বিশ্বের এক অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হলো বাংলাদেশ। যার প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে বাস করে প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ। এরপরও আমাদের দেশে এমন কিছু স্থান আছে যেখানে মানুষের বসতি খুবই কম। যেখানে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পশু-পাখির অবাধ চলাচল। শহরের জীবনযাপন থেকে মুক্তিলাভের জন্য যদি প্রকৃতির ভূস্বর্গে যদি হারিয়ে যেতে চান। এমনই একটা জায়গার নাম হলো নিঝুম দ্বীপ যা প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৌন্দর্য। চারদিকে গাছপালা ও ঘন জংগল বেষ্টিত প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যময় দ্বীপ। শীতকালে হাজারো অতিথি পাখির এক অন্যান্য মিলনমেলা বসে এখানে।
বাংলাদেশের একটি ছোট্ট দ্বীপ। নোয়াখালী জেলার হাতিয়া উপজেলার অর্ন্তগত হলো নিঝুম দ্বীপ।মূলত একে দ্বীপ বলা হলেও এটি হল কয়েকটি চরের সমষ্টি। নিঝুম দ্বীপের পূর্ব নাম ছিলো চর-ওসমান। ওসমান নামের একজন মহিষপালক তা মহিষের পাল নিয়ে সর্বপ্রথম এই দ্বীপে আসেন। তখন থেকেই এই নামেই এর নামকরণ করা হয়েছিলো। পরবর্তীতে হাতিয়া উপজেলার সাংসদ আমিরুল ইসলাম কালাম এই দ্বীপের নাম নিঝুম দ্বীপ নামকরণ করেন। মূলত নিঝুপ দ্বীপ বল্লারচর, চর ওসমান, কামলার চর এবং চুর মুরি- এই চারটি চর মিলিয়ে গঠিত। প্রায় ১৪,০৫০ একরের দ্বীপটি ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নদী মোহনায় জেগে ওঠে। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত কোনো জনবসতি ছিলো না, তাই দ্বীপটি নিঝুম অর্থাৎ নিস্তব্ধই ছিলো।
নিঝুম দ্বীপে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হরিণ ও মহিষ। এখানে কোন হিংস্র প্রাণি নেই। হরিণের সংখ্যা বর্তমানেপ্রায় ২২,০০০ (উইকিপিডিয়া) অন্য তথ্যমতে ৩৫০০০। নিঝুম দ্বীপে আছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি। এছাড়াও শীতের মৌসুমে অজস্র প্রজাতির অতিথির পাখির অভয়ারণ্যে পরিণত হয়।বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা এখানে বসবাস করে। জোয়ারের পানিতে বয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছই এদের একমাত্র খাবার। এখানে পাওয়া যায় মারসৃপারি মাছ যাদেরকে উভচর প্রাণী বলা হয়। ৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে মারসৃপার, ৬-৯ ইঞ্চি লম্বা হয়। বর্ষা মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। আর শীতকালে পাওয়া যায় চেঁউয়া মাছ। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে কেওড়া গাছ। সম্প্রতি বনবিভাগ কিছু নোনা ঝাউগাছ ও রোপণ করছে। এখানে আছে প্রায় ৪৩ প্রজাতির লতাগুল্ম এবং ২১ প্রজাতির অন্যান্য গাছ।
দ্বীপটি মূলত বেশ কিছু চরের সমষ্টি নিয়ে গঠিত। মধ্যখানে প্রবাহিত হয়েছে নদী আর খাল, যেন দ্বিতীয় সুন্দরবন। উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় শীতকালে শীতের তীব্রতাও তুলনামূলকভাবে এখানে অনেক কম। ফুরফুরে মনভোলানো স্নিগ্ধ সামুদ্রিক বাতাস দিবে এক অন্যান্য সুখের অনুভূতি। এই দ্বীপের দক্ষিণে জেগে উঠেছে নতুন একটি চর, ভ্রমণপিয়াসীরা নাম দিয়েছেন ‘ভার্জিন আইল্যান্ড’। প্রকৃতির সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে চাইলে আসুন নিঝুপ দ্বীপে। মূল দ্বীপসহ আশপাশের দ্বীপগুলোতে শীতকালে হাজার হাজার অতিথি পাখির মিলনমেলা বসে।
