শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০৬:৩৮ পূর্বাহ্ন
Uncategorized

ফারাওয়ের দেশে

  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১১ জুন, ২০২১

মিশর বলতেই দুটো কথা মনে পড়ে, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি, পিরামিড ও ইতিহাসে পড়া পাঁচ হাজার বছর পুরনো, নীলনদের উপকূলে গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতা।তবে ইতিহাসের হাতছানি যতই থাক, মিশর পর্যটকদের জন্য খুব একটা নিরাপদ জায়গা নয়, এমন ধারণা অনেকেরই।

এমনকী, আমরা যাওয়ার কিছুদিন আগেই সেখানকার একটি চার্চে সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ হয়। তবে এই সমস্ত ঘটনার কোনওটাই টুরিস্ট স্পটগুলোতে ঘটে না। টুরিস্ট স্পটগুলোতে রাস্তা ভর্তি এত মিলিটারি, যে মাঝে মাঝে ভয়ই লাগে! আমাদের কায়রো যাওয়া আমার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে। সে-ই বলেছিল, ভয়ের কিছুই নেই। ভাগ্যিস তার কথায় বিশ্বাস করে চলে গিয়েছিলাম ফারাওয়ের দেশে!

কায়রো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যখন নামলাম, তখন আমি, আমার স্ত্রী আর আমাদের ছ’বছরের মেয়ে একই রকম এক্সাইটেড! শহরের ব্যস্ত রাস্তার ভিড় কাটিয়ে গাড়ি করে রওনা দিলাম হোটেলের উদ্দেশ্যে। চারদিকে গাড়ির আওয়াজের সঙ্গে মিশে আজানের ডাক, আর জ়েব্রা ক্রসিং না-মানা মানুষের ভিড়। মনে হল যেন দিল্লিতেই রয়েছি!তফাত শুধু একটাই, এখানে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রচুর গাধা। অবশেষে সন্ধেয় হোটেলে পৌঁছে সেদিনের মতো বিশ্রাম।

পরের দিন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ‘সেভেন ওয়ন্ডার্স অফ দ্য এনশিয়েন্ট ওয়র্ল্ড’-এর সবচেয়ে প্রাচীন এবং একমাত্র অবশিষ্ট ‘ওয়ন্ডার’— গিজ়ার পিরামিড। গাড়ি করে রওনা দেওয়ার আগে আমরা আমাদের কারেন্সি বদলে নিলাম ইজিপশিয়ান পাউন্ডে। আজকের যাত্রায় আমাদের সঙ্গে রয়েছেন আমাদের গাইড। এই টুরে সঙ্গে একজন গাইডকে অবশ্যই নেবেন। না হলে ওই অন্তহীন মরুভূমিতে অসংখ্য পাথরের স্তূপের মাঝে পথ হারিয়ে ফেলার সম্ভাবনা প্রবল। স্থানীয় হকার এবং উটচালকদের অযাজিত ডাকাডাকির হাত থেকে বাঁচিয়ে আমাদের গাইড এনে দাঁড় করালেন গ্রেট পিরামিড অফ গিজ়ার সামনে। তিনটি পিরামিডের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন এটাই। ফারাও খুফুর নামে একে পিরামিড অফ খুফুও বলা হয়। প্রথম দর্শনেই থমকে যেতে হয় এর বিশালতা দেখে। প্রায় ৫০০০ বছর আগে কিছু মানুষ কীভাবে বানিয়ে ফেলতে পেরেছিলেন ১৪৬.৫ মিটার উঁচু একটা পিরামিড? এরপরের দ্রষ্টব্য ছিল সেখানকার দ্বিতীয় সবচেয়ে বিখ্যাত পিরামিড, খুফুর ছেলের তৈরি পিরামিড অফ খেফ্রে। উল্লেখযোগ্য বিষয়, সবক’টি পিরামিডই নীলনদের পশ্চিম উপকূলে তৈরি। প্রাচীন মিশরীয়দের মতে, সূর্য অস্ত যাওয়ার দিকের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মৃত আত্মার। এখানে একটা ভুল ধারনা ভেঙে দিয়ে বলি,পিরামিডের ভিতরে কিন্তু মমি থাকত না। পিরামিডগুলো পুরোই পাথরের তৈরি, কোনও ঘর নেই ওর ভিতরে। ঘর থাকত পিরামিডের তলায়, তবে সেখানে মৃত রাজার জিনিসপত্র রাখা হত। যে সময়ে পিরামিড তৈরি হয়েছে, তখনও মমি তৈরি আবিষ্কারই করেনি মিশরীয়রা। গিজ়ায় এসে আরও একটা জিনিস দেখতেই হবে— দ্য গ্রেট স্ফিংক্স। এর শরীরটা সিংহের এবং মাথাটা ফারাও খেফ্রের। গিজ়ায় লাঞ্চ সারার পর আমরা এবার রওনা দিলাম কায়রোর ইজিপশিয়ান মিউজ়িয়ামের উদ্দেশ্যে। ফারাওদের ব্যবহৃত জিনিস, মূর্তি, গয়না থেকে মমি, কী নেই সেখানে! তবে মমি রাখার বিশেষ চেম্বারের ভিতর ছবি তোলা নিষেধ।

