বুধবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫১ অপরাহ্ন

প্রিন্সেস আইল্যান্ড সাগর যেখানে পাহাড়ে মিশেছে

  • আপডেট সময় শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

ইস্তাম্বুলের দুপাশে দুটি সাগর। একটি কৃষ্ণসাগর ও অন্যটি মারমারা। এ দুটি সাগরকে যুক্ত করেছে বসফরাস প্রণালি। আবার বসফরাস প্রণালি ইস্তাম্বুলকে এশিয়া ও ইউরোপ মহাদেশকে আলাদা করেছে। একটি শহরের একাংশ এশিয়ায় ও অন্য অংশ ইউরোপে। ব্যাপারটা বেশ মজার।

মারমারা সাগরের মধ্যে বেশ কিছু দ্বীপ জেগে আছে বহু বছর ধরে। নয়টি দ্বীপ নিয়ে গঠিত প্রিন্সেস আইল্যান্ড। ইস্তাম্বুল থেকে চারটি আইল্যান্ডে যাওয়ার জন্য ক্রুজ আছে। এসব দ্বীপে বসতি আছে। প্রিন্সেস আইল্যান্ড নাম কেন জানেন? বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সময় রাজপরিবারের যেসব সদস্যকে নির্বাসন দেওয়ার প্রয়োজন হতো, তাঁদের আনা হতো এসব দ্বীপে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের সময়ও দ্বীপগুলো একই কাজে ব্যবহৃত হতো। এ জন্য এর নাম প্রিন্সেস দ্বীপ। ইস্তাম্বুলের মূল ভূখণ্ড থেকে দূরত্ব ১৩ থেকে ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে। সবচেয়ে কাছেরটি কিনালিদা এবং সবচেয়ে দূরে তাভসানাদসি। সবচেয়ে বড় দ্বীপের নাম বুয়ুকাদা। এখানে সবচেয়ে বড় পাহাড় আছে।

এখানে রাজপরিবারের অনেক সদস্যকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল।

 ইস্তাম্বুলের দুপাশে দুটো সাগর
গত দুই সপ্তাহে প্রশিক্ষণ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় ইস্তাম্বুলের খুব বেশি কিছু দেখা হয়নি। আমার বড় ভাই রেজাউল করিম। তিনি নেদারল্যান্ডসে ড্রাগ ডেভেলপমেন্ট বা নতুন ওষুধ আবিষ্কার করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। ইস্তাম্বুলে আসার আগেই দুই ভাই ঠিক করি, ইস্তাম্বুল ঘুরে দেখব।

বড় ভাই নেদারল্যান্ডস থেকে ইস্তাম্বুলে আসেন। উনি আসায় আমিও খুব খুশি হই। অনেক দিন দেখা হয় না। আর বড় ভাই থাকলে সুবিধার শেষ নেই। খরচ নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। দেশ থেকে ইউরো এনেছিলাম। এখানের বিমানবন্দরে এসে শুনি লিরা ছাড়া নাকি ইস্তাম্বুলে কিছুই চলে না। বিমানবন্দরে ইউরো লিরায় রূপান্তর করায় বেশ টাকার ক্ষতিই হলো। মনে মনে ভাবলাম, দেশ থেকে লিরা আনলে আরও বেশি আনতে পারতাম। এদিকে যে লিরা আমার কাছে ছিল, গত কয়েক দিনে তা শেষের দিকে।

বড় ভাই আসায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। যাক, খরচের চিন্তা তো আমার নেই। বড় ভাই নেদারল্যান্ডস থেকেই অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করেছিলেন। আমিও আমার হোটেল ছেড়ে উঠলাম ভাইয়ের অ্যাপার্টমেন্টে। দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নিই প্রিন্সেস আইল্যান্ড দেখতে যাব। প্রিন্সেস আইল্যান্ড দেখতে যাওয়ার ক্রুজগুলো ছাড়ে কাবাটাস থেকে।

