বাংলাদেশের সড়কগুলোয় শিক্ষার্থীদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, শহরের বিভিন্ন স্থানে আবর্জনা পরিষ্কারের চিত্র ও বিভিন্ন দলের নাগরিকদের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দেওয়ার হৃদয়স্পর্শী ছবিগুলো সারা পৃথিবীর মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গ্রুপগুলোর আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে এগুলো এখন বারবার আসছে। অনেক প্রবাসী দেশের ক্রান্তিকালে এই স্বেচ্ছাসেবীদের মতোই নিজেদের সময়, মেধা ও সম্পদকে কাজে লাগানোর পথ খুঁজছেন।
আজকের বাংলাদেশে প্রবাসীরা দেশের জন্য অবদান রাখেন মূলত রেমিট্যান্স পাঠিয়ে। খুব নগণ্যসংখ্যক প্রবাসীই এর বাইরে অন্য কোনো ক্ষেত্রে বর্তমানে অবদান রাখতে পারছেন। প্রবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে শিক্ষিত ও সবচেয়ে অর্থশালী বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন, যাঁরা রেমিট্যান্সের চেয়েও গভীরতর অবদান রাখতে পারেন। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশ্বমানের কর্মসংস্থানের প্রকল্পে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে জড়িত হতে পারেন।
একসময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর স্যার ফজলে হাসান আবেদের মতো মানুষেরা প্রবাসজীবন ছেড়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রকল্পে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, অগণিত মানুষের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন। পৃথিবীজুড়ে তাঁদের অসামান্য সফলতার জন্য সম্মানিত হয়েছেন।
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশের পরিবেশ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিভাবান প্রবাসীদের দেশে ফিরে অবদান রাখার পক্ষে অনুকূল ছিল না। সবকিছু দলীয়করণের এই সময়ে রাজনৈতিক দলের দাসত্ব না করে, সম্মান ও মর্যাদা বাঁচিয়ে দেশে থাকা অত্যন্ত কঠিন ছিল। এর ফলে দেশের সবচেয়ে মেধাবী, সবচেয়ে সৃজনশীল মানুষদের একটা বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে গেছে। যাঁরা যাননি, হয় তাঁরা ক্ষমতাসীনদের দাসত্ব করেছেন অথবা ক্রমাগত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, উৎপীড়িত হয়েছেন।
২০০৬-০৮ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং পরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক দক্ষ বাংলাদেশি প্রবাসী দেশে ফিরে এসেছিলেন দেশ পুনর্গঠনে ও জাতীয় উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য কর্তব্য ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন এই সময়কে রাজনৈতিক উত্তরণের সময় ও সংস্কারের সুযোগ হিসেবে দেখেছেন অনেক প্রবাসী। প্রাথমিক আশাবাদ এবং সংস্কারের উদ্দীপনা অনেক দক্ষ ও সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রবাসীকে বাংলাদেশে ফিরে আসতে আকৃষ্ট করেছিল।
বিশেষ করে যাঁদের ব্যবসা, প্রযুক্তি ও গবেষণার মতো ক্ষেত্রগুলোয় দক্ষতা রয়েছে, তাঁরা দেশে ফিরে আসতে এবং তাঁদের দক্ষতা ও জ্ঞান দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতিতে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।
শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি দেশীয় ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে একাধিক দফায় কয়েক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে উন্নয়ন বন্ড ইস্যু করে। সারা বিশ্বের সম্পদশালী প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই সংকটের সময়ে একইভাবে অবদান রাখবেন, নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সর্বোপরি ড. ইউনূসের বিশ্বময় অগাধ বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, যা অনেক বৈশ্বিক সংস্থাকে অনুপ্রাণিত করবে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য, ঋণ দেওয়ার জন্য।
আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করার প্রচেষ্টাসহ সংস্কারের কিছু প্রাথমিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও সংস্কারগুলো প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম ছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় ফিরে আসার ফলে অনেক সংস্কার স্থগিত হয়ে যায়।
