শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:২২ অপরাহ্ন
Uncategorized

ফেসবুক না থাকলে কি আরও ভালো হবে না

  • আপডেট সময় শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১
ওই সময়টায় আমি নিজে বিপদেই পড়েছি, তার চেয়ে বড় কথা, অন্যদের বিপদে ফেলেছি। বোস্টন থেকে নিউইয়র্ক যাব, প্রথম আলোর ঢাকা অফিস থেকে আসছেন হিসাব বিভাগের ব্যবস্থাপক পলাশ ভৌমিক, দুবাই থেকে আসছেন ইব্রাহীম চৌধুরী; তিনজনে একসঙ্গে হব মঙ্গলবার দুপুরে। আমাদের যোগাযোগের সূত্র গেল ছিন্ন হয়ে। আমার যোগাযোগের মাধ্যম মেসেঞ্জার আর হোয়াটসঅ্যাপ। একটু পর দেখি, নিউইয়র্কের লেখকবন্ধু আবু রায়হানের ই-মেইল, ‘ইব্রাহীম চৌধুরী আপনার আগমনের সময় আর স্থান জানতে চাইছেন। তিনি নাকি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।’ আমি জানালাম, দোষ আমারও নয়, তাঁরও নয়; জাকারবার্গের।

ফেসবুক-সাম্রাজ্যের ছয় ঘণ্টার পতন নিয়ে চলছে নানা কথাবার্তা। প্রথম পশলাটা ছিল রসিকতার, ব্যঙ্গ–বিদ্রূপের। ফেসবুকের ডাউন হওয়ার খবর জাকারবার্গকে জানাতে হয়েছে টুইটারে—এটা ছিল রসিকতার প্রথম উপাদান। এর পরের কথাবার্তা আস্তে আস্তে গুরুতর হতে লাগল। এডওয়ার্ড স্নোডেন, ২০১৩ সালে বহু গোপন নথি প্রকাশকারী সাংবাদিক–আইটি বিশেষজ্ঞ, টুইটারে বললেন, ‘হোয়াটসঅ্যাপের এই বিপর্যয় আপনাকে আর আপনার বন্ধুদের মনে করিয়ে দিচ্ছে যে সিগন্যাল বা অন্য কোনো অলাভজনক ওপেন সোর্স ব্যবহার করা ভালো। আর সেটা করতে মাত্র ৩০ সেকেন্ড লাগবে।’

নিউইয়র্ক টাইমস ফেসবুক বিপর্যয়ের ওপরে বিভিন্নজনের অনেকগুলো বক্তব্য ‘টু দ্য এডিটর’ কলামে পাঠকের চিঠি হিসেবে প্রকাশ করেছে। একেকজন একেক কথা বলছেন। একটা সুর অনেকের কথাতেই স্পষ্ট। তা হলো ফেসবুক আমাদের প্রকৃতির দিকে তাকানোর, আকাশের দিকে তাকানোর, কাছের স্বজনদের দিকে হাত বাড়ানোর সময় কেড়ে নিয়েছে। ছয়টা ঘণ্টা আমরা এ অবকাশ পেয়েছিলাম। মতামত কলামে একজন লিখেছেন, ‘কয়েক ঘণ্টার জন্য ফেসবুক বন্ধ ছিল, এটার কি চিরদিনের জন্য বিদায় নেওয়া উচিত?’ ফেসবুকের বিরুদ্ধে, ইনস্টাগ্রামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠেছে। এটা আমাদের সমাজের নানা ক্ষতি করছে—ফ্রান্সেস হিউগেন, ফেসবুকের দলত্যাগী কর্মী ভেতরের খবর প্রকাশ করে এ কথা বলছেন। সেসব নিয়ে আমেরিকায় শুনানি হচ্ছে। জাতিতে জাতিতে দ্বন্দ্ব, হাঙ্গামা, ঘৃণা ছড়ানো, মনোবিকার থেকে শুরু করে ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা ভারীই। এসব নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বেশি সক্রিয়। আমেরিকার মতো দেশে একাডেমিক পর্যায় থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা পর্যন্ত এসব নিয়ে ব্যাপক কাজ করছে।

স্মার্টফোন আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা তো প্রায় পুরোটাই কেড়ে নিয়েছে। আপনার স্মার্টফোনের সামনে আপনি গল্প করুন বন্ধুর সঙ্গে যে আপনি কলকাতা বা জেনেভা বা লন্ডন যাচ্ছেন। একটু পরে দেখবেন, এই সব শহরের হোটেল–রেস্তোরাঁ, ট্যুরিস্ট স্পটের বিজ্ঞাপন আপনার কাছে চলে আসছে। ওর মাইক্রোফোন আপনার কথা শোনে। বিশ্লেষণ করে। আমরা তো আসলে কাচের ঘরে বসবাস করছি।