পরদিন সকালে উঠেই ট্যাক্সিক্যাব নিয়ে কাবাটাসের দিকে ছুটলাম। আধা ঘণ্টা পর পৌঁছে গেলাম ক্রুজঘাটে। বিশাল সাগর দেখে দুই ভাই ভয় পেয়ে গেলাম। আমরা দুজনে খুব ভিতু টাইপের। যাব কি না, চিন্তা করছিলাম। এদিকে ক্রুজ ছাড়তে দেরি নেই। ৭০ লিরা করে দুটি টিকিট কেটে দুজন দিলাম ভোঁ-দৌড়। বড় বড় জাহাজ চলাচল করে। জাহাজে উঠে আলাপ করলাম ঢেউ বেশি হলে বেশি দূর যাব না। কাছের আইল্যান্ডে নেমে ঘুরে চলে আসব।

ক্রুজে উঠে খুব একটা রোলিং মনে হলো না। সাগরের মাঝখানেও কোনো রোলিং নেই। পরে সিদ্ধান্ত নিই শেষ আইল্যান্ডে যাব।

দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়ি
দ্বীপের ঐতিহ্যবাহী কাঠের বাড়িছবি: লেখক

জাহাজে বসে দুই ভাই মিলে মারমারা সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলাম। মারমারা সাগরকে খুব মায়াবী মনে হয় আমার কাছে। খুব শান্ত। সাগরের পানি টলটল করে। ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করে।

সাগরে অ্যালবাট্রস পাখির ওড়াউড়ি দেখতে বেশ মনোমুগ্ধকর লাগে। মাঝে মাঝে সাগরে ডলফিনের দেখা মেলে। উঁকি মেরে আমাদের দেখে আবার পালিয়ে যায় যেন।

সাগর থেকে দূরে দেখা যায় মায়াবী শহর ইস্তাম্বুল। মসজিদের মিনারগুলো অনেক দূর থেকে দেখা যায়।

সব কটি মসজিদই উসমানীয় নির্মাণ ধাঁচে বানানো। মাঝখানে গোল একটা গম্বুজ। এ গম্বুজের মসজিদের অংশে নানান রকমের কারুকাজ করা থাকে। নানান ধরনের ক্যালিগ্রাফি করা থেকে। দেখলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। মূল গম্বুজের পাশে ছোট তিন থেকে চারটি গম্বুজ থাকে। আর চারদিকে থাকে দু-চারটি মিনার। এগুলো মাথা উঁচু করে জানান দেয়। মনে হয় উসমানীয় মাম্রাজ্যের পতাকা এখনো তুলে ধরে আছে। কত দিন হয়ে গেল একেকটা মসজিদের। ৬০০ থেকে ৭০০ বছর আগের মসজিদের নামাজ পড়তে গেলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। কত ক্ষমতাধর, আল্লাহর কত প্রিয় বান্দা এখানে নামাজ পড়েছেন। আমি যেখানে সেজদা দিচ্ছি, সেখানে সেজদা দিয়েছেন।

জাহাজ মারমারা সাগরের বুক চিরে এগিয়ে যায় প্রিন্সেস আইল্যান্ডের দিকে। দুই ভাইয়ের ভয় একেবারেই কেটে গেছে। দুজনে সাগরের সৌন্দর্য উপভোগ করছি। মাঝেমধ্যে ছবিও তুলছি। দুজনে সিদ্ধান্ত নিই, সব শেষ আইল্যান্ডে যাব। কারণ, ওটা সব চেয়ে বড়।

জাহাজ প্রথমে কিনালিদা, তারপর বুরগাজাদাসি, হেইবেলিয়াদা এবং শেষে বুয়ুগাদা আইল্যান্ডে থামে। যাত্রীদের অনেকে প্রথম তিনটি আইল্যান্ডে নেমে যান। বেশির ভাগই নামেন শেষ আইল্যান্ডে।

দূর থেকে আইল্যান্ডগুলো বেশ মনোমুগ্ধকর লাগে। সাগরের পাড় থেকে ধীরে ধীরে পাহাড় উঠে গেছে আকাশে। পাহাড়গুলো কেটে কেটে বানানো হয়েছে বাসা। এমন বাসায় থাকতে কার না ইচ্ছা করে।