খুব দ্রুত দুর্নীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পুরোনো রাজনৈতিক গতিশীলতার পুনরুত্থান দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তনের সুযোগ হাতছাড়া করে দেয়। অর্থপূর্ণ পরিবর্তনে অবদান রাখার আশা নিয়ে ফিরে আসা প্রবাসীদের ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়। আশাহত হয়ে প্রবাসে ফিরে যান প্রায় সবাই।
২০২৪ সালে ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর আবার আমরা প্রবাসীরা স্বপ্ন দেখছি কীভাবে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর চেয়েও বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারব। সোশ্যাল মিডিয়াতে আলোচনা করছি, কীভাবে দেশের লাখো কোটি মানুষের মতোই স্বেচ্ছাসেবী হতে পারব।
আমরা আবারও স্বপ্ন দেখছি দেশ সংস্কারে অবদান রাখার। শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, যেটা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে শুরু হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের জীবনকে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করবে—দেশের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা আর প্রযুক্তি নীতিমালা—সেগুলো নিয়ে প্রবাসীদের কিছু কার্যক্রম ও মতামত এখানে তুলে ধরব।
সম্প্রতি সিলিকন ভ্যালির নানা বহুজাতিক কোম্পানির প্রবাসী বাংলাদেশি নেতা, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক এবং বাংলাদেশের ক্ষুদ্র কিন্তু দ্রুত বর্ধনশীল বেসরকারি সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোইলেকট্রনিকস শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পপতি, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষক, সরকারের আমলা আর মন্ত্রিপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে অনলাইনে বেশ কিছু আলোচনায় হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, এ উদ্যোগের পেছনে প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে মার্কিন সরকারের সাম্প্রতিক সেমিকন্ডাক্টর গবেষণা ও উত্পাদনে ২৮০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ, যা সিএইচআইপিএস অ্যান্ড সায়েন্স আর্ট নামে পরিচিত।
সেমিকন্ডাক্টর চিপ বিশ্বব্যাপী এক ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের একটি খাত, আর এটি প্রায় পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের বিভিন্ন শিল্প খাতকে চালিত করে, যার মধ্যে রয়েছে অটোমোটিভ, টেলিকম, স্বাস্থ্যসেবা, এআই, সফটওয়্যার ও আইটি পরিষেবা।
ভূরাজনৈতিক নানা কারণে চীন থেকে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন, প্যাকেজিং ও অ্যাসেম্বলি অন্য দেশগুলোয় স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছে আগামী কয়েক বছরে এবং বাংলাদেশ এই বাণিজ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে এ সুযোগকে কাজে লাগাতে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণার সংস্কৃতি বিকাশে বিনিয়োগ অপরিহার্য।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী বিশেষজ্ঞরা দেশে মাইক্রোইলেকট্রনিকস শিল্পের প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য একটি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা প্রতিষ্ঠার নীতি প্রণয়ন ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করার জন্য একটি নিদর্লীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের ওপর জোর দিয়েছেন—ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএফ, ডিএআরপিএ আর ভারতের ডিআরডিওর কাঠামোর অনুকরণে।
প্রবাসী বিশেষজ্ঞরা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সেমিকন্ডাক্টর, মেমোরি সিস্টেম, এআই ইন্টিগ্রেশন এবং শক্তিশালী শিক্ষা ও গবেষণা অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করতে। তাঁরা একটি টেকসই শিল্প গড়ে তোলার জন্য নীতিগত পদক্ষেপ গ্রহণের, মাইক্রোচিপের নকশা, উত্পাদন ও প্যাকেজিং সক্ষম করার জন্য একটি ইকোসিস্টেম তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর বারবার জোর দিয়েছেন। সফল হলে এর মাধ্যমে উচ্চ বেতনের লক্ষাধিক চাকরি সৃষ্টি হবে দেশে।