তৃতীয় দিনটা আমরা রেখেছিলাম শহরটা ঘুরে দেখার জন্য। আমাদের প্রথম দ্রষ্টব্য, সিটাডেল অফ কায়রো। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন মহম্মদ আলির অ্যালাব্যাস্টার মসজিদও। সিটাডেলের উপর থেকে দেখা যায় কায়রো শহরের অসাধারণ ভিউ। আমাদের পরের স্টপ, কপটিক কায়রো। এটি পুরনো কায়রোর একটি অংশ। এখানে রয়েছে ব্যাবিলন ফর্ট্রেস, কপটিক মিউজ়িয়াম, দ্য হ্যাংগিং চার্চ, দ্য গ্রিক চার্চ অফ সেন্ট জর্জ এবং আরও বেশ কয়েকটি কপটিক চার্চ। বলা হয়, ছোট্ট যিশু ক্রিষ্টকে নিয়ে তাঁর পরিবার একসময় থাকতেন এখানে। এখানকার এল মোয়েজ় স্ট্রিটে গিয়ে খোঁজ পেলাম বেশ জমজমাট একটা বাজারের। দরদাম করতে পারলে সুভেনিরস কেনার আদর্শ জায়গা এই বাজার। দিনটা ছিল বছরের শেষ দিন, তাই ডিনারটা তো স্পেশ্যাল হতেই হবে! আমার বন্ধুই আমাদের নিয়ে গেলেন কোশারি আবু তারেক রেস্তরাঁয়, যেখানে পাওয়া যায় একেবারে অথেনটিক মিশরীয় খাবার। এই রেস্তরাঁয় গেলে এঁদের বিখ্যাত কোশারি অবশ্যই খাবেন। এছাড়া রসনাতৃপ্তির জন্য আদর্শ হাওয়াওশি, ফাতেহ, সায়াদেয়া ও বেসারাহর মতো স্থানীয় খাবার।

নতুন বছরের প্রথম ভোরে আমরা কায়রো থেকে ফ্লাইটে চলে এলাম আরও দক্ষিণে, আসওয়ানে। উদ্দেশ্য, নীলনদের বুকে তিনরাতের ক্রুজ়। মোটরশিপে লাঞ্চ সেরে নিয়ে শুরু হল আমাদের ফেলুক্কা রাইড। বোটানিকাল গার্ডেন, মুসোলিয়াম অফ আগা খান ইত্যাদি দেখতে দেখতে চলল আমাদের নৌকোবিহার। আশপাশে চলছে আরও বিভিন্ন মাপ ও আকারের নৌকা, কোনওটা মাছ ধরার, কোনওটা মালবাহী, কোনওটা স্থানীয়দের ফেরি, কোনওটা আবার লাক্সারি ক্রুজ়। হাজার হাজার বছর ধরে বদলায়নি নীলনদের বুকে এইভাবে নৌকা চলা। সন্ধেবেলা আমরা ফিরে এলাম আমাদের ক্রুজ় শিপে। এবার যাব কোম ওমবো। এটি একটি জোড়া মন্দির, দু’জন দেবতার উদ্দেশে বানানো। দক্ষিণের মন্দিরটি কুমির দেবতা সোবেকের, তিনি উর্বরতা ও পৃথিবীর সৃষ্টির দেবতা। বাজপাখি দেবতা হ্যারোরিস রয়েছেন উত্তরের মন্দিরে। আগেই বলেছিলাম, পিরামিডের ভিতর মমি থাকত না। মমিগুলো ছিল এই আসওয়ানের কাছে, পাহাড় কেটে গুহা বানিয়ে তার ভিতরে। এগুলোকে টুম্ব বলে। এখনও পর্যন্ত ৬৩টি এমন টুম্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।এখানকার ভ্যালি অফ কিংসে মিশরের নিউ কিংডমের ফারাওদের মমিগুলো একসময় গোপনে মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। মিশরীয়দের কাছে এই ভ্যালি খুবই পবিত্র। টুম্বে ঢোকার মুখে দেওয়ালে দেখা যায় ‘বুক অফ দ্য ডেড’-এর থেকে নেওয়া নানা রঙের লেখা এবং ছবি আঁকা। আমরা এখন অবধি যা যা দেখেছি তার চেয়ে এবার বেশ অন্যরকম লাগল হাটশেপসুট মন্দির। এর আয়তকার থামের জন্য মন্দিরটিকে বেশ মর্ডান দেখতে লাগে। অর্ধগোলাকৃতি মন্দিরটিকে ঘিরে রয়েছে পাহাড়, আর মন্দিরটিও কিছুটা বানানো সেই পাথর কেটেই। মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের পঞ্চম ফারাও রানি হাটশেপসুটের উদ্দেশে বানানো এই মন্দির। রানির দৈব জন্ম থেকে শুরু করে তাঁর জীবনের নানা কাহিনি আঁকা রয়েছে মন্দিরের দেওয়ালে। নীলনদে আমরা যে তিন রাত ছিলাম তার প্রথম রাতে ছিল পূর্ণিমা।সে অভিজ্ঞতা কোনওদিন ভুলব না! রাতের অন্ধকারে নীলনদে চাঁদের ছায়া আর দু’পাশের তটভূমি হালকা সাদা আলোয় এক স্বপ্নরাজ্য হয়ে উঠেছিল!