শেষ স্টপেজে এলে আমরা নেমে পড়ি। পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে যাই। আইল্যান্ডের মাঝখানে একটা গোল চত্বর। আরও কিছুটা ওপরে উঠে খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সকালে তাড়াহুড়োয় নাশতা করা হয়নি। পেট ক্ষুধায় চোঁ-চোঁ করছে। দুজন মিলে দুটি দ্রুম অর্ডার করি। দ্রুম হলো পাতলা রুটির মধ্যে মাংস, টমেটো, শসা, পেঁয়াজ, মরিচ ও অন্যান্য মসলা দিয়ে পেঁচিয়ে বানানো একধরনের খাবার। আমাদের দেশে শর্মার মতো অনেকটা। তবে খুব সুস্বাদু। একটা দ্রুম খেলে পেটে আর জায়গা থাকে না।

খাওয়ার পর আমরা ঘুরতে বের হই। আইল্যান্ডের এক প্রান্তে যাব। পাহাড়ের ওপর উঠছি আর উঠছি।

চারপাশের বাড়িগুলো বেশ শান্ত, নীরব। কোনো কোনো বাড়িতে কেউ কাজ করছে। বেশির ভাগ বাড়িতে কাউকে দেখতে পেলাম না। এ আইল্যান্ড আমাদের দেশের গ্রামগুলোর মতো অনেকটা। নতুন বানানো বাড়িগুলোয় আধুনিকতার ছাপ দেখা যায়। পুরোনো বাড়িগুলো কাঠের। কোনো কোনটা ভেঙে গেছে। অ্যালবাট্রসগুলো সাগর বাদ দিয়ে বাড়ির ছাদে বা রাস্তায় ওড়াউড়ি করছে।

হেঁটে হেঁটে আমরা একেবারে পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছে যাই। সেখানে সৈকত দেখা যাচ্ছে। হু হু করে ঠান্ডা বাতাস আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ সাগরপাড়ে বসে সাগর দেখি মুগ্ধ হয়ে। সাগরের কাছে গেলে নিজেকে খুব ক্ষুদ্র মনে হয়।

সাগরপাড়ে সারি সারি খাবারের দোকান। সাগরের নানান ধরনের মাছের পসরা বসিয়ে পর্যটকের অপেক্ষায় আছে। সাগপাড়ে বসে খেতে খেতে সাগর দেখার মজাই আলাদা। কিন্তু আইল্যান্ডে পর্যটকের জন্য যে আয়োজন, সে পরিমাণ পর্যটকের দেখা মেলে না।

সাগরপাড়ে বসে আমরা কফি খাই। দোকানির সঙ্গে টুকটাক গল্প করি। তারা ইংরেজি ভালো পারে না। আর আমরা তুর্কি ভাষা পারি না। গুগল ট্রান্সলেটরের সাহায্যে যতটুকু পারা যায়। দোকানির কাছে জানতে চাইলাম, পর্যটক কম কেন? উত্তরে সে যা বলল, তা হলো ইস্তাম্বুলে এখনো বেশ শীত। গরম পড়তে শুরু করেনি এখনো। গরম পড়লে পর্যটক বাড়বে।

কফি শেষ করে মসজিদের দিকে পা বাড়াই। এখানকার মসজিদটিও উসমানীয় ধাঁচে গড়া। মসজিদে নামাজ পড়ে সাগরপাড়ে পার্কে বসে থাকি। কেউ কেউ সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে সাইকেল, মোটরসাইকেল ভাড়ায় পাওয়া যায়। এগুলো ভাড়া নিয়ে লম্বালম্বি চার কিলোমিটার ঘোরা যায় খুব সহজেই। এ ছাড়া পাহাড়ে উঠে ঘুরে বেড়ানো যায়।

শান্ত সাগরের পাড়ে বসে, সাগরের হিমেল হাওয়ায় উদাস মনে সাগরের বিশালতা উপভোগ করতেই আমার ভালো লাগে।

এবার ফেরার পালা। আবার ৭০ লিরা দিয়ে টিকিট কেটে উঠে পড়ি জাহাজে। বিকেলে সাগর আরও মায়াবী হয়ে যায়। সাগর দেখতে দেখতে কখন যে দেড় ঘণ্টা চলে যায় বুঝতেই পারি না। ভয়কে জয় করে ঘুরে এলাম প্রিন্সেস আইল্যান্ড।

শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর

ভ্রমন সম্পর্কিত সকল নিউজ এবং সব ধরনের তথ্য সবার আগে পেতে, আমাদের সাথে থাকুন এবং আমাদেরকে ফলো করে রাখুন।

© All rights reserved © 2020 cholojaai.net
Theme Customized By ThemesBazar.Com