কফালত,পরিবারের খরচ, ঋণের সুদ, আকামা নবায়নসহ নানা রকম মানসিক চাপের মধ্যে থাকেন এসব প্রবাসী, ফলস্বরূপ দেখা দেয় নানা রকম শারীরিক সমস্যা।
সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে প্রবাসী মৃত্যুর একটা বড় অংশ হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করছে। পরিবারের সুখের আশায় প্রবাসী হলেও কফিন বন্ধী হয়ে ফিরে যাচ্ছেন দেশে, ফলে প্রবাসীর পরিবারে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। সম্প্রতি এক ওমান প্রবাসী (ফ্রি ভিসায় কাজ করা) দীর্ঘদিন কাজ না থাকার কারণে অনেক দিন যাবৎ চরম অর্থ কষ্টে জীবন অতিবাহিত করছিলেন, ভোগান্তির শেষ সীমান্তে আত্মহত্যা করেন।
সকলের উচিত ভিসা নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক হওয়া এবং ফ্রি ভিসা নামের কোনো ভিসা না নেওয়া। দালালের কাছ থেকে ভিসা না নিয়ে সরকার অনুমোদিত রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে ভিসা নেওয়া। দেশে কোনো একটা কাজের প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ শ্রমিক হিসেবে সরকার অনুমোদিত রিক্রুট এজেন্সির মাধ্যমে প্রবাসী হলে কাজের ক্ষেত্রে যেমন সুবিধা পাওয়া যায় তেমনি আর্থিকভাবে ও লাভবান হওয়া যায়।
মিনহাজ বিন মাহবুব
শিক্ষার্থী, হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ, চট্টগ্রাম
ঠিকানা: বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
বর্তমানে কাতারের দোহায় থাকেন
ই-মেইল: [email protected]