আমাদের পরের গন্তব্য কারনাক মন্দির। এর ওরিজিনাল নাম ‘ইপেট-সুট’-এর অর্থ ‘সবচেয়ে সম্মানিয় স্থান’। মন্দিরে ঢোকার মুখে অভ্যর্থনা জানায় দু’দিকে থাকা র‌্যাম-হেডেড স্ফিংক্সের সারি। কারনাক সবচেয়ে বৃহত্তম ও সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অ্যাক্টিভ থাকা মন্দিরগুলোর অন্যতম। আমুন, মুট ও খোনসু নামক তিন দেবতাকে সমর্পণ করা এই মন্দির। খুঁটিয়ে দেখলে সিলিংয়ে এখনও অক্ষত অবস্থায় দেখতে পাবেন সেই প্রাচীন যুগের কিছু রং। মন্দিরের মূল গৃহটি ছাড়াও রয়েছে ছোট ছোট কিছু মন্দির ও বড় একটি পবিত্র লেক। কারনাক থেকে আমরা গাড়ি নিয়ে রওনা দিলাম লাক্সার মন্দিরের দিকে, এটাই আমাদের এই গ্র্যান্ড টুরের শেষ স্পট। একসময় কারনাক থেকে লাক্সার মন্দির পর্যন্ত স্ফিংক্সের মূর্তি দিয়ে সাজানো একটি রাস্তা ছিল। সেই পবিত্র পথ এখন সাজানো হচ্ছে আবার করে। দ্বাদশ রাজবংশের রাজত্বকালে লাক্সার, দ্য সিটি অফ হান্ড্রেড গেটস, ছিল মিশরের রাজধানী। সেই তখন থেকে এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে মন্দিরটি। ক্রিষ্ট যুগে মন্দিরের হাইপোস্টাইল হলটিকে চার্চ বানিয়ে ফেলা হয়েছিল। পরে সেটার উপরই তৈরি করা হয় সুফি শেখ ইউসুফ আবু আল-হাজাজের মসজিদ।

মিশর যেন সত্যিই রূপকথার গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা এক ম্যাজিকাল ল্যান্ড! ফারাওদের রাজত্ব, তাদের অসামান্য দেবতারা, বিশালাকার পিরামিড, অপূর্ব সুন্দর মন্দির… সেগুলো যেমন রহস্যময়, তেমনই চার্মিং। এবার ফেরার পালা। ল্যান্ড অফ ম্যাজিককে বিদায় জানিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটল এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে।

কীভাবে যাবেন:

সরাসরি ফ্লাইট নেই। কলকাতা থেকে আবু ধাবি বা মুম্বই হয়ে কানেকটিং ফ্লাইটে কায়রো যাওয়া যায়।

কোথায় থাকবেন:

ইন্টারনেট দেখে পছন্দ করে নিন হোটেল

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com