সর্বশেষ আলোচনাটি ছিল জুলাইয়ের ১১ তারিখে যখন দেশে উত্তাল ছাত্র আন্দোলন চলছে। সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন এ আলোচনায়। বলা বাহুল্য, প্রবাসীরা, যাঁরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ, তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের কৌশল, পরিকল্পনা আর প্রধানমন্ত্রীকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতাকে খুব গভীর আর সুদূরপ্রসারী মনে করেননি।
সে কারণে প্রবাসী অংশগ্রহণকারীদের অনেকেই সরকারের সঙ্গে এ ধরনের আলোচনায় ক্রমান্বয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। তবে সরকারপক্ষ এটা অনুধাবন করেছে যে মাইক্রোইলেকট্রনিকস শিল্প বাংলাদেশে গার্মেন্টস অথবা রেমিট্যান্সের চেয়েও অনেক বড় অর্থনীতির খাত হতে পারে, উচ্চ বেতনের অনেক চাকরি তৈরি করতে পারে দেশে।
সেমিকন্ডাক্টর সেক্টরে অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করার ব্যাপারে তাদের দৃঢ় আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সরকার সফলতা অর্জনের সঠিক প্রক্রিয়ার পথে চলেনি। সেমিকন্ডাক্টর মাইক্রোইলেকট্রনিকস নিয়ে কোনো কিছু কার্যক্রম শুরু হওয়ার আগেই সরকার ক্ষমতা হারিয়েছে।
মাইক্রোচিপের মতোই বাংলাদেশের আইটি, টেলিকমিউনিকেশন, বায়োটেকনোলজি, পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে একই রকম পরিকল্পনা প্রয়োজন, যেগুলোয় কৃতবিদ্য প্রবাসীরা গভীর ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।
১০ কোটি মানুষের দেশ ভিয়েতনাম ২০০৭ সালে ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করত বিশ্ববাজারে। আমরা বাংলাদেশিরা ১৭ কোটি মানুষের দেশ, তখন করতাম ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি। ২০২২ এসে উচ্চ প্রযুক্তিতে ভর করে ভিয়েতনাম বিশ্ববাজারে ৩৮৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে।
এটা সম্ভব হয়েছে কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও গবেষণার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে শক্তিশালী নীতি প্রণয়ন আর বাস্তবায়নের মাধ্যমে, তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান উন্নয়নের মাধ্যমে, গবেষণায় বিনিয়োগ, প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ আর বহির্বিশ্বের অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে।
উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য বিনিয়োগ অগণিত উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীর জন্য বিশ্বমানের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে আজ ভিয়েতনামে আর সেটার প্রভাব পড়েছে তাদের বিশাল আকারের রপ্তানিতে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের ২০২২ সালের ৫৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানিতে শিক্ষা, প্রযুক্তি, জ্ঞানের অবদান খুবই নগণ্য।
দেশ নিয়ে হতাশা আর পথনির্দেশনার অভাবে কয়েক দশক আগে ভিয়েতনামের বিশাল জনগোষ্ঠী বৈধ-অবৈধ পথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে ব্যাপক হারে। আজ তাদের অনেকেই নিজের দেশে ফিরে আসার সুযোগ আর অনুকূল পরিবেশ কাজে লাগিয়ে দেশ গড়ায় অংশ নিচ্ছে; সঙ্গে নিয়ে আসছে বিনিয়োগের অর্থ আর গভীর অভিজ্ঞতা।
মেধাবী প্রবাসীরা দেশে এসে অথবা বিদেশে বসে কী করতে পারবেন, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রকল্পের আর্থিক জোগান আমরা কীভাবে দেব, আমরা কখন তার সুফল দেখব—এগুলো সবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমাদের সমষ্টিগত বুদ্ধিমত্তা আর চিন্তাভাবনা দরকার এসব প্রশ্নের ওপর।