এদের মধ্যে আছে সরালি, লেনজা, জিরিয়া, পিয়ং, চখাচখি, রাঙ্গামুড়ি, ভূতিহাঁসসহ নানারকম হাঁস, রাজহাঁস, কাদাখোঁচা, জিরিয়া, গুলিন্দাসহ জলচর নানা পাখি, অনেক রকমের গাংচিল, কাস্তেচরা ইত্যাদি। মাঝে মাঝে আসে পেলিক্যান। আর বছরজুড়ে পাওয়া যায় সামুদ্রিক ঈগল, শঙ্খচিল, বকসহ নানা স্থানীয় পাখি তো আছেই। দ্বীপের আশপাশের জঙ্গলেই থাকে হরিণ, শেয়াল, বন্য শূকর, নানা রকম সাপ ও বানর।
বাংলাদেশের প্রকৃতির যে বিস্ময়কর সুন্দর রূপ দেখার জন্য এখানে আসতে হবে। পাখি আর হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে স্থানীয় গাইড নিয়ে যেতে পারবেন। আর আপনি অ্যাডভেঞ্চারপিয়াসী হলে নিঝুম দ্বীপ আপনাকে নিরাশ করবে না। জঙ্গলে হাঁটাহাঁটি তে অন্যরকম এক এডভেঞ্চারের স্বাদ পাবেন, সমুদ্রের বালুকাবেলায় ক্যাম্পিং করে থাকা অথবা বার-বি-কিউয়ের আয়োজন, ধু ধু চরে খালি পায়ে হেটে বেড়ানো, মহিষের বিশাল পাল, দেখা বা নৌকায় করে সাগর ভ্রমণ করা সহ অনেক কিছুই আছে।এককথায় বনভোজন বা পিকনিক এর জন্য আদর্শ স্পট
ঢাকার সদরঘাট থেকে লঞ্চ যায় হাতিয়া। বিকেল সাড়ে ৫টায় যাত্রা শুরু করে হাতিয়ার তমরুদ্দীন ঘাট যায়। মোটামুটি পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় ১২ ঘণ্টা। ডেকের টিকেট ৩৫০ টাকা, কেবিন সিঙ্গেল নিলে ২ হাজার টাকা, ডাবল কেবিন চার হাজার টাকা। সেখান থেকে আপনি ট্রলার বা মোটরসাইকেলে ঘাট পর্যন্ত যেতে পারবেন। ট্রলার (২০০ টাকা)..মোটরসাইকেলে (৩০০ টাকা জনপ্রতি) পৌঁছবেন মোক্তার ঘাট। সেখান থেকে ট্রলারে ৫-১০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন নিঝুপ দ্বীপ। আপনি বাসে করে যেতে পারেন নোয়াখালীর চেয়ারম্যান ঘাট পর্যন্ত। সেখান থেকে লঞ্চে করে হাতিয়া হয়ে যাওয়া যায় নিঝুম দ্বীপে। ফেরার সময় একটাই লঞ্চ ছাড়ে, হাতিয়া থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায়। এছাড়া মাইজদী দিয়ে বাস ধরতে পারেন।
নিঝুম দ্বীপের জনবসতিরপূর্ণ এলাকার নাম হলো ‘নামার বাজার’। এখানে পর্যটন রিসোর্টে থাকতে পারবেন। ভাড়া পড়ে রুমপ্রতি ৫০০ থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া বাজারে হোটেল শাহীনে থাকতেও পারবেন। বাজারে পাবেন মসজিদ বোর্ডিং, এখানে খুবই কম খরচে থাকতে পারবেন, তবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। সোলার প্যানেল দিয়ে পুরো দ্বীপ চলে। এ ছাড়া দ্বীপে থাকতে পারবেন সরকারি উপজেলা কমপ্লেক্স অথবা বন বিভাগের ডাকবাংলোয়। আর ক্যাম্পিং করার ইচ্ছা থাকলে মূল দ্বীপেই করা ভালো। খাওয়া-দাওয়া ও বিভিন্ন জিনিসপত্র বাজার থেকে কিনতে পারবেন। দাম অনেক কমে পাবেন। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর বিস্ময়রূপ দেখার জন্য নিঝুপ দ্বীপ এক আদর্শ স্থান। তাই দেরি না করে চলে আসুন।