চীনে নারীদের তুলনায় পুরুষের সংখ্যা এতটাই বেশি যে তা ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা বললে কমই বলা হয়। বর্তমানে চীনে নারীর চেয়ে প্রায় ৩ কোটি বেশি পুরুষ রয়েছেন। ফলে দেশটির কোটি কোটি পুরুষ অবিবাহিত ও একাকীত্বে দিন কাটাচ্ছেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
বিশেষ করে দরিদ্র ও শ্রমজীবী শ্রেণির পুরুষদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন। চীনের একজন খ্যাতনামা ডেটিং কোচ, হাও বলেন, আমার তিন হাজার ক্লায়েন্টের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ। এরা বিয়ের জন্য সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা গোষ্ঠী। এই বাস্তবতা নিয়েই নির্মিত হয়েছে ভায়োলেট ডু ফেং পরিচালিত প্রামাণ্যচিত্র ‘দ্য ডেটিং গেম’। এতে হাও এবং তার তিন ক্লায়েন্ট ু ২৪ বছর বয়সী লি, ২৭ বছর বয়সী উ, এবং ৩৬ বছরের ঝউ সপ্তাহব্যাপী ডেটিং ক্যাম্পে অংশ নেন।
তিনজনই দরিদ্র গ্রামীণ পরিবেশে বড় হয়েছেন। নব্বই দশকের পর জন্ম নেয়া এই প্রজন্মের অনেককেই ছোটবেলায় বাবা-মা শহরে কাজ করতে যাওয়ায় আত্মীয়দের কাছে রেখে যেতে হয়েছিল। এখন তারা নিজেরাই শহরে এসে জীবনের মানোন্নয়ন এবং একজন স্ত্রী খোঁজার আশায় চেষ্টা করছেন।
চীনের দীর্ঘদিনের এক সন্তান নীতির ফলাফলই আজকের এই পরিস্থিতি। ১৯৮০ সালে চালু হওয়া এই নীতির কারণে অনেক পরিবারে ছেলে সন্তানকে প্রাধান্য দেওয়ায় লক্ষাধিক কন্যাশিশুকে পরিত্যক্ত করা হয়, গর্ভপাত করানো হয় অথবা কখনো কখনো হত্যা করা হয়। ২০১৬ সালে সরকার এই নীতি বাতিল করলেও এর প্রভাব থেকে জাতি এখনো মুক্ত হতে পারেনি।
ডেটিং কোচ হাও তার ক্লায়েন্টদের সাজিয়ে-গুছিয়ে, হেয়ারকাট ও অনলাইন প্রোফাইল তৈরি করে প্রস্তুত করেন। কিন্তু এই প্রোফাইল তৈরির ক্ষেত্রে তিনি বাস্তবতা একটু বাড়িয়ে বলেন, যা ক্লায়েন্ট ঝউর কাছে ‘মিথ্যা ও অস্বস্তিকর’ মনে হয়।
ঝউ বলেন, আমি অন্যকে প্রতারিত করছি মনে হয়। এটা আমার নিজের মতো মনে হচ্ছে না।
নির্মাতা ডু ফেং এটিকে আধুনিক সমাজের এক বড় সংকট হিসেবে তুলে ধরেন- বাস্তবতা বনাম ডিজিটাল জগতে নিজেদের উপস্থাপন। প্রামাণ্যচিত্রে চীনা নারীদের মধ্যে ভার্চুয়াল প্রেমিকের জনপ্রিয়তার চিত্রও উঠে আসে। চীনে ১ কোটিরও বেশি নারী অনলাইন প্রেমিক-ভিত্তিক গেম খেলছেন। কারণ হিসেবে এক নারী বলেন, বাস্তব জীবনের প্রেম সময়, অর্থ এবং আবেগের অপচয়। ভার্চুয়াল পুরুষরা সব দিক থেকেই পারফেক্ট। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের সমাজবিজ্ঞানী ড. ঝেং মু বলেন, চীনে দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, কর্মক্ষেত্রের নিষ্ঠুরতা, প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ ও রক্ষণশীল লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে নারীরা পুরুষদের থেকে আবেগগত স্থিতিশীলতা আশা করে। এই ভার্চুয়াল প্রেমিকেরা সেই চাহিদা পূরণ করে।
বিবাহের চাপে পুরুষেরা বিপর্যস্ত
চীনা সমাজে এখনো পুরুষদের প্রধান উপার্জনকারী এবং পরিবারের কর্তা হিসেবে বিবাহযোগ্য হতে হয়। সমাজ যদি কাউকে সেই মানদণ্ডে না মেনে নেয়, তবে তা একধরনের সামাজিক অপমান। ড. মু বলেন, বিয়ে করতে না পারা চীনা পুরুষদের মানসিক চাপে ফেলছে। ঝউ জানান, তার একটি ডেটিংয়ের খরচ প্রায় ৩০০ ইউয়ান। অথচ তার মাসিক আয় মাত্র ৬০০ ইউয়ান। তিনি বলেন, শেষমেশ আমাদের নিয়তি সমাজই নির্ধারণ করে দেয়।
চীনে দরিদ্র পুরুষদের জন্য একমাত্র ‘শ্রেণি উত্তরণের’ পথ হচ্ছে সামরিক বাহিনীতে যোগদান। প্রামাণ্যচিত্রে এই রিক্রুটমেন্ট প্রক্রিয়ার চিত্রও দেখা যায়। প্রামাণ্যচিত্রটির নির্মাতা ডু ফেং বলেন, আমি গভীরভাবে চিন্তিত— বর্তমান প্রজন্ম কীভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এই চলচ্চিত্র আসলে ডেটিংয়ের বাইরেও আমাদের সমাজে ছড়িয়ে থাকা একাকীত্ব ও আত্মপরিচয়ের সংকট নিয়ে। প্রামাণ্যচিত্রের শেষে দেখা যায়, প্রেম না মিললেও অংশগ্রহণকারীরা নিজের আত্মবিশ্বাস ও ব্যক্তিত্ব খুঁজে পেতে শুরু করেছেন। ডু ফেং বলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তারা নিজেদের মতো মানুষদের খুঁজে পেয়েছেন, যারা তাদের বুঝতে পারে, কাঁধে হাত রেখে বলে— আমি তোকে দেখি। তুই পারবি। আর হাও বলেন, নিজেকে ভালোবাসতে শেখো। তাহলেই অন্যরা তোমায় ভালোবাসবে।