পৃথিবীজুড়ে বিভিন্ন দেশ কোন বিষয়গুলোয় মনোযোগ দিচ্ছে, তার সঙ্গে আমাদের দেশের কোন সমস্যাগুলোর সমাধান সবচেয়ে জরুরি, কোন প্রকল্পগুলো আমাদের শিক্ষিত তরুণ সমাজের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, সেগুলো শনাক্ত করা প্রয়োজন। ড. ইউনূসের তিনটি শূন্যের বিশ্ব—শূন্য নেট কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদকেন্দ্রিকতা ও শূন্য বেকারত্ব—পরিকল্পনার তিনটি স্তম্ভ মূল হতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার এ মুহূর্তে ন্যায়সংগতভাবেই আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং পূর্ববর্তী স্বৈরশাসনের কারণে সৃষ্ট ক্ষত ও বিভাজন মোকাবিলায় মনোনিবেশ করছে। তবে শিগগিরই অন্তর্বর্তী প্রশাসনের এজেন্ডায় উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির নীতিমালা ও এ–সম্পর্কিত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন হবে।
গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে এটা পরিষ্কার, বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষে এ ধরনের নীতি প্রণয়ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত কঠিন, অনেকটা অসম্ভবও বলা যায়।
সব কটি দলের বর্তমান নেতৃত্বে এসব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে অভিজ্ঞতার স্বল্পতা, আধুনিক প্রযুক্তিতে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আর সংকীর্ণ আত্মস্বার্থের কারণে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা প্রণয়নের প্রকল্পে তাদের সফল না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। আজকের অন্তর্বর্তী সরকারের মতো একটি দলনিরপেক্ষ সরকারই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি শক্তিশালী উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির জাতীয় নীতি প্রণয়ন করতে পারে।
২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল; যদিও বিগত সরকার এটাকে পুরোপুরি অকার্যকর করে দিয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মতোই আরও কয়েকটা স্বাধীন, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত গবেষণা সংস্থা বা ইনস্টিটিউট (ন্যাশনাল সায়েন্স এডুকেশন, ইউএসএ অথবা ইউরোপিয়ান রিচার্স কাউন্সিলের মতো), আধুনিক প্রযুক্তির ওপর ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, যেগুলো সারা দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে কাজ করবে। এ ছাড়া হিউমান রিসোর্স বিল্ডিং এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
প্রশিক্ষিত জনবলের উপস্থিতি আন্তর্জাতিক ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে, যদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। আমাদের প্রতিবেশী আরও অনেক দেশের মতোই এভাবে বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের জন্য বিশ্বমানের আকর্ষণীয় কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। শিক্ষিত মানুষের জন্য বর্তমানে বাংলাদেশে ভালো মানের চাকরি খুবই কম তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা পৃথিবীর ২ দশমিক ১ শতাংশ। আমাদের জনশক্তি অত্যন্ত পরিশ্রমী, বিশ্বজুড়ে আমাদের কর্মীদের যথেষ্ট সুখ্যাতি রয়েছে। প্রায় ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের পৃথিবীজোড়া বিদেশি বিনিয়োগের আমাদের অংশটা বর্তমানের তুলনায় (২ বিলিয়নের চেয়ে কম) আরও ২০ বা ২৫ গুণ বেশি হতে পারে—৫০ বিলিয়ন এমনকি ১০০ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে।
এর জন্য আমাদের দরকার প্রশিক্ষিত জনবল, আর একটি সক্ষম ও শক্তিশালী জনসংযোগ দল, যারা বর্তমানে চীন থেকে বের হয়ে আসা কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারবে। ড. ইউনূস উন্নত বিশ্বে এ জনসংযোগের ব্যাপারে আমাদের জন্য এক বিশাল সহায়ক শক্তি হতে পারেন।
পরিকল্পনা করা দরকার, যেন আমরা আগামী এক দশকে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সমপরিমাণে গবেষণায় ব্যয় করতে পারি (জিডিপির ০.৬৪%)। অত্যন্ত দুঃখজনক সত্যি হলো, আমরা বতর্মানে জিডিপির শূন্য দশমিক শূন্য ৩ শতাংশেরও কম খরচ করছি গবেষণায়, যেটা ১৪০ মিলিয়ন ডলারের চেয়েও কম। ভিয়েতনাম তাদের জিডিপির শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ গবেষণায় ব্যয় করছে। ইথিওপিয়াও আমাদের চেয়ে ৯ গুণ গবেষণায় ব্যয় করছে।