এই অবসরে আমরা বরং আরও বড় প্রেক্ষাপট নিয়ে ভাবতে পারি। তা হলো পৃথিবীরই সার্বিক নিরাপত্তা। পৃথিবীর বহু কিছুই চলছে কম্পিউটারের মাধ্যমে, অনলাইনের মাধ্যমে। গাড়িঘোড়া চলছে গুগল ম্যাপ দেখে, বিমান চলছে অটোপাইলটে, বিদ্যুৎ সঞ্চালিত হচ্ছে, ট্রেনগুলো ছুটছে; সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে দূর থেকে, কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে। স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, পৃথিবী বাইরের এলিয়েনদের হাতে ধ্বংস হবে—এ আশঙ্কার চেয়ে পৃথিবীর মারণাস্ত্রগুলোর সুইচ কোনো উন্মাদ বা জঙ্গির হাতে পড়ে বিস্ফোরিত হয়ে পৃথিবী ধ্বংস হবে—এ আশঙ্কা বহুগুণে বেশি। আমরা জানি, উন্নত দেশের বহু স্পর্শকাতর অনলাইন-ব্যবস্থা হ্যাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকে। কিছুদিন আগে আমেরিকার পূর্ব উপকূলে তেলের সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছিল হ্যাকারদের দ্বারা সিস্টেমটা বেদখল হয়ে যাওয়ায়। ফেসবুক–সাম্রাজ্যের ছয় ঘণ্টার বিপর্যয় একটা ভুল কোড দেওয়ার জন্য ঘটেছে। এমন মানবিক ভুল অনিচ্ছাকৃতভাবেও ঘটতে পারে। আবার যে উন্মত্ত মানুষেরা নিজেদের মন খারাপ লাগছে বলে স্কুলে ঢুকে শিশুদের ওপরে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ করতে পারে, তেমন কোনো আইটি বিশেষজ্ঞ দল শুধু মনোবিকারের কারণে পৃথিবীর সাইবার নিরাপত্তাবলয় ভেঙে ঢুকে যে সবকিছু তছনছ করে দেবে না, এই গ্যারান্টি কে দেবে? দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে, বর্ণে বর্ণে শত্রুতা, হানাহানি তো আছেই। রাশিয়ান হ্যাকাররা যদি আমেরিকার নির্বাচনের ওপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাহলে আরও অনেক কিছুই করা সম্ভব।

স্মার্টফোন আমাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা তো প্রায় পুরোটাই কেড়ে নিয়েছে। আপনার স্মার্টফোনের সামনে আপনি গল্প করুন বন্ধুর সঙ্গে যে আপনি কলকাতা বা জেনেভা বা লন্ডন যাচ্ছেন। একটু পরে দেখবেন, এই সব শহরের হোটেল–রেস্তোরাঁ, ট্যুরিস্ট স্পটের বিজ্ঞাপন আপনার কাছে চলে আসছে। ওর মাইক্রোফোন আপনার কথা শোনে। বিশ্লেষণ করে। আমরা তো আসলে কাচের ঘরে বসবাস করছি।

আগে বলা হতো সাবধান, দেয়ালের কান আছে। এখন বলা হয় সাবধান, আপনার বা আপনার আশপাশে কোনো যন্ত্রের কান আছে। শুধু কান নয়, চোখও আছে। হ্যাকাররা আপনার বন্ধ ল্যাপটপ খুলে তার ক্যামেরা চালু করে দিতে পারে। সাইবার নিরাপত্তাই এখন দেশে দেশে প্রধান নিরাপত্তা-ইস্যু। এটা যেমন ব্যক্তিমানুষের জীবনের নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনছে, তেমনি রাষ্ট্রগুলোর এবং বিশ্বব্যবস্থার নিরাপত্তার প্রধান মাথাব্যথা এখন সাইবার সিকিউরিটি।

ফেসবুকের ধারণক্ষমতা কত বড়, কল্পনাও করতে পারি না। পৃথিবীর ৩০০ কোটি মানুষের অগণিত ছবি, অসংখ্য কথা, অগণিত ভিডিও তার কাছে রাখা। এত বড় যাদের পরিসর, কী সামান্য ভুলে তা ছয় ঘণ্টা ধরে অচল হয়ে রইল? তা যদি ঘটতে পারে, তাহলে একদিন দেখা গেল বিমান আকাশে উড়ে আর নামার ঠিকানা পাচ্ছে না, গাড়িগুলো পথ হারিয়ে বসে আছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ লন্ডভন্ড! হতে কি পারে না?

হতে পারে। তবে আশা হলো, হবে না। মানুষের শুভবুদ্ধিই এটা হতে দেবে না।

কোম্পানিগুলোকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করতে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে, যাতে তারা স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে পারে। সুপ্রিম কোর্ট বলছে, কোম্পানি হলো মানুষের সমষ্টি। তাহলে কোম্পানির ভুলের জন্য দায়ী মানুষদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

এটা একটা চিঠি। আমাদের আবেদন মানুষের শুভবুদ্ধির কাছে, একজন মানুষের ক্ষতি হতে পারে জানলেই আমরা সেই কাজ করা থেকে বিরত থাকব।

আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক

প্রথম আলো

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com