পশ্চিমের সমাজের সঙ্গে যদি তুলনা করি, শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ডেভিসের (আমার কর্মক্ষেত্র) ২০২৩-২৪ সালে গবেষণার বাজেট এক বিলিয়ন ডলারের বেশি ছিল। শিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়নে বাংলাদেশ বর্তমানে যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে, সেটা যুবসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে ১৫ বছর ধরে একজন ঔপন্যাসিক মন্ত্রী ছিলেন। অনেক খুঁজেও তাঁর কোনো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক অর্জন চোখে পড়েনি আমার।
গবেষণাবিষয়ক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, রূপায়ণের পন্থা আর ক্ষেত্রগুলো শনাক্ত করতে অনেক দেশের প্রশাসন যোগ্য প্রবাসীদের নিজ দেশে ফিরে আসার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দুহাত বাড়িয়ে। চীনা নেতারা আধুনিকীকরণ প্রকল্পের জাতীয় নীতিতে সম্প্রতি এক মাইলফলক ঘটনা যুক্ত করেছেন। এটা হলো এক হাজার প্রতিভাবান গবেষককে দেশে নিয়ে আসার প্রকল্প।
এ কার্যক্রম চীন অথবা যেকোনো পটভূমির গবেষকদের জন্য উন্মুক্ত। লক্ষ্য একটাই, চীনের গবেষণার মান দ্রুতগতিতে পশ্চিমের পর্যায়ে নিয়ে আসা। ভারত তিন দশক ধরে প্রবাসী কর্মদক্ষ জনশক্তি আর বিশেষজ্ঞদের দেশে আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে। ভারতের এক বিশাল প্রবাসী জনগোষ্ঠী দেশে ফেরত গিয়েছেন বিত্ত, শিক্ষা, গভীর বিজ্ঞান, প্রযুক্তির আর ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নিয়ে।
মাহাথিরের শাসনামলে নিজে টেলিফোন করে যোগ্য প্রবাসীদের মালয়েশিয়ায় ফেরত নিয়ে আসার যে প্রবণতা তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, আজকের অর্থনৈতিক উন্নতি তারই ধারাবাহিকতার ফল।
প্রত্যেক প্রবাসী সব সময়ই নিজের দেশের মাটিতে ফিরে আসার, দেশের ঋণ শোধ করার জন্য সুযোগ খোঁজেন। বেশির ভাগ বাংলাদেশিই পৃথিবীর অন্য জাতির তুলনায় দেশকে নিয়ে বেশি ভাবেন। তাঁদের শক্তি ও মেধাকে কাজে লাগানোর জন্য প্রয়োজন যুক্তিসংগত পথনির্দেশনা, সুযোগ্য নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা।
যাঁরা আজ পিএইচডি করতে কোরিয়া, মালয়েশিয়া, চীন, সিঙ্গাপুর, ভারত ও অন্যান্য দেশে যাচ্ছেন, তাঁরা এ দেশে বসেই এ দেশের সমস্যার ওপর পিএইচডি করতে পারতেন, যদি আমরা গবেষণাযন্ত্রটিকে সচল রাখতে পারতাম। একসময় এশিয়ার অনেক দেশ থেকে আমাদের দেশে ছাত্ররা আসতেন পড়াশোনা করতে। আজ যেমন আমাদের তরুণ–তরুণীরা যাচ্ছেন তাঁদের দেশে।
যদি আমরা একটা পরিকল্পনা করার প্রচেষ্টায় সফলও হই, বাস্তবায়নের জন্য অর্থ কোথায় পাবে বাংলাদেশ? উত্তরটি সহজ নয়, তবে সংকটময় সময়ে ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং আরও অনেক দেশ দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলোর জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে তাদের প্রবাসীদের জন্য বন্ড ইস্যু করেছে।
ভারত ২০০০ সালে সরকার–সমর্থিত ইন্ডিয়া মিলেনিয়াম ডিপোজিটস বন্ডে ৫ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করে, যা জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রবাসী ভারতীয়দের সম্পদ কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ইস্যু করা হয়েছিল।
শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি দেশীয় ও প্রবাসী বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে একাধিক দফায় কয়েক বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছে উন্নয়ন বন্ড ইস্যু করে। সারা বিশ্বের সম্পদশালী প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই সংকটের সময়ে একইভাবে অবদান রাখবেন, নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সর্বোপরি ড. ইউনূসের বিশ্বময় অগাধ বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে, যা অনেক বৈশ্বিক সংস্থাকে অনুপ্রাণিত করবে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য, ঋণ দেওয়ার জন্য।
প্রবাসীদের মেধা, অর্থ আর দেশের ঋণ শোধ করার স্পৃহা দেশের উচ্চশিক্ষা, গবেষণা ও প্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়নে, অর্থায়নে ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এবং ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গঠনে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।